মাধ্যমিকের প্রথম চন্দ্রচূড় বা উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় সৌম্যদীপ– তোমরা বেশ আমাদের থেকে আলাদা, এই যে শহরজোড়া ত্রিতালে হাঁটছে ছোট ছোট সবুজ, এরাই তো তোমরা, আমাদের বেঁচে থাকাকে যারা সবার অগোচরে শিল্পের নূপুর পরিয়ে দিয়েছ ! আর তাই চন্দ্রচূড়, সেদিন প্রথম হওয়ার পর, একটি সাক্ষাৎকারে যে অসামান্য বাংলা বলে আমাদের অভিভূত করলে, আমি নিজেও তো সেদিন শিখে নিয়েছি তোমার কাছে ‘সুকুমার’ শব্দটির অনবদ্য প্রয়োগ, তা শুনে প্রথমে আবিষ্ট হয়েছিলাম, কারণ কোন ফুলের সুবাস থেকে, কোন সুদূরের আগ্রহে আমাদের পৃথিবীতে এসে গেলে তোমরা এই ভেবে!
তুমি জানো এই মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে, আর তাই আজকাল বিকেলবেলার আকাশের নিচে বিন্দুর মতো হাঁটতে হাঁটতে, অসম্ভব ওপর থেকে দেখলে একটা পিঁপড়ের মতোই তো মনে হয় তোমাকে, তুমি নিজেকে এইভাবে ভাবতে গিয়ে দেখো– একদিকে তোমার নিজস্ব রাস্তা হেঁটে যাওয়ার, অন্যদিকে এই ক্রম-সম্প্রসারিত মহাবিশ্বের কাছে তোমার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্তিত্ব! কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বলেই তো তুমি জানো এমন অসীমকালের হিল্লোলের মধ্যে তোমার জেগে ওঠা মিথ্যে নয়, কারণ সেই জেগে ওঠার মধ্যে যে আছে, এক অনন্ত আর অপার বিস্ময়!
এমন বিস্মিত হতে কে শেখাল তোমায়? কেন? জীবনানন্দই তো লিখেছিলেন, আকাশের ওপারে আকাশ, বাতাসের ওপারে বাতাস! পাড়া-গাঁ’র কস্তা শাড়ি অথবা ভোরের দোয়েলপাখি কে চিনতে শিখিয়েছিল তোমায়? অথবা মোহিতলাল-বুদ্ধদেব-মধুসূদন? ভাবতে ভাবতে তোমার বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকো তুমি, তোমার পাশ দিয়ে সামনে-পিছনে দ্রুত ভেঙে পড়ছে, উড়ে যাচ্ছে সময়। কারওরই কি আর গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসার সময় আছে, বলো?
ভাবতে ভাবতে এই সেদিনও এসে পড়েছিল তাঁর জন্মদিন। সকালবেলায় চায়ের দোকানে তথাকথিত অসংস্কৃত মানুষের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে শুনছিলে মাইকের আওয়াজ, কেউ কিছু একটা ঘোষণা করছে, কিন্তু কী আশ্চর্য তুমি বুঝতেই পারছিলে না কেন এই অনুষ্ঠান, বুঝলে যখন, তখন তোমাকে ঘিরে ধরল এমন এক লজ্জা যে, বহুক্ষণ তুমি আর কথা বলতেও পারছিলে না। নিজেকে বলছিলে, তাহলে এমনও দিন এল যে, তুমি পঁচিশে বৈশাখ ভুলে গেলে! তবু দেখো সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে যেসব মানুষ গান শেখান, ম্লান একটা সাইকেল চড়ে যাঁরা লয় শেখান, যেসব মানুষজনকে আমরা মাস্টারমশাইয়ের মর্যাদা না দিয়ে বলি ‘ও আচ্ছা, গা-নে-র মাস্টার’ তাঁরাই তো শেষমেশ তোমাকে মনে করিয়ে দিতে পারলেন আজ পঁচিশে বৈশাখ! ওই তো গানের ইশকুলেই রবীন্দ্রজয়ন্তী!