আমরা বিশ্বাস করছিলাম, যত অবিশ্বাসের বাণিজ্য ফেনিয়ে উঠুক না কেন, যতই ঘৃণার মুনাফা বাজারমাত করুক না কেন, মানুষ, বিশেষত ঠিক পাশেই থাকা সাধারণ একজন মানুষ কখনওই তা মেনে নেবে না। তারা এই মানুষ-কারবারিদের প্রত্যাখ্যান করবে। ঠিক যেমন ইলিয়া এরেনবুর্গ শুনিয়েছিলেন প্রায় অসম্ভব এক বিশ্বাসের কথা– ‘যখন হিটলারের সৈন্য একটার পর একটা শহর অধিকার করে এগিয়ে আসছে, তখনও লালফৌজ ভাবছে জার্মানির শ্রমিক-কৃষক– যারা এই যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে– কখনও ফ্যাসিজমকে মেনে নিতে পারবে না। …জার্মান সৈনিকরা লুঠতরাজ করতে করতে এগিয়ে বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে আসছে, তখনও অনেকেই আন্তরিক ভাবে বিশ্বাস করছেন জার্মান সৈনিকরা এর বিরুদ্ধে যাবে।’ অথচ সময়ের মার এমনই যে ‘এই আশা নিমজ্জমান ব্যক্তির একটি তৃণকে অবলম্বন করার মতোই নিষ্ফল ছিল’।
একটা মস্ত সিংহ ছিল আমাদের। প্লাস্টার অফ প্যারিসের। হঠাৎ যদি ডাকাত পড়ে, কে বাঁচাতে পারে! সিংহটা যে সামনে ছিল, এই-ই বড় ভরসা। বোধহয় প্রশ্নও করেছিলাম, দস্যুর দল যাতে আমাদের অনিষ্ট করতে না পারে, সিংহটা সেই জন্যই আছে, না? কেউ কেউ উত্তর দিয়েছিল ‘হ্যাঁ’, হয়তো অন্যমনস্ক ভাবেই। মোটমাট এত গুরুতর একটা প্রশ্নে কেউ যে তেমন আপত্তি করেননি, এই ছিল ঢের স্বস্তির। যেমন নিশ্চিন্তে ছিল ইউরা। মোটে বছর সাতেক বয়স তার। বাড়ির সামনের রাস্তার ওপারেই ছিল চিড়িয়াখানা। আর সেখানে টিকিটঘরের সামনেই ছিল প্রকাণ্ড প্লাস্টার অফ প্যারিসের সিংহটা। ইউরা লজ্জায় সেভাবে বলে উঠতে পারেননি, তবে ওই সিংহের মূর্তিটাকেই তার সবথেকে ভালো লাগত। এবং মূর্তিটা যে ভিতরের ছাপোষা জন্তুজানোয়ারদের রক্ষা করবে, ডাকাত এলে রুখে দাঁড়াবে, এ-কথা সে নিশ্চিত জানত। তাছাড়া মাকে যখন এ ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসা করেছিল, তখন মা – অন্যমনস্ক হয়েই সম্মতি জানিয়েছিল। অতএব ইউরার মনে সিংহ সম্পর্কে কোনও দ্বিধা ছিল না, আমাদেরও।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: দেশ সেকুলার তবু শেষকৃত্য সেকুলার নয়
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আমাদের আপাত শান্তিকল্যাণের বাইরেও বসে থাকত একান্ত একটা সিংহ। তার পাহারায় নিশ্চিন্তেই থাকতাম আমরা। দ্বন্দ্ব, অমঙ্গলের ইতিবৃত্ত কম ছিল না। ইতিহাস ক্রমাগত চরকিপাক খায়। এক এক পর্বে এসে এক একরকমের অশান্তি ঘনিয়ে ওঠে। তবে মোটমাট এটুকু বিশ্বাস ছিল যে, দস্যুদল এলে রুখে দাঁড়ানো যাবে। কেননা বাইরে সিংহ তো বসেই আছে। তাছাড়া মানুষকে বিশ্বাস করা ছাড়া, মানুষের তেমন আর কোনও উপায়ও নেই। আমরা বিশ্বাস করছিলাম, যত অবিশ্বাসের বাণিজ্য ফেনিয়ে উঠুক না কেন, যতই ঘৃণার মুনাফা বাজারমাত করুক না কেন, মানুষ, বিশেষত ঠিক পাশেই থাকা সাধারণ একজন মানুষ কখনওই তা মেনে নেবে না। তারা এই মানুষ-কারবারিদের প্রত্যাখ্যান করবে। ঠিক যেমন ইলিয়া এরেনবুর্গ শুনিয়েছিলেন প্রায় অসম্ভব এক বিশ্বাসের কথা– ‘যখন হিটলারের সৈন্য একটার পর একটা শহর অধিকার করে এগিয়ে আসছে, তখনও লালফৌজ ভাবছে জার্মানির শ্রমিক-কৃষক– যারা এই যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে– কখনও ফ্যাসিজমকে মেনে নিতে পারবে না। …জার্মান সৈনিকরা লুঠতরাজ করতে করতে এগিয়ে বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে আসছে, তখনও অনেকেই আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করছেন জার্মান সৈনিকরা এর বিরুদ্ধে যাবে।’ অথচ সময়ের মার এমনই যে ‘এই আশা নিমজ্জমান ব্যক্তির একটি তৃণকে অবলম্বন করার মতোই নিষ্ফল ছিল’। আমাদের বিশ্বাসও ক্রমশ সেই নিষ্ফলতার দিকে দ্রুত এগিয়েছে। প্রথম যেদিন একটু একটু করে আমাদের উচ্ছিন্ন করা হচ্ছিল, ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের নামে ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল ক্ষুধার্ত ঘৃণার সামনে, আমরাও মনে করেছিলাম, এ বুঝি শুধুই উঁচুশ্রেণির লোকেদের তৈরি করা দাবানল। আমাদের চোখের সামনেই যখন ফেসবুক লাইভ করে জ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে দেওয়া হল, গুজবের চার ছড়িয়ে গণপিটুনির বঁড়শিতে গেঁথে ফেলা হল ভিনধর্মের মানুষকে, যথেচ্ছ চুরি-দুর্নীতি, মূল্যবোধের অপচয় আর মুল্যবৃদ্ধির ফাঁস যখন আমাদের গলা চেপে ধরছিল, সেদিনও আমরা ভেবেছিলাম মানুষ– সাধারণ মানুষ– কখনও এ জিনিস মেনে নেবে না। এমন বিশ্বাসও ছিল যে, যারা রুটিরুজির কারণে ভাই-বেরাদরের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরেছে সাময়িক, একদিন সময় এলে বিষণ্ণ সকলেই অস্ত্র প্রত্যাখ্যান করবে। ইউরার মতোই আমরা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম যে, বিশ্বাসের সিংহটা আমাদের পাহারাই দিচ্ছে। দস্যুরা এলে অনিষ্ট রুখতে প্রতিরোধ একটা হবেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: বিতর্কিত বিল পাস করানো উদ্দেশ্যেই কি রেকর্ড সংখ্যক সাংসদ বহিষ্কার?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সিংহটা তবু বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি। তখন যুদ্ধের দিন। ঘনঘন সাইরেন বাজে। বিস্ফোরণ হয় যখন-তখন। একদিন কাছাকাছি কোথাও হল। ইউরাদের ঘর কেঁপে উঠল। সেদিন বিস্ফোরণ হয়েছিল চিড়িয়াখানাতেই। আর আহত হয়েছিল প্লাস্টারের সিংহটি। তার পিছনের পা দুটো গিয়েছে গুঁড়িয়ে। সামনের থাবা খণ্ড-বিখণ্ড। একদিন যেন আমরাও সবিস্ময়ে খেয়াল করলাম যে, ভেঙেচুরে গিয়েছে আমাদের সিংহটাও। গণতন্ত্রের অন্তর্গত বোধগুলো ক্রমশ বিপন্ন হয়ে এলে আমরা শব্দ শুনি বিস্ফোরণের। নাকি জয়োল্লাসের! আমরা দেখি, ধর্ম এবং নিরপেক্ষতা ক্রমশ দূরত্ব বাড়াতে বাড়াতে বর্তমানে দুই মেরুর বাসিন্দা। সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদী প্রতাপ তাই পেয়ে গিয়েছে তার নিজস্ব মন্দির। সেইসব খবরের প্রপাত এসে প্রতি মুহূর্তে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের বহুত্বহীন একমাত্রিক বেঁচে থাকা। অতএব সহনশীলতার সহজপাঠগুলোও আমদের ক্রমশ ছেড়ে যেতে শুরু করেছে। সমানুভূতি যে এক ধরনের রাজনৈতিক চর্চাই ছিল এবং তা আবশ্যিক, এ-কথা আমাদের ক্রমশ ভুলে যেতে হচ্ছে। কেননা পেটের ভাতের থেকেও সাংস্কৃতিক বিপন্নতার কিল-ই এখন আলো করে বসে আছে রাজসভা। দিনে দিনে আমাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যও খর্ব হয়ে আসে। আমরা লক্ষ করি, ঔপনিবেশিকতার পোশাক ছাড়িয়ে দেশি পোশাক চাপিয়ে কঠোর হয়ে আসে দণ্ডবিধি। আর কে না জানে, মিথ্যে ভয় পেলে কামড়ে দেওয়ার বিধান তো সর্বযুগেই স্বীকৃত! অতএব চিঠিপত্র, ফোন, সোশাল মিডিয়া সবই উৎসর্গীকৃত হয়ে যায় সেই ‘ভয় পেয়ো না’-র অলৌকিক দেবাত্মার