কার্লসেনের টেবিলে ঘুষি মারার ছবি আর ভিডিও-ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু ওই মানুষী দুর্বলতার পরে আত্মক্ষোভের হতাশার বহিঃপ্রকাশের পরেও কার্লসেনের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ শরীরীভঙ্গি রয়েছে। সেইটা ভাইরাল হয়নি। বলা ভালো, অহেতুক বিতর্ক চাগিয়ে-তোলা নেটিজেনরা তা ভাইরাল করেনি। কার্লসেন হল ছাড়ার আগে গুকেশের পিঠ চাপড়ে দিলেন। জেতা-ম্যাচ হারার যত হতাশাই থাকুক, প্রতিপক্ষকে সম্মান জানানো জরুরি। সেটা কার্লসেন ভোলেননি। গুকেশের চোখেমুখেও ছিল অপার বিস্ময়! অপ্রত্যাশিত জয়ের পরে হতবাক মুহূর্ত, বাকি সব আবেগ তার কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই আবেগের প্রকাশে জবরদস্তি আগ্রাসন খোঁজা আর সাংস্কৃতিক ভালো-মন্দ খোঁজা নিরর্থক।
ঘটনা ১
২০২০ সালের জুন। লকডাউনে সবকিছু স্তব্ধ। দাবার বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা হয় স্থগিত হয়ে গেছে, নয়তো অনলাইনে সরে এসেছে। বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ফিডে অনুমোদিত খেলায় শীর্ষস্তরের গ্র্যান্ডমাস্টাররা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তেমনই এক প্রতিযোগিতা চেসএবল মাস্টার্স। পুরস্কারমূল্য প্রায় ১.৫ লক্ষ ডলার। তবে, অনলাইন দাবা প্রতিযোগিতার সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, খেলা চলাকালীন কোনও দাবাড়ুর ইন্টারনেট সংযোগে আচমকা বিচ্ছিন্ন হলে সেই দাবাড়ুকেই ফল ভুগতে হবে। জেতা পজিশন থাকলেও তিনি হেরে যাবেন, কারণ ইন্টারনেটের সমস্যাটিকে তাঁর ‘ব্যক্তিগত’ সমস্যা হিসেবে দেখা হবে। লকডাউনের সময়ে আন্তর্জালে দাবা অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাশিয়া বনাম ভারতের খেলাতেও একই সমস্যায় পড়েছিলেন ভারতের দুই দাবাড়ু। তাঁদের ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যার প্রভাব খেলার ফলাফলে পড়ায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল।
যাই হোক, ২০২০ সালের চেসএবল মাস্টার্সের প্রথম সেমিফাইনাল ম্যাচ চলছে। এন্ডগেমের তুঙ্গ মুহূর্ত। রুক+পন এন্ডিং। আচমকা ডিং লিরেনের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ‘স্বাভাবিক’ নিয়মেই ওই রাউন্ডে বিজয়ী ঘোষিত হলেন প্রতিপক্ষ দাবাড়ু। ১-০। পরের রাউন্ডের খেলা শুরু হল। এবার ওই প্রতিপক্ষ দাবাড়ুটি কালো আর, ডিং সাদা। সবে দুটো দান দেওয়া হয়েছে। কালো নিজের কুইন সাদার কুইন আর বিশপের সামনে বসিয়ে দিলেন। ইচ্ছাকৃত। অপ্রত্যাশিত। ডিং কালোর কুইনটিকে খাওয়ার পরের দানেই প্রতিপক্ষ দাবাড়ুটি রিজাইন করে দিলেন। ১-১। আগের রাউন্ডে ডিংয়ের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় যে জয় প্রতিপক্ষটি পেয়েছিলেন, তা তাঁর মনঃপূত হয়নি। বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ডিংয়ের অসহায়তার সুযোগ নিতে চাননি তিনি। বলেছিলেন, ‘পরের রাউন্ডগুলো হেরে গেলে আমি আফসোস করতুম। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার ওটাই ঠিক মনে হয়েছিল। ডিংকে আমি খেলে হারাতে চেয়েছিলাম, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার সুযোগে নয়।’
