১৯১১ সালে সান সেবাস্তিয়ানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সে সময়ের সবচেয়ে অভিজাত দাবা প্রতিযোগিতা। সকলেই ইউরোপীয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের কুলীন দাবাড়ু। গোল বাধল একজন তরুণ দাবাড়ুর অন্তর্ভুক্তি নিয়ে। অসিপ বার্নস্টাইন দাবি করলেন যে, দাবামহলে অপরিচিত এক বাইশ বছরের দাবাড়ু এমন অভিজাত প্রতিযোগিতায় খেলতে পারেন না। কার নির্দেশে এর কাছে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে? ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-র প্রথম পর্ব।
১.
“Incidentally, I might call attention to the fact that all the world’s champions of the last sixty years have been exceedingly strong in the endings: Morphy, Steinitz, and Dr. Lasker had no superiors in this department of the game while they held their titles.” Jose Raul Capablanca, Chess Fundamentals.
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে সর্বত্র এক ছন্নছাড়া অবস্থা। স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়েছে দীর্ঘদিন। ইউরোপের রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাকি মহাদেশগুলি বিপর্যস্ত। সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য, খেলাধুলো সবেতেই তার প্রভাব পড়েছে। দাবাতেও।
সেই ১৯১০ সালের পরে দীর্ঘ ১১ বছর দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়নি। ১৮৯৪ সালে ইমানুয়েল লাস্কার বিশ্বখেতাব ছিনিয়ে নিয়েছিলেন উইলহেম স্টেইনিৎজের থেকে। তারপর ১৯০৭ সালে ফ্রাঙ্ক মার্শালের প্রত্যাহ্বানের জবাব দিয়ে পরাজিত করেছেন। ১৯০৮ এবং ১৯১০ সালে দু’টি বিশ্বখেতাবি প্রতিযোগিতায় সিগবার্ট টারাশ এবং কার্ল স্কলেকটারকে হারিয়ে খেতাব ধরে রেখেছেন। মাঝে ১৯১৪ সালে সেন্ট পিটসবার্গ দাবা প্রতিযোগিতা। বিশ্বের সেরা ছ’জন দাবাড়ু-সহ মোট ১১ জন প্রতিযোগী। লাস্কার সেখানেও চ্যাম্পিয়ন। ততদিনে ধীর কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে উঠে আসছেন এক যুবক। এন্ড-গেমে তাঁর দক্ষতা অতুলনীয়। তিনি ইউরোপীয় নন, কিউবার দাবাড়ু। ১৯১৯ সালে অভিজাত হেস্টিংস দাবায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে সবক’টি গেম জিতে (একমাত্র বরিস্লাভ কস্টিচের সঙ্গে ড্র) চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন যুবকটি। মুকুটবদল কি তবে সময়ের অপেক্ষা?
