বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রথিতযশা এই কবি, বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদ চৌধুরী শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি ইত্যাদি রচনা করে থাকলেও এবং সম্পাদনা ও অনুবাদকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কবি হিসেবেই তাঁর অধিক পরিচিতি। বিভিন্ন সময়ে তাঁর কবিতায় হতাশা, অবক্ষয়, মুক্তিযুদ্ধ বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে, কবির নিজস্ব ধারায়।
ষাটের প্রখ্যাত কবি আসাদ চৌধুরী। জন্মেছিলেন ১৯৪৩ সালে, ১১ ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বাকেরগঞ্জ জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া জমিদার বাড়িতে একটি সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলিম পরিবারে।
তাঁর কবিতার লাইনগুলি মনে পড়ে? সেই যে ‘টু উইমেন ছবিটা দেখেছ বারবারা? / গির্জার ধর্ষিতা সোফিয়া লোরেনকে দেখে নিশ্চয়ই কেঁদেছিলে/ আমি কাঁদিনি, বুকটা শুধু খাঁ খাঁ করেছিল—/ সোফিয়া লোরেনকে পাঠিয়ে দিও বাংলাদেশে / তিরিশ হাজার রমণীর নির্মম অভিজ্ঞতা শুনে/ তিনি শিউরে উঠবেন।/ অভিধান থেকে নয়/ আশি লক্ষ শরণার্থীর কাছে জেনে নাও, নির্বাসনের অর্থ কী?/ জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিওয়ালা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার/ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে এসো—/ সাধু অ্যাবের মর্মর মূর্তিকে গণতন্ত্র আর মানবতার জন্য/ মালির ঘামে ভেজা ফুলের তোড়া দিও না—/ নিহত লোকটি লজ্জায় ঘৃণায় আবার আত্মহত্যা করবে।/ বারবারা এসো, / রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই / বিবেকের জংধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি / অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই / জল্লাদের শাণিত অস্ত্র / সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে, / দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে / এসো বারবারা বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।’
এইসব আশ্চর্য আশ্চর্য কবিতার লাইন পাঁজরে এমন দাগ কাটে যে, বছরের পর বছর জাগ্রত হয়েই থাকে তারা, বিস্মরণের কোনও উপায়ই নেই। কিন্তু শুধু তো কবিতা নয়, কবিও মনে ছাপ ফেলেন। আসাদ চৌধুরীর পরিচিত যে কোনও মানুষই তাঁর ঔদার্যের, তাঁর সারল্যের, তাঁর অকপট স্বভাবের পরিচয় পেয়েছে, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আমার সৌভাগ্য যে, আমি তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। বাংলাদেশে ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’-এর আমন্ত্রণে জাতীয় কবিতা উৎসবে উপস্থিত হয়েই যে ব্যক্তির সঙ্গে আমার আন্তরিক আলাপ হয়েছিল, তিনি কবি আসাদ চৌধুরী। শুধুমাত্র মঞ্চে বসে বসে বা মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে নয়, এছাড়াও তাঁর সঙ্গে আমার অনেক কথাবার্তা হয়। আমি দেখেছি তাঁর মুক্তমন, তাঁর আন্তরিকতা, দেখেছি নিখাদ এক ব্যক্তিকে। ফলে আসাদ চৌধুরী খুব সহজেই ‘আসাদ ভাই’ হয়ে গেলেন।
আমার কবিতার বই ‘প্রেম ও বিরহের কবিতা’ ২০০৬ সালে বাংলাদেশের ‘একুশে গ্রন্থমেলা’য় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে ঢাকায় অন্যান্য অনেক কবির সঙ্গে আসাদ চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে বেশি কথা বলার সুবিধে হয়নি বলে তাঁর মতো বড় কবি আমার সঙ্গে দেখা করতে আমাদের হোটেলে এসেছিলেন! ভাবতেও অবাক লাগে, তিনি ছিলেন এতটাই সহজ-সরল মানুষ। চা-পান করতে করতে দীর্ঘক্ষণ তাঁর সঙ্গে আড্ডা হয় সেই হোটেলে বসে। এবং সেই আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর ঝোলা থেকে পানের কৌটো বের করে জর্দা সহকারে পরিপাটি করে পান সেজে খাওয়ার চিত্রটি জ্বলজ্বল করছে আজও। সেই আড্ডায় অনেক গল্প হয়েছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গল্প, তিনি নিজে সেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বলতে বলতে তাঁর অশ্রুসজল চোখ দেখে শুধু সেই সময় নির্বাক হয়েছিলাম তা’ নয়, আজও তাঁর সেই চোখ দেখতে পাই, শুনতে পাই মানুষের প্রতি মানুষের বর্বরোচিত অত্যাচারের সেই গল্প বলতে বলতে তাঁর রুদ্ধ কণ্ঠস্বর। মানুষ হয়েও মানুষের প্রতি পিশাচদের বিবেককে যে জাগ্রত করতে পারেনি, সেখানেই ছিল কবির আক্ষেপ–‘…নদীর জলে আগুন ছিলো/ আগুন ছিলো বৃষ্টিতে/ আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার/ উদাস-করা দৃষ্টিতে।/… এখন এ-সব স্বপ্নকথা/ দূরের শোনা গল্প, / তখন সত্যি মানুষ ছিলাম/ এখন আছি অল্প।’