সেমিফাইনালে ডিং তাঁর সেই প্রতিপক্ষ দাবাড়ুটির কাছে হেরে গেছিলেন। আর, ওই প্রতিপক্ষ দাবাড়ুই প্রতিযোগিতার সেরা হয়েছিলেন। বিশ্বব্যাপী দর্শক দেখেছিল একজন চ্যাম্পিয়নের মহৎ হৃদয়। শীর্ষ পর্যায়ের ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে সূচ্যগ্র জমি না-ছাড়ার যে রীতি, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’-র যে নীতি, তাকেই নস্যাৎ করে প্রকৃত বিজয়ীর বিজয় অর্জন করেছিলেন ওই দাবাড়ু।
ঘটনা ২
২০২১ সালের নভেম্বর। টাটা স্টিল দাবা প্রতিযোগিতা। র্যাপিড ও ব্লিৎজ দাবা প্রতিযোগিতা। বিশ্বের এবং ভারতের বাছাই দাবাড়ুদের নিয়ে প্রত্যেক বছর অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার রৌনক সাধওয়ানি কালো নিয়ে খেলছেন। প্রায় হেরে-যাওয়া ম্যাচ। ব্লিৎজ দাবা– তাই রৌনক এবং তাঁর প্রতিপক্ষ দু’জনেই দ্রুত দান ভাবছেন, খেলছেন। রৌনকের একটি নাইট এবং দু’টি বিশপ। প্রতিপক্ষের একটি রুক ও বিশপ এবং তিনটি সংযুক্ত পন। সাদার বিশপ আর রুক কালোর তিনটে পিসকে সামলাবে এবং সাদার অপ্রতিরোধ্য পনগুলি গুটিগুটি পায়ে কুইন হওয়ার দিকে এগোতে থাকবে। এই যুদ্ধনীতি যথাযথভাবে প্রয়োগ করে ম্যাচ জেতা সময়সাপেক্ষ, কিন্তু কঠিন না। বিশেষত প্রথম সারির একজন গ্র্যান্ডমাস্টারের কাছে তো নয়ই। অথচ সাদা সেই মুহূর্তেই একটা মোক্ষম কৌশলের ফাঁদে পড়ে গেল। বিশপ এফ-থ্রি। ওই পরিস্থিতিতে ওই একটিই ব্লান্ডার হতে পারত; এবং সাদা সেই ব্লান্ডারটাই দিল। ব্লান্ডারটা দেওয়ার পরেই হতাশায় এবং আত্মক্ষোভে সাদা ঘুঁটির দাবাড়ুটি হাত মুঠো করে টেবিলে ঘুষি মারল! দাবার বোর্ডসমেত পিসগুলো নড়ে উঠল। রৌনক সাধওয়ানি বিস্মিত চোখে প্রতিপক্ষের দিকে তাকালেন। অপ্রত্যাশিত আচরণে অবাক তিনি! তারপর চোখ নামিয়ে নিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে জেতার জরুরি কৌশল খুঁজে নিলেন। জেতার তীরে এসে তরী ডুবল সাদার। এমন পরাজয় দাবার যুদ্ধক্ষেত্রে অস্বাভাবিক না, কিন্তু তা মেনে নেওয়া খুব খুব কঠিন। নিজের ভুলের জন্য প্রতিপক্ষের আচমকা প্রত্যাঘাতে জেতা ম্যাচ হেরে যাওয়ার দুঃখ একজন ক্রীড়াবিদ বোঝেন। আর, সেই হতাশা তাঁকে বহু বহুদিন তাড়িয়ে ফেরে, বিনিদ্র রাখে। খেলার মাঝে টেবিলে ঘুষি মেরে পিস নড়িয়ে দেওয়া অশোভন, কিন্তু ওই মুহূর্তের আত্মগ্লানির বহিঃপ্রকাশ কিচ্ছুটি আর মানতে চায় না। প্রতিপক্ষ দাবাড়ুটি বিলক্ষণ জানতেন যে, তিনি রৌনকের থেকে ভালো দাবাড়ু এবং জেতার দোরগোড়ায় ছিলেন; তাই…
প্রথম ঘটনাটিতে ডিং লিরেনের প্রতিপক্ষের নাম ম্যাগনাস কার্লসেন (Magnus Carlsen)। আর, দ্বিতীয় ঘটনাটিতে রৌনক সাধওয়ানির প্রতিপক্ষের নাম গুকেশ দোম্মারাজু (D Gukesh)।
ঘটনা দু’টি উল্লেখ করার কারণ– অতিসম্প্রতি নরওয়ে ধ্রুপদী দাবা প্রতিযোগিতার (Norway Chess 2025) ষষ্ঠ রাউন্ডের ফলাফল এবং তৎপরবর্তী একটি বিশেষ মুহূর্ত। ওই মুহূর্তটি বিশ্ব ক্রীড়াজগতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু ম্যাগনাস কার্লসেনের বিপক্ষে বিশ্বখেতাবধারী গুকেশ দোম্মারাজু জিতে গেছেন। ষষ্ঠ রাউন্ডের খেলায়। এন্ডগেমে কার্লসেন একটি ব্লান্ডার দান দিয়ে যাবতীয় অ্যাডভান্টেজ খুইয়ে ম্যাচ হেরে যান। তারপরেই আত্মক্ষোভে ও হতাশায় টেবিলে ঘুষি মারেন। তাতে বোর্ডের পিস-পনগুলি নড়ে ওঠে। কিং পড়ে যায়। ম্যাচ হেরে অখুশি কার্লসেন