১৯২১ সালে বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ের তারিখ চূড়ান্ত হল প্রাজ্ঞ ইমানুয়েল লাস্কার এবং যুবক প্রতিদ্বন্দ্বীর দ্বৈরথের। দ্বিতীয়বার খেতাবি লড়াই হবে ইউরোপের বাইরে– কিউবার হাভানায়। হাভানার দাবাপ্রেমীরা চাঁদা তুলে ফেলেছেন। এতদিন পরে লাস্কারের খেতাব তাঁদের প্রিয় যুবকটি ছিনিয়ে নিতে পারেন কি না, তা নিয়ে উৎসাহ তুঙ্গে। এর আগে ১৮৮৯ সালে স্টেইনিৎজ বনাম মিখাইল চিগোরিনের মধ্যে খেতাবি ম্যাচ এখানে হয়েছিল। অন্যদিকে লাস্কারের সঙ্গে রুবিনস্টাইনের খেতাবি লড়াই হওয়ার কথা থাকলেও, তা বাস্তবায়িত হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পোলিশ রুবিনস্টাইনের ব্যক্তিগত জীবনে দুর্যোগের ছায়া ফেলেছিল। তবে, ১৯২১ সালে বিশ্বখেতাবি প্রতিদ্বন্দ্বিতার যাবতীয় উত্তেজনা হঠাৎ ম্লান হয়ে গেল লাস্কারের শর্তে। লাস্কার হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন যে, যুবকটি নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি, তার সামনে মুকুট খুলে রাখাই শ্রেয়। আর, বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও কিছু টালমাটাল চলছে। লাস্কারের শর্তানুযায়ী, যুবকটি স্বীয় দক্ষতায় শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু হয়ে উঠেছে, তিনি চ্যালেঞ্জার হিসেবে খেতাবি লড়াই লড়বেন। ৫৩ বছরের প্রৌঢ় লাস্কারের খেলাতেও যেন সেই শক্তি নেই। যেন নিজের ছায়ার ভার বহন করছেন।
১৯২১ সালের এপ্রিল মাস। চোদ্দো নম্বর গেমে প্রতিরোধহীন পরাজয়ের পরে সরে দাঁড়ালেন বিশ্ব দাবার ইতিহাসে সবথেকে দীর্ঘ সময় খেতাবধারী ইমানুয়েল লাস্কার। লাতিন আমেরিকার দাবার ইতিহাস ঝলসে উঠল তাদের প্রথম বিশ্বজয়ীকে পেয়ে। এতদিনে, দীর্ঘ চড়াই-উতরাই পথ পেরিয়ে সিদ্ধিলাভ করল যুবকটি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
শতরঞ্জ কে খিলাড়ি-র দ্বিতীয় পর্ব: মন্ত্রী হতে আমি আসিনি, হয় দাবা খেলব, নয় ভেনেজুয়েলায় বিপ্লব আনব– বলেছিলেন চে গেভারা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
১৯১১ সালে সান সেবাস্তিয়ানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেই সময়ের সবচেয়ে অভিজাত দাবা প্রতিযোগিতা। টারাশ, ফ্রাঙ্ক মার্শাল, স্কলেকটার, গেজা ম্যারকজি, আকিবা রুবিনস্টাইন, অ্যারন নিমজোউইৎশ প্রমুখ তাবড় দাবাড়ুরা আমন্ত্রণ পেয়েছেন। সকলেই ইউরোপীয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের কুলীন দাবাড়ু। গোল বাধল একজন তরুণ দাবাড়ুর অন্তর্ভুক্তি নিয়ে। অসিপ বার্নস্টাইন দাবি করলেন যে, দাবামহলে অপরিচিত এক ২২ বছরের দাবাড়ু এমন অভিজাত প্রতিযোগিতায় খেলতে পারেন না। কার নির্দেশে এর কাছে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে? বাকিরাও কমবেশি সহমত বার্নস্টাইনের সঙ্গে। জানা গেল, সুদূর কিউবা থেকে তরুণটিকে আমন্ত্রণ জানাতে কমিটিকে সুপারিশ করেছিলেন ফ্রাঙ্ক জেমস মার্শাল। অমন ক্ষুরধার দাবাড়ু, যিনি আক্রমণাত্মক নীতির ধ্যানধারণা পাল্টে দিয়েছেন, তিনিই ওই তরুণের খেলায় মুগ্ধ? আসলে দু’বছর আগে নিউ ইয়র্কে ওই তরুণের অবিশ্বাস্য দাবাজ্ঞানে কিস্তিমাত হয়েছিলেন