আমি যখন কালীপদ দাস মহাশয়ের কাছে খেয়াল শিখতে শুরু করি, তখন যে গানগুলি, যে বন্দিশগুলি গাইতে হত, আমার মোটেও ভালো লাগত না। আলাহিয়া বিলাবল রাগে একটা বন্দিশ ছিল, ‘কৌন বাটারিয়া গাইল মাই, দেহ বাতায়ে ইতি হি ইতি মোরা সুর বাগাইল বা…’। দশটি ঠাটের, দশটি মেলের নানা রাগ আমাকে আমার খেয়াল গুরু শিখিয়েছিলেন যত্ন করে। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলাম শিখতে। কিন্তু মন ভরত না। কেননা ওই রামনিধি গুপ্ত, মানে নিধুবাবুর গানের কথাগুলো আমার মনে ধরেছিল– ‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা’।
৩.
কেউ কেউ অদ্ভুত দাবি করেন যে, বাংলা খুব নরম ভাষা। হিন্দুস্তানি ভাষাটিতে যে জাঁদরেল শব্দের ঝংকার হয়, সেটা বাংলায় সম্ভব নয়। এটা নিতান্তই নির্বোধের মতো, অর্বাচীন, অশিক্ষিতের মতো বলা। বাংলা ভাষায় যে কাব্য রচিত হয়েছে, তা তো মিনমিনে কাব্য নয়। কী আদিযুগে, কী মধ্যযুগে, কী আধুনিক যুগে বাংলা ভাষায় যে শব্দ দিয়ে, ধ্বনিময়তা দিয়ে গদ্য লেখা হয়েছে, পদ্য লেখা হয়েছে, কাব্য লেখা হয়েছে, গান লেখা হয়েছে, তা তো শুধু নরম নয়। এটা কীর্তনের দেশ, কীর্তনের নানান রকম ধ্বনির প্রয়োগ আছে, ভাষাগত ধ্বনি। তেমনই আধুনিক কবিতা, ধ্বনিময়তার রাজ্য। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় বলুন, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বলুন, সত্যেন দত্তের কবিতায় বলুন, বিভিন্ন মানুষের কবিতায় ধ্বনির কোনও তুলনা নেই। ধ্বনি ধ্বনি ধ্বনি। ধ্বনি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাংলার কবিরা করেছেন। কাজেই বাংলা ভাষা বড্ড নরম, সেখানে খেয়ালের ওই পুরুষালি জিনিস চলে না, যাকে বলে ধ্বনির হাতুড়ি পেটানো– এ কথা ভুল। ধ্বনি কর্কশ হবে কেন, তা যদি গানই হয়? বাংলা ভাষায় যথেষ্ট হাড়গোড় নেই, কেবল মেদ আছে– এই দাবি করা অশোভন। এই দাবি করছেন বাঙালিরাই। অবাঙালিরা নয় কিন্তু। বাঙালিরাই, বাঙালি শিল্পীরাই সবচেয়ে বেশি বলছেন যে, বাংলায় খেয়াল হয় না। এতগুলো ভাষায় হয়, শুধু বাংলায় হয় না। ওদিকে স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন, বাংলায় খেয়াল হইবে না কেন? আমি নিজে যখন বাংলা খেয়াল গাইতে শুরু করি, তখন কোনও একটা পত্রিকায় মস্তবড় আধুনিক এক শিল্পী বলছেন, বাংলায় খেয়াল? এরপর শুনব কাশ্মিরী গজল!
