প্রতিবাদের চেনা ছবিতে গান-কবিতা-নৃত্য-আঁকার মাধ্যমে আমাদের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে গেলেও, সেই চেনা ছবিতে ভিন্ন স্বাদের মাত্রা এনে দিতে রাস্তায় নেমেছেন বাক্-প্রতিবন্ধী মানুষও। যাদের বাক্-শক্তি আমাদের মননে-চেতনে আজকের দিনেও এক আশ্চর্য শক্তিরূপ হয়ে দেখা দেয়। এমন বিরল অ‘বাক’-শক্তির চরম নিদর্শন পাই গত ২৪ আগস্ট পড়ন্ত বিকালে, ধর্মতলায়। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ফাউন্ডেশন অফ ডেফ উওমেন’-এর (কলকাতা) তরফ থেকে এই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন অসংখ্য শ্রবণ-প্রতিবন্ধীও। তাঁদের শরীরী ভাষা সেই প্রতিবাদের আগুন, তাঁদের প্রকাশভঙ্গি সেই অ‘বাক’-শক্তির এক চরম প্রতীকী হয়ে উঠেছে।
পৃথিবী, সমাজ এমনকী পৌরাণিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সহাবস্থানের কাহিনি দেখেছি-পড়েছি-মেনেছি। তবে মেনেছি আংশিকভাবে, সম্পূর্ণভাবে নয়। সম্পূর্ণভাবে মান্যতা পেলে, আজ বিশ শতকে দাঁড়িয়ে সামাজিক বর্বরতার যে কদর্য চিত্র, তা আমাদের বিচলিত করতে পারতো না। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর সভ্যতার হাত ধরে বহু বহু যুগ আগে আমরা যে পর্যায়ে সভ্য হয়েছি, সেক্ষেত্রে আমাদের সার্বিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়নি। তাই আজও সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু নির্মমতার সাক্ষী হয়ে চলেছি আমরা।
গত ৯ আগস্ট আর জি কর হাসপাতালে একটি মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের মনকে আন্দোলিত করে। যাঁদের হাতে আমাদের সুস্থতা নির্ভর করে, আজ তাঁদেরই একজন পৈশাচিক অত্যাচারের বলি হয়েছেন। নির্যাতিতার অকালমৃত্যু, যা জনসমাজে প্রবল আলোড়ন তুলেছে– সেটাই অস্বাভাবিকতার আবহে যেন খুব স্বাভাবিক। এমন নারকীয় অত্যাচারকে অসুস্থ সমাজব্যবস্থা আজকের দিনেও মুছে ফেলতে ব্যর্থ।
নারী-পুরুষের যৌথ উদ্যোগে আজকের যে সমাজ– সেখানে নারীর ওপর ধর্ষণের মতো ঘৃণ্যতম অপরাধ বারবার আমাদের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছে, আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে। দিকে দিকে তাই স্বাভাবিক ভাবে প্রতিবাদের ঝড় উঠছে অবমাননার বিরুদ্ধে, অসুরক্ষিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। ডাক্তার থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রী, ছোট-বড়, শিশু-বয়স্ক– নারীপুরুষ লিঙ্গনির্বিশেষে আজ কেন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে মুখর হয়েছে? কারণটা খুব স্পষ্ট। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমরা সমাজের একটা বিশেষ দিক তুলে ধরতে চাইছি।
এই প্রতিবাদের চেনা ছবিতে গান-কবিতা-নৃত্য-আঁকার মাধ্যমে আমাদের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে গেলেও, সেই চেনা ছবিতে ভিন্ন স্বাদের মাত্রা এনে দিতে রাস্তায় নেমেছেন বাক্-প্রতিবন্ধী মানুষও। যাদের বাক্-শক্তি আমাদের মননে-চেতনে আজকের দিনেও এক আশ্চর্য শক্তিরূপ হয়ে দেখা দেয়। এমন বিরল অ‘বাক’-শক্তির চরম নিদর্শন পাই গত ২৪ আগস্ট পড়ন্ত বিকালে, ধর্মতলায়। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ফাউন্ডেশন অফ ডেফ উওমেন’-এর (কলকাতা) তরফ থেকে এই প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন অসংখ্য শ্রবণ-প্রতিবন্ধীও। তাঁদের শরীরী ভাষা সেই প্রতিবাদের আগুন, তাঁদের প্রকাশভঙ্গি সেই অ‘বাক’-শক্তির এক চরম প্রতীকী হয়ে উঠেছে। তাঁরা যেমন শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে তুচ্ছ করতে বদ্ধপরিকর, ঠিক তেমনই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে সমবেত হয়ে নির্যাতিতার প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতেও দ্বিধাহীন। তাঁদের এমন দৃঢ়তা দেখে সমাজের একটা বিরাট অংশের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত– প্রতিবন্ধকতা কোনওভাবেই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি তাঁদের প্রতিবাদে। তাঁদের প্রতিবাদী স্বর গর্জে উঠেছে– ‘নির্যাতিতার সঠিক বিচার হোক’, ‘দোষীদের চরম শাস্তি হোক’, ‘ধর্ষণ-খুন বন্ধ হোক’– এই দাবিতে।
…………………………………………………………..
