প্রতি বছর নভেম্বরের তৃতীয় রবিবার পথ দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ করার দিন। ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে পাস হয়েছে ‘গুড সামারিটান আইন’। এর ফলে পথ দুর্ঘটনায় আহত বা মৃত ব্যক্তিকে পথচারী বা স্থানীয় কোনও ব্যক্তি সাহায্য করলে তাঁকে আইনি জটিলতা পেরতে হবে না। কর্ণাটক প্রথম রাজ্য হিসাবে এই আইন বলবৎ করেছে। কিন্তু আইন পাস করলেই হবে না। দরকার সচেতনতা। দরকার সড়ক পরিবহণের কাঠামো উন্নয়ন। দরকার আহতদের দ্রুত চিকিৎসা। তবেই ঊর্ধ্বহারে বাড়তে থাকা পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমতে পারে। পথ দুর্ঘটনায় যেন কোনও প্রিয়জনকে না হারাতে হয়। কোনও ঘুমন্ত ফুটপাথবাসীর গায়ে যেন কোনও মত্ত অভিনেতার গাড়ির চাকার দাগ না লাগে। বাড়ির মানুষটি নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরুক।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
মাত্র ক’দিন আগে, ১২ নভেম্বর, ২০২৪। দেরাদুনে ঘটে গেল এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা। মারা গেলেন তিন মহিলা-সহ ছ’জন। একজন এখনও মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। প্রত্যেকেরই বয়স ২৫ বছরের নীচে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সে ভিডিও আমাদের হাতের তালুতে, সেই ভয়াবহতা আমরা কি তবু স্পর্শ করতে পেরেছি?
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে ভারতে চার লক্ষেরও বেশি পথ দুর্ঘটনা। মারা গেছেন ১,৬৮,০০০-এরও বেশি মানুষ। যার মধ্যে শতকরা ৬৬.৫% মানুষই ১৮-৪৫ বছর বয়সি। সচেতনতার অভাব, না কি আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানোর প্রবণতা? একটু ভেতরে ঢুকে দেখা যাক। পথ দুর্ঘটনার জন্য মূলত তিনটি বিষয় দায়ী– ড্রাইভার, গাড়ি ও রাস্তার হাল।
একটা ঘটনা বলি। তখনও মাতলা নদীর ওপরে সেতু হয়নি। একজন সহকর্মীর সঙ্গে যাচ্ছি গোসাবা। নদী পেরনোর পর অটো ধরতে হবে। আমরা দু’জন একটি দীর্ঘ লাইনের শেষে দাঁড়ালাম। সেই সময় সেখানের অটোযাত্রা ছিল একটি যন্ত্রণার বিষয়। শহরে বাতিল হয়ে যাওয়া অটোগুলোকে ওখানে কিনে নেওয়া হত। সেগুলোর সাইজ দু’দিকে আর পিছনে একটু বাড়িয়ে, ভেতরে একটা বেঞ্চ লাগিয়ে তার মধ্যে গাদাগাদি করে ১১-১২ জনকে ঠেসে দেওয়া হত। অতটা পথ আমরা ওভাবে যেতে পারব না ভেবে, সবার ভাড়া গুনে দু’জন মিলে একটা অটো রিজার্ভ করলাম।
ভয়ংকর রাস্তা! খানা-খন্দ, গর্ত, কাদা– সব মিলিয়ে মুড়ির টিনের মতো ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চলছিল অটো। একটু দূর যেতে না যেতেই ড্রাইভার নির্লিপ্তভাবে বললেন, ‘দাদা, একটু চাকাটা দেখবেন তো, খুলে যাচ্ছে কি না!’ আমি তো আঁতকে উঠে সহকর্মীর সঙ্গে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম! তারপর প্রাকৃতিক দৃশ্য ছেড়ে চাকার দিকে তাকিয়ে দেখি সেটি নড়বড় করছে। আর একটু পরেই খুলে যাবে। মৃত্যুভয়ে ড্রাইভারকে চেঁচিয়ে ডাকতে সে অটো থামিয়ে ততোধিক নির্লিপ্তভাবে চাকার নাটবল্টু টাইট করে আবার চালাতে শুরু করল। এইভাবে পুরো রাস্তায় বার চারেক চাকা খুলে অটো উল্টে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা থেকে বাঁচলাম!