আমি নিজে ছোটবেলা থেকেই হিন্দুস্তানি খেয়াল শিখেছি, শিখেছি কালীপদ দাসের কাছ থেকে। তিনি ছিলেন আমার গুরু, তাঁর কোনও তুলনা নেই। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন। দীর্ঘকাল ধরে। তিন দশক ধরে আমি শিখেছি। আমি পুরোদস্তুর খেয়াল গাইতে পারি। সেরকম পারদর্শিতা আমি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু আমার গুরু, আমার শিক্ষক ও আমার পিতৃদেব মনে করতেন, চল্লিশ বছর বয়স হওয়ার আগে আসরে খেয়াল গাওয়া চলে না। কিন্তু এখন আর সেরকম দিনকাল নেই, এখন তো অনেকে অল্প বয়স থেকেই আসরে খেয়াল পরিবেশন করেন। কিন্তু আমার সময়ে আমার গুরু ও পিতৃদেব অন্যমত পোষণ করতেন। ফলে আকাশবাণীতে আমি খেয়ালের অডিশন দিইনি। আমার যখন বয়স ১৮ বছর বয়স, তখন আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের আধুনিক রবীন্দ্রসংগীত-নজরুলগীতির জন্য অডিশন দিই। সেই যুগে, ’৬৬ বা ’৬৭ সালে, আধুনিক রবীন্দ্রসংগীতে আমি ‘বি হাই গ্রেড’ অর্জন করেছিলাম। এদিকে নজরুলগীতি খুব একটা ভালো গাইতে পারিনি অডিশনে। ‘বি গ্রেড’ পেয়েছিলাম। তিনটি গ্রেড ছিল– এ গ্রেড, বি হাই এবং বি। এখনও তাই আছে বোধহয়। ‘সি’ গ্রেড কথাটি শুনতে ভাল লাগে না। তাই ‘সি গ্রেড’ কথাটি তুলে দিয়ে ‘বি গ্রেড’ কথাটি বলা হয়। আমার পিতৃদেবও আমার সংগীতের গুরু। আমার জীবনের প্রথম সংগীত গুরু। আমাকে খেয়াল শিখিয়েছিলেন গুরু কালীপদ দাস মহাশয়। যাঁর নামের আগে ‘পণ্ডিত’ বা ‘ওস্তাদ’ কিছুই নেই। আমার পিতৃদেব সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও কালীপদ দাস দু’জনেই বলেছিলেন– আগে বছর চল্লিশেক বয়স হোক, সেই ম্যাচুরিটি, পরিণত বুদ্ধি হোক, রুচি হোক, তারপর তুমি খেয়াল গাইবে আসরে বা বেতারে।
পড়ুন আপন খেয়ালে-র আগের পর্ব: সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা খেয়াল গাওয়ার বরাত পেয়েছিলেন আকাশবাণী থেকেই
আমি যখন কালীপদ দাস মহাশয়ের কাছে খেয়াল শিখতে শুরু করি, তখন যে গানগুলি, যে বন্দিশগুলি গাইতে হত, আমার মোটেও ভালো লাগত না। আলাহিয়া বিলাবল রাগে একটা বন্দিশ ছিল, ‘কৌন বাটারিয়া গাইল মাই, দেহ বাতায়ে ইতি হি ইতি মোরা সুর বাগাইল বা…’। এই গানটি যদি আমায় গাইতে হয়, বিপদে পড়ে যাব। দশটি ঠাটের, দশটি মেলের নানা রাগ আমাকে আমার খেয়াল গুরু শিখিয়েছিলেন যত্ন করে। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলাম শিখতে। কিন্তু পুরো শিখে উঠতে পারিনি। বাড়িতে আসরও বসত, সেখানে খেয়াল গাইতামও। তখন আমার সঙ্গে তবলা বাজাতেন সত্য রায় মশাই। চমৎকার তবলিয়া। তিনি বাজাতেন। কিন্তু মন ভরত না। কেননা ওই রামনিধি গুপ্ত, মানে নিধুবাবুর গানের কথাগুলো আমার মনে ধরেছিল– ‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা’। আমার মাতৃভাষায় গান গাইতে না দিলে কী করে হবে? কাজেই তখন থেকে আমার খিদেটা