মার্শাল। সাত-সাতটা ম্যাচ হেরেছিলেন। প্রথমে অত গুরুত্ব দেননি, রাজি হয়ে গিয়েছিলেন খেলতে। ছেলেটি মাত্র ১৩ বছর বয়সে কিউবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হুয়ান কোর্যোকে হারিয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে এসে পড়াশোনা ছেড়ে দাবার ক্লাবগুলোয় গিয়ে সবাইকে হারাচ্ছে, এটুকুই শুনেছিলেন। ভাবতেও পারেননি পরপর অতগুলো খেলায় তাঁর শাণিত আক্রমণ ভোঁতা করে দিয়ে জিতে যাবে তরুণটি। পরের গেমগুলোয় খেলার নীতিকৌশল কিছুটা বদলেও তেমন সুবিধে করতে পারেননি, ড্র হয়েছিল বাকি গেমগুলিতে। মার্শালের সুপারিশে আমন্ত্রণ পেলেও নিমজোউইৎশ-স্কলেকটারের মধ্যে একটি অনুশীলন ম্যাচ চলাকালীন একটা দান নিয়ে মন্তব্য করায় বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়তে হল তরুণটিকে। অবশ্য সকলকে অবাক করে বার্নস্টাইনকে চুপ করিয়ে দিলেন সেই তরুণ প্রথম রাউন্ডেই। তারপর নিমজোউইৎশ, স্পিলম্যান, বার্নদের হারিয়ে এবং মার্শাল, তাইকমান, টারাশদের সঙ্গে ড্র করে সান সেবাস্তিয়ান প্রতিযোগিতা জিতলেন। একমাত্র পরাজয় আকিবা রুবিনস্টাইনের বিরুদ্ধে। উপর্যুক্ত সকলেই দাবার তাত্ত্বিক, তাঁদের নামে ওপেনিং রকমফের রয়েছে বা তাঁদের লেখা দাবার বই এখনও শিক্ষার্থীদের পাঠ্য। ২২ বছরের ওই তরুণের দাবাজীবনের মোড় ঘুরে গেল এই প্রতিযোগতার পরে। দাবাবিশ্ব জানল নতুন নক্ষত্রের উত্থান– হোসে রাউল ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা। ১৯২১ সালে লাস্কারকে পরাজিত করে দাবার নতুন যুগের সূচনা করলেন তিনিই। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে গেল বিশ্বখেতাব।
ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা (সাদা) বনাম ফ্রাঙ্ক মার্শাল (কালো)
1.e4 e5 2.Nf3 Nc6 3.Bb5 a6 4.Ba4 Nf6 5.O-O Be7 6.Re1 b5 7.Bb3 O-O 8.c3 d5 9.exd5 Nxd5 10.Nxe5 Nxe5 11.Rxe5 Nf6 12.Re1 Bd6 13.h3 Ng4 14.Qf3 Qh4 15.d4 Nxf2 16.Re2 Bg4 17.hxg4 Bh2+ 18.Kf1 Bg3 19.Rxf2 Qh1+ 20.Ke2 Bxf2 21.Bd2 Bh4 22.Qh3 Rae8+ 23.Kd3 Qf1+ 24.Kc2 Bf2 25.Qf3 Qg1 26.Bd5 c5 27.dxc5 Bxc5 28.b4 Bd6 29.a4 a5 30.axb5 axb4 31.Ra6 bxc3 32.Nxc3 Bb4 33.b6 Bxc3 34.Bxc3 h6 35.b7 Re3 36.Bxf7+ 1-0
দাবার ইতিহাসে এই খেলাটির বিশেষ এক গুরুত্ব রয়েছে। সাদা স্প্যানিশ ওপেনিং খেলেছে। কালো নিয়ে মার্শাল ৮ নম্বর দানে পন-d5 খেলেন। দানটি অদ্ভুত, কারণ কালো নিজের মাঝ-ছকের পন বলিদান দিচ্ছে। কিন্তু, এরপরেই কালো নিজের পিসগুলিকে অতিসক্রিয় করে আক্রমণ করবে সাদার রাজার দুর্গের দিকে। আশ্চর্য এই যে, এর আগে কোনও খেলায় এমন দান খেলা হয়নি। মার্শাল এটি উদ্ভাবন করলেন। ক্যাপাব্ল্যাঙ্কার কাছে ন’বছর আগে হারার বদলা নিতে মার্শাল নাকি দীর্ঘ গভীর গবেষণা করে এই রকমফেরটি উদ্ভাবন করেন। তারপর ক্যাপাব্ল্যাঙ্কার বিরুদ্ধে প্রথম প্রয়োগ করলেন এই লুকোনো অস্ত্রটি। আরও আশ্চর্য এই যে– ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা, যিনি আগে কোনও দিন এই রকমফেরটি অনুশীলন করেননি, তিনি বোর্ডে বসেই এর প্রতিষেধক বের করে ফেললেন। কালোর প্রবল আক্রমণ সামলে নিলেন। নিজের পিসের গতিবিধি সক্রিয় করলেন। আর, কালোর প্রত্যেকটি আক্রমণাত্মক মহড়ার পাল্টা আক্রমণের প্রতিরোধ খুঁজে নিলেন। উল্লেখ্য, মার্শাল গ্যাম্বিটের বিরুদ্ধে দাবাড়ুরা এখনও অস্বস্তিতে পড়েন। নির্ভুল প্রস্তুতি এবং অনুশীলন না থাকলে সাদার রাজা ল্যাজেগোবরে হয়ে যায়। কিন্তু ক্যাপাব্ল্যাঙ্কার মহত্ত্ব এখানেই যে, বোর্ডে বসে তৎক্ষণাৎ মার্শাল গ্যাম্বিটের প্রায়-নির্ভুল প্রতিরোধ উদ্ভাবন করেছিলেন, স্বয়ং মার্শালের বিরুদ্ধে।
ততদিনে নিমজোউইৎশের অতি-আধুনিক (hypermodern) দাবাতত্ত্ব আলোড়ন ফেলেছে। অবশ্য এই দাবাতত্ত্ব তৎকালীন দাবাড়ুদের খুব একটা পছন্দ ছিল না। ওপেনিং থেকেই পিস-পনের অবস্থানগত জটিলতায় ঢুকে যাওয়া এবং ধীরে ধীরে আধিপত্য বাড়িয়ে অবস্থানগত ফায়দা তুলে নেওয়ার নীতিকে অনেকেই রক্ষণাত্মক মনে করতেন। বেশ কয়েক দশক পরের দাবায় এই তত্ত্বই কী করে শীর্ষস্থানীয় দাবাড়ুদের প্রিয় হয়ে উঠবে, তা অন্য আলোচনার বিষয়। তবে, ক্যাপাব্ল্যাঙ্কাও কিন্তু এমন দাবানীতি পছন্দ করতেন না। বরং জটিল পজিশনকে উৎপাদক বিশ্লেষণের মতো সরল করতে করতে নিজের আধিপত্য বিস্তার করার অনায়াস দক্ষতা ছিল তাঁর। আর, এন্ড-গেম যেহেতু তাঁর সবচেয়ে শাণিত অস্ত্র, সেহেতু কীভাবে এন্ড-গেমে পৌঁছলে জয় সুনিশ্চিত হবে, সেই পরিকল্পনা মিডলগেমের শুরু থেকেই করতেন। মিডলগেমের কৌশলে দুর্দান্ত কম্বিনেশন খুঁজে বের করা কিংবা এন্ড-গেমের দক্ষতায় প্রতিপক্ষকে ছাপিয়ে যাওয়াই তাঁর মূল শক্তি। ক্যাপাব্ল্যাঙ্কার দুর্বলতা ছিল ওপেনিং-এ। নিজের বইতে মার্শালের বিরুদ্ধে খেলা গেমগুলির বিশ্লেষণে লিখেছিলেন যে, ওপেনিং-এ নিজের দুর্বলতাগুলি প্রথমবার বুঝতে শিখলেন। ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা নিজের সেরা সময়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ আক্রমণাত্মক দাবাড়ুদের সামলেছেন। নিখুঁত দানগণনার অদ্ভুত ক্ষমতা আয়ত্ত্ব করেছিলেন, তাই দুঁদে প্রতিপক্ষের প্রায়-নির্ভুল আক্রমণ সামলে জয়ের রাস্তা খুঁজে পেতেন।
কিউবায় দাবার ইতিহাস অনেক শতকের। ইউরোপীয় দখলদাররা উপনিবেশগুলিতে বিনোদনের রসদ নিয়ে যেত। কিউবা, আর্জেন্তিনা, মেহিকো-সহ অন্যান্য দখলীকৃত দেশে তারা দাবাখেলার প্রচলন ঘটিয়েছিল। মায়া ও আজটেক সভ্যতায় দাবার প্রাচীন কোনও রকমফের নাকি প্রচলিত ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিকরা তেমন কোনও নিশ্চিত প্রমাণ পাননি। দ্বিতীয়ত, আধুনিক দাবার সঙ্গে তার বিস্তর ফারাক ছিল। প্রাচীন ভারতে, পারস্যে ও মিশরে দাবার যে ক্রীড়াপদ্ধতি জনপ্রিয় ছিল, ইউরোপীয় দাবা তারই বিবর্তিত ফসল। তবে, প্রাচীন দক্ষিণ আমেরিকায় সেরকম নিদর্শন এখনও পাওয়া যায়নি। ইনকা শাসনের শেষ রাজাকে নিয়ে দাবার একটি মিথ প্রচলিত আছে। রিকার্ডো পামা তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন ঘটনাটি। স্পেনীয় ঔপনিবেশিকরা ইনকা রাজা আতাহুয়ালপা-কে পরাজিত করে এবং হত্যার আগে বেশ কয়েক মাস একটি ঘরে বন্দি রাখে। কয়েকজন স্পেনীয় সৈন্য এবং সেনাপতি ওই ঘরে দাবা খেলতেন। একটা এবড়োখেবড়ো কাঠের বোর্ড আর মাটি দিয়ে তৈরি ঘুঁটি। রাজা আতাহুয়ালপা-কে তাঁরা দাবা খেলা শেখান। রাজা দাবার নাম দেন ‘তাপ্তানা’ অর্থাৎ ‘চকিত আক্রমণ’। একদিন ক্যাপ্টেন হার্নান্দো আর ক্যাপ্টেন রিকেলমে যখন দাবা খেলছেন, তখন আতাহুয়ালপা রুকের একটি দান বলেন হার্নান্দোকে। সেই দানটি দেওয়ার কয়েকটি দান পরে রিকেলমে কিস্তিমাত হয়ে যান। আতাহুয়ালপার মুখে অমন দান-পর্যায় শুনে বিস্মিত হয়ে যান স্পেনীয়রা। রাজা এত ভালো দাবা শিখেছেন দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁরা রাজাকে খেলতে আহ্বান করেছিলেন। স্থানীয় অনেক মানুষের বিশ্বাস, আতাহুয়ালপা অমন নিখুঁত দান খুঁজে পেতেন বলেই হিংসায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন স্পেনীয় ঔপনিবেশিকরা। আর, তাঁর মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানায় যাঁদের সই ছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ক্যাপ্টেন রিকেলমে।
আধুনিক দাবা সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে দক্ষিণ আমেরিকার নগরগুলিতে প্রবেশ করে। জনপ্রিয় হয়। বহু দাবা ক্লাব গড়ে ওঠে। পল মরফি তাঁর দাবা-কেরিয়ারের মধ্যগগনে ১৮৬০ সালে কিউবাতে খেলতে গিয়েছিলেন। কিউবার তৎকালীন সেরা দাবাড়ু ফেলিক্স সিকরকে পরাজিত করেছিলেন স্প্যানিশ ওপেনিংয়ের বিরুদ্ধে নিজের উদ্ভাবিত মরফি-প্রতিরক্ষা সাজিয়ে। ১৮৮৫ সালে তৈরি হয়েছে হাভানা চেস ক্লাব, বহু বিখ্যাত দাবাড়ুর অনুশীলন-কেন্দ্র। প্রথম বেশ কয়েকটি বিশ্বখেতাবি প্রতিযোগিতা ইউরোপের বাইরে একমাত্র হাভানাতেই আয়োজিত হয়েছে। লাতিন আমেরিকার দাবা-ঘরানায় কিউবা বরাবরের মধ্যমণি– এর একটি কারণ যদি হন ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা স্বয়ং, তাহলে অপর কারণটি হল ১৯৫২ সালের আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতা। কিউবাতে তখন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে বাতিস্তা ক্ষমতা দখল করতে চলেছে। কিউবা তথা দক্ষিণ আমেরিকার রাজনৈতিক পালাবদলের আবহে তাবড় দাবাড়ুরা হাভানায় ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা স্মারক প্রতিযোগিতায় খেলতে এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের রেশেভস্কি, ল্যারি ইভান্স, হ্যারোয়িৎজ, এডওয়ার্ড লাস্কার, রুশি-গ্রিক নিকোলাস রসোলিমো, য়ুগোস্লাভিয়ার কিংবদন্তি গ্লিগোরিচ এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে একঝাঁক শীর্ষস্থানীয় দাবাড়ু অংশ নিয়েছিলেন।
রেশেভস্কির সঙ্গে যুগ্মবিজয়ী হলেন আর্জেন্তিনার মিগুয়েল ন্যাইডর্ফ। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে লাতিন আমেরিকার দাবাশিল্পের শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু। মিগুয়েল ন্যাইডর্ফ ইউরোপ, আমেরিকা, সোভিয়েতের সেরা দাবাড়ুদের সমকক্ষ তো বটেই, একইসঙ্গে তিনি একাধিক দাবাতত্ত্বের উদ্গাতা। দাবায় সিসিলিয়ান প্রতিরক্ষার ন্যাইডর্ফ শাখার তিনিই উদ্ভাবন করেন, আধুনিক দাবাড়ুরা এই শাখাটি নিয়ে এখনও গবেষণা করে চলেছেন নতুন রকমফের বের করতে। তাল, ফিশার, আনন্দ, ভ্যাশিয়ের-ল্যাগ্রেভের মতো শীর্ষস্তরের দাবাড়ুদের অন্যতম প্রিয় ওপেনিং সিসিলিয়ান প্রতিরক্ষার ন্যাইডর্ফ রকমফের। সাদা ঘুঁটি, কিং-সাইড দিয়ে আক্রমণ করলে রক্ষণাত্মক না খেলে কালো ঘুঁটি কুইন-সাইড দিয়ে পাল্টা আক্রমণ শানায়।
ন্যাইডর্ফের জন্ম হয়েছিল ওয়ারশ-তে। ১৯৩৯ সালে বুয়েনস আয়ার্সে দাবা-ওলিম্পিয়াড খেলার পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে স্বদেশে ফিরতে পারেননি। পরিবারকেও দেখতে পাননি আর; নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মারা গেছিলেন তাঁরা। ন্যাইডর্ফ আঁকড়ে ধরলেন দাবাকে– ওপেনিং আর এন্ড-গেমের তত্ত্বে গবেষণা করলেন।
ফিরে আসা যাক ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা স্মারক প্রতিযোগিতার গল্পে। প্রতিযোগিতা চলাকালীন আচমকা মারা গেলেন রবার্তো কেসেদা। যেদিন বাতিস্তা সেনা-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কিউবার ক্ষমতাদখল করল, তার আগের দিন অবধি রসোলিমো শীর্ষস্থানে ছিলেন। পরের তিনটি গেমে অবিশ্বাস্যভাবে হেরে গেলেন তিনি, ছিটকে গেলেন পুরস্কার তালিকা থেকে। ন্যাইডর্ফ আর রেশেভস্কি শেষ রাউন্ড অবধি ইস্পাতসম স্নায়ু ধরে রেখে জিতলেন। উল্লেখ্য, এই সময়েই যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত দাবা-বিশ্লেষক কেনেথ হার্কনেস বিজ্ঞানসম্মত রেটিং পদ্ধতির সূচনা করেন। পরের প্রায় দু’দশক বিশ্ব দাবাসংস্থা (FIDE) এই রেটিং পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক দাবাড়ুদের মান বিচার করত। কেনেথ গাণিতিক বিশ্লেষণ করে ন্যাইডর্ফ ও রেশেভস্কির রেটিং ধার্য করেন ২৭০০-র ওপরে। আধুনিক দাবায় যা ‘সুপার গ্র্যান্ডমাস্টার’ হিসেবে গণ্য হয়।
(চলবে)
তথ্যঋণ
এডওয়ার্ড উইন্টার, রিকার্ডো পামা, হোসে রাউল ক্যাপাব্ল্যাঙ্কার লেখা বই
চেস-ডট-কম, চেসড্রাম, চেসগেমস-ডট-কম, দ্যকিউবানহ্যান্ডশেক প্রভৃতি ওয়েবসাইট
হুয়ান ব্ল্যাঙ্কো, রায়ান কায়তানো, তালিয়া সেরভান্তেসের সাক্ষাৎকার