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তবু কী আছে আমাদের মাটিতে, আমাদের হাওয়ায় কোন আশ্চর্য উন্মাদনা আমাদের অন্ধকারকে এমন সবুজ করে রেখেছে যে আমাদের পাড়ায় পাড়ায় এখনও ফুটে উঠছে একটা আঁকা শেখার স্কুল, একটা বিয়োগ শেখার স্কুল! একটা সা-রে-গা-মা শুনতে পাই আজও, আজও আমাদের রাজ্যের প্রথম ছেলেটি অসামান্য বাংলাভাষায় কথা বলে আমাদের হতবাক করে দেয়, আমাদের সৌম্যদীপ আবৃত্তি করে ‘আমাদের সেই গ্রামের নামটি…’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যারা ইশকুলে পড়ে, খুব ভালো রেজাল্ট যাদের, তারাও আজ তাদের মায়ের আঙুল ধরে ছোট ছোট পায়ে হাঁটছে তোমার শহর জুড়ে, একটা গানের ইশকুল যাওয়ার জন্য, একটা নাচের ইশকুলে রবিঠাকুরের গানে নাচ করার জন্য! কোনও রাষ্ট্রব্যবস্থা, কোনও বৃহৎ পুঁজি বা কোনও হোমরাচোমরা শিক্ষাবিদ কিন্তু এঁদের পৃষ্ঠপোষক নন। আর তুমি এই দলে দলে মায়ের হাত ধরে শহর জুড়ে হেঁটে বেড়ানো সবুজদের দু’চোখ ভরে দেখে নিতে চাও। যদি কালই তোমার জীবন শেষ হয়ে যায়, এমন দৃশ্য কি আর দেখা হবে কখনও?
আর তাই মাধ্যমিকের প্রথম চন্দ্রচূড় বা উচ্চ মাধ্যমিকে দ্বিতীয় সৌম্যদীপ– তোমরা বেশ আমাদের থেকে আলাদা, এই যে শহরজোড়া ত্রিতালে হাঁটছে ছোট ছোট সবুজ, এরাই তো তোমরা, আমাদের বেঁচে থাকাকে যারা সবার অগোচরে শিল্পের নূপুর পরিয়ে দিয়েছ! আর তাই চন্দ্রচূড়, সেদিন প্রথম হওয়ার পর, একটি সাক্ষাৎকারে যে অসামান্য বাংলা বলে আমাদের অভিভূত করলে, আমি নিজেও তো সেদিন শিখে নিয়েছি তোমার কাছে ‘সুকুমার’ শব্দটির অনবদ্য প্রয়োগ, তা শুনে প্রথমে আবিষ্ট হয়েছিলাম, কারণ কোন ফুলের সুবাস থেকে, কোন সুদূরের আগ্রহে আমাদের পৃথিবীতে এসে গেলে তোমরা, এই ভেবে! কারণ আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থায় গালে হাত দিয়ে ভাবার সময় কই? আমরা আসলে কীভাবে বড় করতে চাইছি আমাদের পরের প্রজন্মকে, এই প্রশ্নে আলোড়িত যখন হই, তখনই ভিতর থেকে আমাকে কে যেন বলে গান শোনো, কবিতা পড়ো, ছবি দেখো, ‘সুকুমার’ শিল্পকলার সঙ্গে যুক্ত হও প্রকৃত প্রস্তাবে!
সত্যি আমরা শ্রেণিকক্ষে যে কবিতা পড়াই, তাতে কি বিরক্তিই আসে না ছাত্রছাত্রীদের? গাছের নিচে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিপাঠ বা বৃষ্টিতে ভিজতে চলে যাওয়ার পাগলামির কথা একজন পঁচিশে বৈশাখ যে ভেবেছিলেন, তাঁকে কী দিয়েছি আমরা? আমরা তাঁর ওই প্রকৃতিপাঠ বা শেখার অনন্ত পাগলামিকে মেরে ফেলেছি একটা মৃত প্রাণহীন ব্যবস্থা দিয়ে! শিক্ষার সমগ্রতা কি শিল্পচেতনা ছাড়া আসতে পারে কখনও? এই প্রশ্নে দীর্ণ তুমি দীর্ঘ একটি স্কুলবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকো! দেখো সেখানে তার শিক্ষায় আত্মীয়তা নেই, ভালোবাসার প্রাণস্পন্দন নেই ! শুধুই দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষা আর অর্থ-উপার্জনের হাতছানি!