ছিল। বিপুল তৃষ্ণা ও চাহিদা ছিল মনে– যে আমি বাংলায় খেয়াল গাইব। শেষকালে, ’৭৫ সাল নাগাদ আমি যখন এই দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়েছি রাজনৈতিক কারণে, পালিয়ে গেছি বলা যায়, তখন আমি আমার মাস্টারমশাইয়ের পা ধরে তাঁকে বলেছিলাম, আমায় ক্ষমা করে দিন, আমি আর পারছি না, আমি এই ভাষাগুলিতে আর খেয়াল গাইতে পারছি না। আমি যদি কোনও দিন বাংলায় খেয়াল রচনা করতে পারি, বা বাংলায় গাইতে পারি, আমি আপনার কাছে যাব। তখনও আমি গান লিখতাম না, সুর করতাম আকাশবাণীতে আধুনিক গানের। সেই সময় মনে হয়েছিল গান লিখতে হবে। সুর করতে হবে। এবং খেয়াল যদি আমায় গাইতে হয়, বাংলাতেই গাইতে হবে। কালক্রমে আমি সেই দক্ষতা গুরুদের কৃপায় অর্জন করেছি। কিন্তু ততদিনে আমার খেয়ালগুরু কালীপদ দাস আর নেই। আমার পিতৃদেব সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় নেই। কেউ-ই নেই।
পড়ুন আপন খেয়ালে-র প্রথম পর্ব: খেয়াল-ঠুংরি গাইতে গেলে কৃত্রিম বাংলা ভাষায় কেন গাইব?
আমি মনে করি যে, আমরা যারা বাংলা ভাষা জানি বা বাংলায় কথা বলি, যাদের বাংলা হল মাতৃভাষা, পিতৃভাষা, তাদের যদি খেয়াল শিখতে হয়, তাহলে বাংলাতেই শিখতে হবে। আমার অন্য কোনও ভাষার প্রতি কোনও বিরূপ মনোভাব নেই। কিন্তু নিজের ভাষাকে অগ্রাহ্য করে হবে না। আমার ভাষাতে খেয়াল হবে না, অন্য ভাষাতে হবে– এই ধরনের অযৌক্তিক কথা এবং নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ কথা কী করে বলি, অন্য লোকেরা কী করে বলেন, কে জানে! এক সংগীতশিল্পী তো একদিন আমার সঙ্গে তর্কই জুড়ে দিয়েছেন। তাঁর শ্বশুরমশাই, যিনি একজন বিখ্যাত সংগীতশিল্পী ছিলেন ক্লাসিক্যাল মিউজিকের এবং সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী মশাই নাকি ঠিক করেছিলেন, বেতারে বাংলা খেয়াল সম্প্রচারিত হওয়া নাকি আশ্চর্যের।
চার-পাঁচ বছর আগে, কোভিড তখনও আসেনি, আসব আসব করছে। আমি আমাদের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটা চিঠি লিখেছিলাম, আবেদন করেছিলাম। আমরা সহযোদ্ধা ছিলাম গণ আন্দোলনের, আমাদের পরিচয় ছিল। আমি তার ভিত্তিতে তাঁকে হাতে লেখা চিঠি পাঠিয়েছিলাম, তাতে লিখেছিলাম– মাননীয়া, আমি কিঞ্চিৎ নাম করেছি আধুনিক বাংলা গানে ও রবীন্দ্রনাথের গানে। কিন্তু আমি কিন্তু শিক্ষা পেয়েছি হিন্দুস্থানি খেয়ালে। পুরোদস্তুর, রীতিমাফিক। খেয়াল গাইতে পারি, গেয়ে থাকি। কিন্তু লোকের সামনে গাই না। আমি বাংলা ভাষায় খেয়াল রচনা করা শুরু করেছি বেশ কিছু বছর হল। সকলেই এটা জানেন যে, আমি আধুনিক গান রচনা করেছি। আমার প্রায় ২৫০০-এর ওপর বাংলা আধুনিক গান রচনা করা আছে। সেসব গান বিভিন্ন শিল্পী গেয়েছেন। যেমন শ্রীমতী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্রীমতী হৈমন্তী শুক্লা, শ্রীমতী সাবিনা ইয়াসমিন, শ্রীমতী ইন্দ্রাণী