সামনে। পরিধি যত ছোট হয়ে আসে, মানুষও ক্রমশ বামনতর হয়ে ওঠে। গোটা বিশ্ব তাকে উপহার দেয় যুদ্ধের ক্ষত। এ-প্রান্তের ঘৃণা অন্য প্রান্তে প্রাণ নেয় দাঙ্গায়। দুর্নীতির, চুরির বাড়বাড়ন্তে তার ঘর যায়, মান যায়। হাতে থাকে শুধু খয়রাতির উত্তরোত্তর প্রতিশ্রুতি। সে জানে না তার গন্তব্য কী, অথচ রাস্তার ধারাল ইটে প্রতিদিন পথ চলতে গিয়ে সে বিক্ষত হতেই থাকে। আর বুঝতে পারে, সিংহটা এবার সত্যিই ভেঙে গিয়েছে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কিছুদিন পর বাড়ির পিছনের ব্যারিকেডে বিস্ফোরণের ঝাপটে অজ্ঞান ইউরাকে যখন ঘরে তুলে আনলেন তার মা, ছেলের পোশাক খুলতে গিয়ে পকেটে পেলেন ধূসর এক বাঁকা নখর। সেই সিংহের থাবা। ইউরা তুলে রেখেছিল পকেটে। আমাদের ভাঙাচোরা সিংহের নখর কে কোথায় যে তুলে রেখেছে, বোঝা যায় না। যে বিশ্বাসে একদিন মনে হয়েছিল মেনে নেওয়ার পালটা পথ ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে, তা মৃতপ্রায়।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সাত বছরের ইউরা খুব দুঃখ পেয়েছিল। যেদিন সিংহটা বিস্ফোরণে ভেঙে গেল, সেদিনও সে বিশ্বাস করেছিল যে, দস্যুদের সঙ্গে মূর্তিটা লড়াই করেছিল সিংহের মতোই। ইউরার মা তখন বুঝতে পারেননি কথাটা। বাড়িতে সেদিন এসেছেন এক ধুলোমাখা সৈনিক। তিনি শোনাচ্ছিলেন জার্মানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গল্প, ফ্রন্টের কথা। ইউরার মা জানতেন, সৈনিক তো সিংহের মতোই লড়বে। শুধু ইউরার কাছে সঙ্গোপনে থেকে গিয়েছিল তার বিশ্বাসের সিংহের নিজস্ব লড়াই। কিছুদিন পর বাড়ির পিছনের ব্যারিকেডে বিস্ফোরণের ঝাপটে অজ্ঞান ইউরাকে যখন ঘরে তুলে আনলেন তার মা, ছেলের পোশাক খুলতে গিয়ে পকেটে পেলেন ধূসর এক বাঁকা নখর। সেই সিংহের থাবা। ইউরা তুলে রেখেছিল পকেটে। আমাদের ভাঙাচোরা সিংহের নখর কে কোথায় যে তুলে রেখেছে, বোঝা যায় না। যে বিশ্বাসে একদিন মনে হয়েছিল মেনে নেওয়ার পালটা পথ ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে, তা মৃতপ্রায়। এমন কোনও বিশল্যকরণীর হদিশ নেই যে, মারের মুখের ওপর দিয়ে ফুল তুলতে পারে। অতএব মার-ই একমাত্র ধ্রুব, অন্তত এখন। সবকিছু সয়ে নিতে নিতে ধুঁকতে ধুঁকতে আমরা ক্রমাগত বেঁচে আছি। রাজনীতি, ধর্ম, চুরি, ঘৃণা, বিভাজন স্টিমরোলার চালাচ্ছে মাথায়-বুকে। আমরা জানি, এ বাঁচা দুর্বিষহ, এ খুব সুখের সময় নয়; তবু বুক ফাটে তো মুখ ফাটে না। বিশ্বাসের আর ভরসার ভাঙা সিংহটাকে এখন দেখে শুধু ভয়ই করে। ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার ভয়। মুখ বুঝে তাই সব সহ্য করে নেওয়াই দস্তুর। তবু আমরা মানুষ বলেই, শেষ অবধি ঘুরে দাঁড়ানোর আশাটুকুই সম্বল।
ব্যারিকেডে বিস্ফোরণে যেদিন অজ্ঞান হল ইউরা, জ্ঞান ফিরতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, থাবাটা সে তুলে রেখেছে বিশেষ একটা কথা মনে রাখার জন্য। ওটাই তার জমিয়ে রাখা স্মৃতিচিহ্ন। বছর ফুরিয়ে গেল। আমরাও কি এবার আতিপাতি খুঁজব না আমাদের ভেঙে যাওয়া সেই সিংহের থাবা? যেমন ইউরা খুঁজেছিল, জমিয়ে রেখেছিল একান্তে, দস্যুরা এলে প্রতিশোধ নেবে বলে।
ঋণ: ‘পরিচয়’ পত্রিকা ফ্যাসিস্টবিরোধী সংকলন।
নিকোলাই তিখনভের গল্প ‘দ্য লায়ন্স প’-এর অনুবাদ ননী ভৌমিকের, নাম ছিল ‘সিংহের থাবা’। এই লেখায় সেই গল্পের সূত্রগুলিই ব্যবহার করা হয়েছে।