ওখানকার মানুষ ওভাবেই প্রাণ হাতে করে যাতায়াত করতেন। এখন ব্রিজ হওয়ার পর সেই অটো নেই, তবে সুন্দরবনের অনেক জায়গাতেই এখনও যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই খারাপ। দুর্ঘটনাও ঘটে। আরও একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল হাজারিবাগ যাওয়ার সময়। হাজারিবাগ রোড স্টেশন থেকে টাউন অনেক দূরে। সেখানেও ট্রেকারে অনেক মানুষকে তোলা হয়। ছাদেও মুরগি-ছাগলের সঙ্গে মানুষ বোঝাই করে তবেই ট্রেকার ছাড়ে। ভেতরে ভয়ংকর জোরে ভোজপুরি গান বাজছিল, তাই বাধ্য হয়ে ছাদে উঠেছিলাম।
সরু রাস্তা। দু’-পাশে নয়ানজুলি। উল্টোদিক থেকে গাড়ি বা বাস এলে ট্রেকার রাস্তার পাশের খাদ ধরে নেমে যাচ্ছে। আবার গাড়ি পেরিয়ে গেলে পাহাড়ে চড়ার মতো ট্রেকার রাস্তায় ফিরে আসছে। প্রতিবার এমনভাবে ওভারলোডেড গাড়িটি নীচে নামার সময় মনে হচ্ছিল, এই বুঝি উল্টে গেল! পাশের যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে ভোজপুরী মেশানো হিন্দিতে বলেছিল, প্রতিদিন ট্রেকার উল্টায়। মানুষ মারাও যায়। গরিব মানুষের প্রাণের কি দাম আছে বাবু?
উত্তর দিতে পারিনি। এভাবেই মানুষের যাতায়াত দেখেছি ভারতের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আধা-শহরগুলিতে। রাজস্থানে খড়ের মতো বোঝাই করে লক্করবগগা হোক বা পশিমবঙ্গের ভ্যানও– অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে প্রতিদিন দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে। গরিব মানুষের উপায় নেই, কারণ ভাড়া কম হয়। অন্যদিকে এই গাড়িগুলি যান্ত্রিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল এবং কম শক্তির ইঞ্জিন থাকা সত্ত্বেও ভাঙা রাস্তা দিয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলাচল করে। ফলে দুর্ঘটনার প্রবণতা বাড়ে।
…………………………………..
পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা: ৩৭ বছরেও ন্যায় পেলেন না রূপ, ‘সতী’ মাহাত্ম্যে রাষ্ট্রের নীরব সায়?
……………………………………
অন্যদিকে শহরাঞ্চলেও কম বয়সি গাড়িচালকদের দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোর প্রবণতা। অনেকেই এটিকে ‘বীরত্ব’ হিসেবে দেখে বা অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চ পায়। তথ্য বলে, ভারতে ২০২২ সালে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৭১.২% গতির মাপকাঠি ছাড়িয়ে যাওয়ার কারণে ঘটেছে। সরকারের মেপে দেওয়া গতির ঊর্ধ্বসীমা অনেকেই জানেন না। এক্সপ্রেসওয়ের ক্ষেত্রে যা ১২০ কিমি প্রতি ঘণ্টা, জাতীয় হাইওয়েতে ১১০ কিমি প্রতি ঘণ্টা ও শহরাঞ্চলে ৭০ কিমি প্রতি ঘণ্টা। এই দেরাদুনের ঘটনাতেই জানা যাচ্ছে, দুর্ঘটনাগ্রস্ত ইনোভা গাড়িটি একটি বি.এম. ডব্লুর সঙ্গে গতির প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। ফল হিসেবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি কন্টেইনার ট্রাকে ধাক্কা মারে। গাড়িটি এতই দ্রুত গতিতে ছিল, যে ছাদটি পুরো দুমড়ে-মুচড়ে যায়৷