আরও পড়ুন রণিতা চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: মেয়েদের নাইট ডিউটি কি শরীর পাহারা দেওয়ার ডিউটি?
…………………………………………………………..
বোবা-কালা-অক্ষম বলে তকমা পেয়ে আসা এই উপেক্ষিত মানুষদের একটাই আশা, একটাই স্বপ্ন, একটাই দাবি– নারীজাতির সম্মানের পাশাপাশি সমাজব্যবস্থায় বদল আনা একান্ত দরকার। সমাজের চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে সক্রিয় উপস্থিতিতে তাঁরা বুঝিয়ে দিচ্ছে বিশেষভাবে সক্ষম বন্ধুদের এই প্রতিবাদ কতটা অনন্য। রাজপথে তাঁদের এই প্রতিবাদ কর্মসূচি জনমানসের নজর এড়িয়ে যায়নি। অনেকে বিহ্বল হয়ে গিয়েছেন তাঁদের সক্রিয় প্রতিবাদে। এমন বিরল দৃশ্য দেখে এক বন্ধুর স্বগতোক্তি– ‘ওঁরা আমাদের থেকে বেশি কথা বলতে পারে, ওঁরা আমাদের চেয়ে অনেক গুণে বেশি সক্ষম’, এই কথাটা বলার পেছনে যে একটা মুগ্ধ জাদুবল কাজ করছে, তা অস্বীকারের কোনও উপায় নেই । বাক্-প্রতিবন্ধীদের এই অ‘বাক’-শক্তি সেই জাদুবলের শক্তিরূপেণ মন্ত্র।
বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন– ‘Kindness is a language which the deaf can hear and the blind can see.’– এই উক্তির সূত্র ধরে আমরা যদি আজকের দিনে সমাজের চোখ-কান বিশ্লেষণ করে কাঁটাছেড়া করতে বসি, তাতেও সেই ‘kindness’-এর ছিটেফোঁটা পাওয়া যাবে না। তার কারণ একটাই– প্রতিবন্ধকতা নির্মূল করার সদিচ্ছার অভাব এই সমাজব্যবস্থায়। নির্যাতিতার মৃত্যু আমাদের প্রত্যেকের কাছে রাগ-দুঃখ, লজ্জা, হতাশার। অপরাধীর কঠোর শাস্তির দাবিতে আমরা যেমন প্রতিবাদে সরব হয়েছি, ঠিক তেমনই ‘kindness’ আশা করছি প্রশাসন তথা সরকারের কাছেও, যা প্রতিবন্ধীদের পাশাপাশি নারীজাতির সমানাধিকার এনে দেবে। পরিশেষে এটুকুই বলার, এই লড়াই বিনাশ করুক সমাজের কলঙ্ককে। এই অ‘বাক’-শক্তি হয়ে উঠুক সবার ব্রহ্মাস্ত্র, পথ দেখাক প্রতিবাদীদের। জোরালো দাবি উঠুক– ‘অন্যায়ের সুবিচার চাই’।
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
………………………………………………