সেন, শ্রীমতী শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়। তেমনই শ্রীকান্ত আচার্য মহাশয় গেয়েছেন, নচিকেতা চক্রবর্তী মহাশয় গেয়েছেন, তেমনই অঞ্জন দত্ত মহাশয় গেয়েছেন। নবীন বা শিশুশিল্পীরাও গেয়েছেন। অনেকে অনেকে গেয়েছেন। আমার সংগীত পরিচালনা স্বীকৃতি পেয়েছে ভারত সরকারের। মোটামুটি একটি বড় পুরস্কার লাভ করেছি সৃজিত মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের ‘জাতিস্মর’ ছবির সংগীত পরিচালক হিসাবে। কাজেই সুর করা এবং লেখার দক্ষতা যে আমার আছে, সে বিষয়ে আশা করি অতি বড় শত্রুও সন্দেহ প্রকাশ করবেন না। সেইভাবেই আমি বাংলা খেয়াল রচনা শুরু করেছি বেশ কিছু বছর হল। আমার একটি গান আছে, ‘জাগে জাগে রাত, ভোর হবে বলে’, এটি আধুনিক গান হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবত ‘ইচ্ছে হল’ অ্যালবামে প্রকাশিত হয়েছিল এইচএমভি থেকে। এই গানটি খেয়াল বন্দিশে বাংলা গান, বাংলা ভাষায়। বাংলা ভাষায় খেয়ালের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ললিত রাগে, তিন তালে। এটা আগেও গেয়েছি, এখনও গাই, খেয়াল বন্দিশ হিসেবেই গাই। কাজেই তারপর আমি সমানে খেয়াল গান বা বন্দিশ বাংলা ভাষায় লিখছি। এখনও লিখে চলেছি। এখন পর্যন্ত আমার রচনা করা বাংলা ভাষায় খেয়ালের বন্দিশের সংখ্যা তেরোশো অতিক্রম করেছে। এগুলি আর্কাইভ করে রাখছেন আমার বন্ধু শ্রীমতী স্বপ্না মণ্ডল। স্বরলিপিও করে রাখছেন। আমার লেখা এবং তাঁর স্বরলিপি করা কিছু না হোক হাজার বারোশো বা এগারোশোর মতো বন্দিশ, বাংলা খেয়াল বন্দিশ এবং তার স্বরলিপি ‘সপ্তর্ষি’ প্রকাশন এবং ‘একতারা’ প্রকাশন থেকে সংকলন হিসাবে প্রকাশিতও হয়েছে। সেই সময় একটা বই বেরিয়েছিল ‘কাগজের ঠোঙা’ নামে একটি প্রকাশনী থেকে। সঙ্গে একটা সিডি ছিল। যেটা আমি গেয়ে দিয়েছিলাম। তারা সেটা সিডি সমেত প্রকাশ করেছিল। আমি শ্রীমতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানাই যে, আমি কিন্তু বাংলা খেয়াল রচনা করছি, প্লিজ আপনারা একটা অফিসিয়াল কমিটি বসান, আমার পরীক্ষা নিন, দেখুন, আমি ঠকাচ্ছি, নাকি আমার যোগ্যতা আছে– সেটা নিরূপণ করুন। এটা দাখিল করে জানালাম আমি বাংলা ভাষায় খেয়াল রচনা করছি। আমার সুযোগ দেওয়া হোক। কারণ, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের ভাষাই তো বাংলা, এটা এই রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাতেও ব্যবহার করা যাবে। কাজে লাগবে। নবীনদের তো বিশেষ করে। এখন উনি এবং তাঁর সরকার আমাকে চারটি বাংলা খেয়ালের কর্মশালা করার ব্যবস্থা করে দেন। অনুমোদন করেন চারটি। দু’টি হতে পেরেছিল কর্মশালা, আরও দু’টি হতে পারেনি। কোভিড এসে পড়ায়। সেই বাংলা খেয়াল কর্মশালায় অন্তত জনা তিরিশেক শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিলেন। এরপর কোভিড এসে পড়ল।
(চলবে)