একবার মানালি থেকে সিমলা ফিরছিলাম। আমাদের ইনোভা গাড়িটি একটি হুডখোলা জিপসিকে ক্রস করে। সেই গাড়িটি হালকা স্পিডে ছিল। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন একজন জাঠ তরুণী। বন্ধুদের সামনে আমাদের গাড়িটি ওই গাড়িটিকে পিছনে ফেলে দেওয়ায় তা চালক তরুণীর ইগোতে লাগে। তখন তিনি গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। আমাদের গাড়ির বাণিজ্যিক ড্রাইভারের সঙ্গে তিনি গতির প্রতিযোগিতায় নামেন এবং পাহাড়ি রাস্তায় অনাবশ্যক রাফ ড্রাইভিং করতে থাকেন। গাড়িটি যে কোনও সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারত এবং পথচলতি বিপরীত দিক দিয়ে আসা গাড়িগুলিকেও বিপদে ফেলতে পারত। তখন আমরাই আমাদের ড্রাইভারকে থামতে বলি ও ওই গাড়িটিকে ছেড়ে দিতে বলি। আমাদের কথা শুনে তিনি গাড়ির গতি ধীরে করলে ওই গাড়িটি খুব বাজেভাবে আমাদের পেরিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়ায়। ধাক্কা লাগতে পারত যদি না আমাদের ড্রাইভার খুব পোক্ত হতেন।
গাড়ির চালক মেয়েটি নেমে এসে আমাদের ড্রাইভারকে ধাক্কাধাক্কি করতে থাকেন। বোঝা যায়, মেয়েটি ও তাঁর সঙ্গীরা মদ্যপ। দেরাদুনের ঘটনায়ও সন্দেহ করা হচ্ছে গাড়ির চালক ও যাত্রীরা যথেষ্ট মদ্যপান করেছিলেন। যদিও তদন্ত চলছে, তবু গতির সীমা লঙ্ঘন করার এটিও একটি বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। যতই সচেতনতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হোক না কেন– গ্রাম থেকে শহর, পাহাড় থেকে সমুদ্র; অনেক পথ দুর্ঘটনার মূলে কিন্তু নেশাগ্রস্ত চালক। মদ খেলে সামনের গাড়ির গতির ধারণা করতে সমস্যা হয়। যেমন এক্ষেত্রে দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়ির চালক ট্রাকটির গতির ধারণা করতে পারেননি।
……………………………………
পড়ুন সেবন্তী ঘোষ-এর লেখা: যা ছিল ভোরের শিশির, তা ডিজিটাল যুগে পরিণত হল বিকারের একতাল মাংস পিণ্ডে
……………………………………
বেশি যাত্রী পাওয়ার উদ্দেশ্যে গতির প্রতিযোগিতায় নামতে দেখেছি দু’টি বাসকে। খাস কলকাতায়। সল্টলেকে যে কারণে প্রাণ হারাল চতুর্থ শ্রেণির এক শিশু। মায়ের স্কুটিতে করে স্কুলে যাচ্ছিল সে। দোষ কার? বাসের তো অবশ্যই। মায়েরও কি নয়? কেন সন্তানের মাথায় হেলমেট ছিল না? এখনও প্রচুর বাইকার হেলমেট ছাডাই বাইক চালায়। পুলিশ কতজনকে কেস দেবে? আসলে হেলমেট যে নিজের সুরক্ষার জন্য তা অনেকেই বোঝেন না। পুলিশ ধরবে বলে হেলমেট পরেন। শুধু হেলমেট না পরার কারণে প্রচুর পথ দুর্ঘটনায় বাইক-আরোহী মারা গেছেন। আইনে জরিমানার কথা বলা আছে। কিন্তু জরিমানা হাতে গুঁজে হেলমেট ছাড়াই বেপরোয়া বাইক-রাইডের সাক্ষী হয় শহর। প্রতি রাতে।
এদের মধ্যে অনেকেই নাবালক। অর্থাৎ লাইসেন্সই পাননি। তথ্য বলে, ২০২২ সালে ৯০০০-এর উপর নাবালক পথ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। বাড়ির বাবা-মা নিজেদের কাজ থেকে সময় দিতে পারছেন না। তাই বিকল্প হিসেবে বাইক তুলে দিচ্ছেন। বুঝছেন না মরণফাঁদে আসক্ত করে তুলছেন তাকে।
প্রতি বছর নভেম্বরের তৃতীয় রবিবার পথ দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের স্মরণ করার দিন। ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টে পাস হয়েছে ‘গুড সামারিটান আইন’। এর ফলে পথ দুর্ঘটনায় আহত বা মৃত ব্যক্তিকে পথচারী বা স্থানীয় কোনও ব্যক্তি সাহায্য করলে তাঁকে আইনি জটিলতা পেরতে হবে না। কর্ণাটক প্রথম রাজ্য হিসাবে এই আইন বলবৎ করেছে। কিন্তু আইন পাস করলেই হবে না। দরকার সচেতনতা। দরকার সড়ক পরিবহণের কাঠামো উন্নয়ন। দরকার আহতদের দ্রুত চিকিৎসা। তবেই ঊর্ধ্বহারে বাড়তে থাকা পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমতে পারে।
পথ দুর্ঘটনায় যেন কোনও প্রিয়জনকে না হারাতে হয়। কোনও ঘুমন্ত ফুটপাথবাসীর গায়ে যেন কোনও মত্ত অভিনেতার গাড়ির চাকার দাগ না লাগে। বাড়ির মানুষটি নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরুক…