আজকের দিনে ‘অলক্ষ্মী’দের দেখা পাওয়া কিন্তু বড্ড সোজা। এদের উপস্থিতি পটে থাকে না। বাড়ির অন্দরমহলের মতোই, বাড়ির বাইরেও এদের সহজ উপস্থিতি। রান্নাঘরের গোবরাট আর সদর দরজার ঘুন ধরা কাঠ পেরিয়ে এরা পৃথিবীর নরম-গরম আলো খুঁজে নিয়েছে অনেকদিন আগেই।
‘লক্ষ্মী’ শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে গোলপানা ফরসা এক কমবয়সি মেয়ের মুখ। তার দু’চোখ জুড়ে মায়া আর অনুকম্পা। তার মুকুটের পাশ থেকে উঁকি দেওয়া চুলের রাশির ভার আর ছোট্ট থুতনির ওপরে ফোলা দুটো নিষ্পাপ ঠোঁট। তার এক হাতে ধরা কলসি। সেই কলসি থেকে উপচে নামে ধান। এক হাতে সে মেয়ে দিচ্ছে বরাভয়। যেন বলছে, আমি আছি তো, সব ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা করো না।
এই মেয়ের পায়ের কাছে নির্ভয়ে বসে থাকে বাধ্য প্যাঁচা।
এবার এসব কথা যার সম্পর্কে বলা, সে দেবী– ঠাকুর।
মানে, যাকে দিনক্ষণ দেখে পুজো করা হয়। এঁকে বাড়ির অন্দরমহলে ঠাকুরঘরে শুধু নয়, দেখতে পাওয়া যায় দোকানের ক্যাশবাক্সের আশপাশে, বাসে ড্রাইভারের সিটের সামনে, পটচিত্রে এবং অবশ্যই ক্যালেন্ডারে।
কিন্তু মুশকিলটা কী হয় জানেন, এই লক্ষ্মীকে, অনেকে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে হাড়েমাসে দেখতে চায়। আপনি একবার ডিপলি চিন্তা করুন তো, এটা কি মানা যায়? কী বলছেন? মানা যায়? না মশাই, আমি মানতে পারলাম না!
আগেকার দিনের ঠাকুরমাদের কাছে গল্প শুনেছি, বাড়ির মেয়েদের লক্ষ্মীমন্ত হওয়াটাই শ্রেয়। মানে লক্ষ্মী হওয়ার ‘ক্রাইটেরিয়া মিট’ না হলে সে মেয়েকে এক লহমায় ‘অলক্ষ্মী’ ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না।
আরও পড়ুন: যমরাজ পুজোর ছুটি পেতে পারেন শুধু কলকাতা পুলিশের সৌজন্যেই
আগেকার দিনে কিন্তু অলক্ষ্মী হওয়া সহজ ছিল। কোনও মেয়ে কিছু বিশেষ জিনিসপত্র করলেই তাকে ধমাশ করে অলক্ষ্মী উপাধিতে ভূষিত করা যেত, যেমন–
যে মেয়ে ধুপ ধুপ শব্দ করে পা ফেলে হাঁটে, সে অলক্ষ্মী।
যে মেয়ে ভিজে পা ফেললে, পায়ের দাগ মোটা হয়, সে অলক্ষ্মী।
যে মেয়ে বাইরে খেলাধুলো করতে ভালোবাসে, সে তো অলক্ষ্মী টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি!
এছাড়া শব্দ করে হাই তোলা, গাছে চড়া, মুখে শব্দ করে খাওয়া, আওয়াজ করে হাসা– এই সবই একজন অলক্ষ্মী ম্যাক্স প্রো হওয়ার লক্ষণ ছিল এককালে।
কিন্তু সময় বদলেছে। এখন জীবন আধুনিক হয়েছে অনেকটাই। তবু লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর মধ্যেকার জানি দুশমন টাইপ পার্থক্য মুছে যায়নি।
আজও বহু মা তাদের ‘বাবু’দের জন্য সুন্দরী, লেখাপড়া জানা, গৃহকর্মে নিপুণা পাত্রী খোঁজেন। মানে একটি সুন্দরী মেয়ে লেখাপড়া জানলেও তার মোক্ষলাভ তখনই হবে, যখন সে ভোরে উঠে নিখুঁতভাবে সংসারের ফাইফরমাস খাটতে পারবে।
আরও একটা কথা শুনি, যখন কোনও ছেলে বাড়ি থেকে দূরে চাকরি পায় এবং তাকে সেখানে থেকে কাজ করতে হয়। এই ছেলেদের মায়ের বান্ধবীদের নির্লজ্জের মতো নিদান হল, ‘ছেলের এবার বিয়ে দাও। বাড়ি ছেড়ে একলা আর কতদিন নিজের হাত পুড়িয়ে খাবে?’ অর্থাৎ, ডাকো ঘটক, খোঁজো ‘লক্ষ্মী’। রান্না করতে গিয়ে গৃহকর্মে নিপুণা ‘লক্ষ্মী’র হাত পুড়লেও চলবে, ওটা কোনও ব্যাপারই না!
মজার কথা হল, এই ধরনের ‘লক্ষ্মী’ কিন্তু আজও মেলে। তারা সংসারের ভাষায়, সাত চড়ে রা কাড়ে না। অর্থাৎ, এদের সঙ্গে অন্যায় হলেও এদের না আছে প্রতিবাদ, না আছে হালকা ফোঁস। থাকার মধ্যে থাকে শুধু নিভৃতে ফেলা কয়েক ফোঁটা চোখের জল। আদর্শ ‘লক্ষ্মী’ বলতে যা বোঝায় আর কী।
তবে আজকের দিনে ‘অলক্ষ্মী’দের দেখা পাওয়া কিন্তু বড্ড সোজা। এদের উপস্থিতি পটে থাকে না। বাড়ির অন্দরমহলের মতোই, বাড়ির বাইরেও এদের সহজ উপস্থিতি। রান্নাঘরের গোবরাট আর সদর দরজার ঘুণ ধরা কাঠ পেরিয়ে এরা পৃথিবীর নরম-গরম আলো খুঁজে নিয়েছে অনেক দিন আগেই।
ভিড়ে ঠাসা ট্রেনের মহিলা কামরায়, মিনি বাসের চিড়ে চ্যাপ্টা অন্দরে, সেক্টর ফাইভের ব্যস্ত বিপিওর ফ্লোর সরগরম রাখেন এই অলক্ষ্মীরাই।
এই অলক্ষ্মীদের অবশ্য অলক্ষ্মী বলার অনেক কারণ আছে। এরা অনেকেই শার্ট-প্যান্ট পরে অফিস যায়। অফিসে কাজের চাপে হালকা হতে হলে, এরা পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে অফিসের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অসভ্যের মতো সিগারেট ফোঁকে।
আরও পড়ুন: শুভ বিজয়ার নোনতামুখ
আপনি আর একবার ডিপলি চিন্তা করে দেখুন তো, এটা কি মানা যায়? জানতাম, বলবেন, মানা যায় না। বিতৃষ্ণা এসে গেল মশাই এসব দেখে! শুধু কি তাই? হাজার হোক মেয়ে তো? কোথায় কাজকম্ম সেরে সন্ধে সাতটার মধ্যে ঘরে ঢুকে পড়বে, তা নয়। ধিঙ্গিপোনা করে রাতবিরেতে সব বাইকে চেপে বাড়ির সামনে নামে। আবার একেক দিন একেক জন ছেলে নামিয়ে দিয়ে যায়, এমনই তাদের কাজের ঘনঘটা। উবের না কুবের, কীসব বাইক উঠেছে, ওগুলোই এই অলক্ষ্মীদের বাহন। এদের দেখলে সুস্থ মানুষের মুখ যে প্যাঁচার মতো হয়ে উঠবে, তাতে আর সন্দেহ কী!
এদের অনেকে তো আবার অফিসের পার্টিতে, তারপরে কলিগদের সঙ্গে হোটেলে-ফোটেলে গিয়ে পার্টিতে নেচে মদ-টদ খায় শুনেছি। শুধু তাই নয়, ইচ্ছে হলে পুরুষ সহকর্মী আর পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে দেখ তো না দেখ দিঘা-পুরী-গ্যাংটকও করে ফেলে।
এই সব মেয়ে নিজের টাকায় ইচ্ছেমতো চুলে রং করে, প্রেমিকের জন্মদিনে তাকে নিজের উপার্জনে উপহার দিয়ে ‘ঢং করে’, কেউ কেউ তো আবার বিয়ে না করে প্রেমিকের সঙ্গে একসঙ্গে থাকে! মানে থাকা-খাওয়া-শোয়া সব একসঙ্গে, শুধু বিয়েটা করবে না! অবশ্য এদের বিয়ে কেউ করবেই বা কেন? এদের বড় চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। সিনেমা হোক বা রাজনীতি, এই বিশ্বপাকা মেয়েগুলোর সব বিষয়ে মতামত আছে। ওই জন্য তো এরা ভালো প্রেমিকা হয়তো হতে পারে, কিন্তু ঘরোয়া বউ হতে পারে না।
হাজার হোক, অলক্ষ্মী তো!
পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বলতে বলতে তাঁর অশ্রুসজল চোখ দেখে শুধু সেই সময় নির্বাক হয়েছিলাম তা’ নয়, আজও তাঁর সেই চোখ দেখতে পাই, শুনতে পাই মানুষের প্রতি মানুষের বর্বরোচিত অত্যাচারের সেই গল্প বলতে বলতে তাঁর রুদ্ধ কণ্ঠস্বর।