অথচ এই যে দলে দলে বর্ষে বর্ষে যেসব কিশলয় সকালে-বিকালে রাস্তার পথ আলো করে সাইকেলে সাইকেলে টিউশন পড়তে যায়, সে কি নিষিদ্ধ করা একেবারে অসম্ভব ছিল? অন্তত বাচ্চাদের স্বার্থে? তার বদলে কি এইসব বিশাল স্কুল বিল্ডিংগুলিকে কি নাইট স্কুলে পাল্টানো যেত না? সেই সেশনে গান শেখানো যেত না, অন্তত কেউ শিখতে না চাইলে কীভাবে গান শুনতে হয়, সে-ও কি তাকে বোঝানো যেত না? আবৃত্তি-শিক্ষা, কবিতা পড়া বা ছবি দেখতেও যে আমাদের বেশিরভাগ পড়ুয়া জানে না! যদি জানত! যদি এমন সান্ধ্যকালীন বিদ্যালয় আমরা বানিয়ে ফেলতে পারতাম, তাহলে হয়তো কোনও গানের মাস্টারমশাইকে সারাজীবন একটা তাচ্ছিল্য আর অপমানের অন্ধকারে পথ হাঁটতে হত না!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: তরুণ প্রজন্মের তর্জনী কেন ভোটবিমুখ?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কিন্তু যেটা আশ্চর্যের আর বিস্ময়ের তা হল কোনও সরকারি বা বৃহৎ পুঁজির পৃষ্ঠপোষণা ছাড়াই আমাদের বেঁচে থাকাকে আর একটু বাড়িয়ে তুলছে এইসব গানের স্কুল আর তার সঙ্গে যুক্ত ম্লান গানের মাস্টারমশাইরা! আমাদের চতুর্দিকে ভয়াবহ রকমের অন্ধকার, এমনকী, একদিন কাগজে পড়লাম একটি ছেলে নাকি ভালোবেসেছে একটি কম্পিউটারাইজড প্রোগ্রামড মেয়েকে, দিনের পর দিন রাতের রাত তার সঙ্গেই নাকি সে গল্প করে আর তার সঙ্গেই নাকি সে বাকি জীবন কাটাতে চায়! আমাদের চতুর্দিকে মানুষের জায়গা নিচ্ছে যন্ত্র, মূলত আমরা যন্ত্রই কি তৈরি করে ফেলছি না, যখন আমাদের প্রশ্নপত্রের নির্দেশনায় লেখা থাকত ‘answer brief and to the point’!
তবু কী আছে আমাদের মাটিতে, আমাদের হাওয়ায় কোন আশ্চর্য উন্মাদনা আমাদের অন্ধকারকে এমন সবুজ করে রেখেছে যে আমাদের পাড়ায় পাড়ায় এখনও ফুটে উঠছে একটা আঁকা শেখার স্কুল, একটা বিয়োগ শেখার স্কুল! একটা সা-রে-গা-মা শুনতে পাই আজও, আজও আমাদের রাজ্যের প্রথম ছেলেটি অসামান্য বাংলাভাষায় কথা বলে আমাদের হতবাক করে দেয়, আমাদের সৌম্যদীপ আবৃত্তি করে ‘আমাদের সেই গ্রামের নামটি…’
এই মহাবিশ্ব ক্রম-সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত, একদিন হকিং বলেছেন, বেলুনের মতোই হঠাৎ ফেটে যেতে পারে আমাদের এই মহাবিশ্ব , কিন্তু তাহলেও ওই যে নাচের ইশকুলের ক্লাস থ্রি-র শাড়ি পরা ছোট্ট সরস্বতী তার গোলগোল হাতদু’টিতে, নাচের আগে, ঠিক করে নিচ্ছে ফুলের মালাটি, সে-ও কি হারিয়ে যাবে? নাকি হকিং-এর কথামতোই, কৃষ্ণগহ্বরে, থেকে যাবে তার স্মৃতি…
আর গানের ইশকুলের গানের মাস্টারমশাই? একটা ম্লান পাঞ্জাবি পরে ঘরে ঘরে শিখিয়ে বেড়ান যে তবলার শিক্ষক, রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর ‘বিশ্বের বাঁশির ছন্দ’ কি এসে যাবে তাঁর ছাত্রের হাতে? মহাবিশ্বেরও কি স্মৃতি আছে কোনও? সেখানে কি থাকবে আমাদের এইসব ভালো ছেলেমেয়ের গান আর আবৃত্তির সুর?