আসাদ ভাই যতবার কলকাতায় এসেছেন বা আমি যতবার ঢাকাতে গিয়েছি, আমাদের সাক্ষাৎ এবং কথা-বার্তা হয়েছে। আমি দিল্লিতে থাকাকালীন একবার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। আমার যাতে দিল্লি থেকে ভিসা পেতে কোনও অসুবিধে না হয়, তিনি বাংলাদেশ হাই কমিশনের দিল্লি অফিসে এনা মহম্মদ চৌধুরীকে বলে দিয়েছিলেন। আমি আসাদ ভাইয়ের সুবাদেই হাই কমিশনের অফিসে প্রচুর আতিথেয়তা পেয়েছিলাম। আসাদ ভাইয়ের জর্দা-প্রীতি এমনই বিখ্যাত ছিল, তাঁর পরিচিত মানুষরা সেকথা জানতেন, অতএব এনা মহম্মদ চৌধুরী তাঁর জন্য জর্দার কৌটো পাঠাবেন আমার সঙ্গে, এ আর এমন কথা কী! তাঁর বার্ধক্যজনিত এবং শারীরিক অসুস্থতার কারণে শেষ জীবনের অনেকখানি সময় তিনি কানাডায় তাঁর পুত্র-কন্যার কাছে ছিলেন, সেই কানাডা থেকেও আমাকে একাধিকবার ফোন করেছিলেন, চূড়ান্ত অসুস্থ হওয়ার আগে অবধি।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রথিতযশা এই কবি, বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদ চৌধুরী শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি ইত্যাদি রচনা করে থাকলেও এবং সম্পাদনা ও অনুবাদকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কবি হিসেবেই তাঁর অধিক পরিচিতি। বিভিন্ন সময়ে তাঁর কবিতায় হতাশা, অবক্ষয়, মুক্তিযুদ্ধ বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে, কবির নিজস্ব ধারায়। তিনি লিখেছেন– ‘…সাংবাদিকের কাঠের ডেস্কে,/ কাগজে, কেতাবে, পুঁথিতে, কলমে,/ ইনজেকশনে, দাঁদের মলমে,/ ভ্যানিটি ব্যাগে বা পকেটে, আঁচলে/ ড্রয়ারে, ব্যাংকে, আয়রন সেফে/ সত্য নামক মহান বস্তু নেই তো!/ কবিতায় নেই, সঙ্গীতে নেই/ রমণীর চারু ভঙ্গিতে নেই/ পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই/ নাটকের কোন সংলাপে নেই/ শাসনেও নেই, ভাষণে নেই/ আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই/ রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই,…”
আবার কখনও লিখেছেন তিনি– ‘প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল/ বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম/ আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।…/ অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার / সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা/ সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে–/ আমি তার সুরকার– তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।/ মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী/ গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়/ মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে-ঝিয়ে/ খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো,/ অস্ফুট গোলাপ-কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে/ কার কী বা আসে যায়।/ বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকা-বাঁকা পবিত্র হরফ/ বোবা হ’য়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটের ক্ষুধা,/ মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ।/ পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে-চেয়ে নিবিড় আদর/ সারারাত কেঁদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর।…’ – ‘রিপোর্ট ১৯৭১’ কবিতায় তিনি তুলে ধরেছিলেন মেয়েদের অবস্থা।
‘শহীদদের প্রতি’ কবিতায় তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমাদের যা বলার ছিল/ বলছে কি তা বাংলাদেশ?/ শেষ কথাটি সুখের ছিল?/ ঘৃণার ছিল?/ নাকি ক্রোধের,/ প্রতিশোধের,/ কোনটা ছিল?…’
তাঁর কবিতায় হতাশা, অবক্ষয়, মুক্তিযুদ্ধ যেমন প্রাধান্য পেয়েছে, বাংলার প্রকৃতির চিত্রও সেরকম অভিব্যক্ত হয়েছে অতুলনীয় দ্যোতনায়, মাটি ও মাতৃকাকেও উপেক্ষা করেননি তিনি, ‘বাংলাদেশের পাখি কেন মধুর সুরে ডাকে,/ জানো?/ জানি জানি জানি।/ পাখির ভাষার মান দিতে যে/ বাঙালি দেয় জানো–/ পাখি যে তা জানে,/ তাইতো পাখি পাগল করে,/ বিহান বেলার গানে।/ বাংলাদেশের আকাশ কেন কপালে টিপ আঁকে,/ জানো?/ জানি জানি জানি…”
৫ অক্টোবর, ২০২৩-এ তাঁর প্রয়াণে এটুকুই বলার যে, বাংলা সাহিত্যে আসাদ চৌধুরীর অনবদ্য অবদান কখনওই ম্লান হওয়ার নয়।