গুকেশের সঙ্গে কোনওমতে করমর্দন করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে যান। অন্যদিকে গুকেশ অবিশ্বাস্য জয়ের অভিঘাতে বিমূঢ়; তারপরে তাঁর চোখে-মুখে বিস্ময় মিশ্রিত প্রশান্তি। সংবাদমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমের একাংশের বক্তব্য যে, তাঁর দৈহিক আচরণে প্রচণ্ড আগ্রাসন ও আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। বিজয়ী গুকেশের প্রতি বিশ্বের এক নম্বর দাবাড়ুর এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ অভূতপূর্ব এবং বিশ্বের এক নম্বর দাবাড়ুর পক্ষে অশোভন। সমাজমাধ্যমের ক্রীড়াবোদ্ধাদের একাংশ গুকেশের আচরণকে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ভারতীয় নৈতিকতার প্রতীক বলে তুলে ধরে কার্লসেনের পারিবারিক শিক্ষাদীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
কার্লসেন নাকি গুকেশের উত্থানে ভয় পেয়ে অমন আগ্রাসন দেখিয়েছেন তাঁর নাকি কোনও খেলোয়াড়ি মনোভাব নেই এবং তাঁর ক্রীড়ানৈপুণ্যের সময় শেষ হয়ে এসেছে। অন্যপক্ষের ক্রীড়াবোদ্ধারা গুকেশের জয়কে খাটো করতে ব্যস্ত। তাদের মতে গুকেশের এই জয় নেহাতই ভাগ্যের অবদান। গুকেশ ভাগ্যের সহায়তায় বিশ্বখেতাব জিতেছিলেন আর, তাঁর ক্রীড়াদক্ষতা কার্লসেন, কারুয়ানা, নাকামুরাদের থেকে অনেক কম। স্পষ্ট জানানো যাক যে, এই দু’ধরনের বোদ্ধাই ক্রীড়াদর্শনের জন্য ক্ষতিকর। এঁরা না বোঝেন ক্রীড়া, না জানেন একজন ক্রীড়াবিদের শ্রম ও আবেগ। এরা হঠাৎ জেগে-ওঠা জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতিকে ফাঁপিয়ে তুলতে চায়, এরা খেলার সারবস্তু ভুলে মনগড়া গালগপ্পো ফেঁদে জনতোষী হতে চায় এবং এরা ক্রীড়াক্ষেত্রের ক্ষতিকর বৈষম্যগুলিকে জিইয়ে রাখতে চায়।
উল্লেখ্য, গত বছর নরওয়ে দাবা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় রাউন্ডে প্রজ্ঞানন্দ ম্যাগনাস কার্লসেনকে হারিয়েছিলেন। কার্লসেন ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন প্রজ্ঞানন্দকে। প্রজ্ঞানন্দ সেই গেমে আশ্চর্য দাপট দেখিয়েছিলেন। সিসিলিয়ান ডিফেন্স। কার্লসেন তাঁর অনুশীলন আর তত্ত্বের প্রয়োগে সিসিলিয়ান ডিফেন্সের অনেকগুলি রকমফেরের খোলনলচে বদলে দিয়েছেন। সেই সিসিলিয়ান ডিফেন্সে কালো নিয়ে পলসেন রকমফের খেলেছিলেন কার্লসেন। ঝুঁকিপূর্ণ রকমফের। কারণ এতে সামান্য সময়ের হেরফেরে পিস-পনের অবস্থান এবং আক্রমণের গতিমুখ বদলে যায়। নাকামুরা অকপটে বলেছিলেন, ‘কার্লসেন আমার বা ফ্যাবির বিরুদ্ধে কেন যে এসব ঝুঁকির ওপেনিংগুলো খেলে না, কে জানে!’
প্রজ্ঞানন্দ কার্লসেনকে ঝুঁকি নিতে দিচ্ছিলেন। ২০ নম্বর দান অবধি শুধু নিজের ব্যূহ নির্মাণ করছিলেন প্রজ্ঞা, যাতে কার্লসেন সেই ব্যূহে ফাটল না ধরাতে পারেন। ২৪ নম্বর দান থেকে প্রজ্ঞার কুইন আর রুক আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। কার্লসেন এরপরে প্রতিটি পরিকল্পনায় পিছিয়ে পড়ছিলেন। পজিশনাল নীতি থেকে কৌশলী দানগণনা– প্রজ্ঞা ক্রমশ নির্ভুল দানের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠছিলেন। খেলার শেষে প্রজ্ঞার অ্যাকুরেসি ছিল প্রায় ৯৭%! আর, কার্লসেনের ৯০%। কার্লসেনের একটি আস্ত রুককে অকেজো করে দিয়ে জিতেছিলেন প্রজ্ঞা। সর্বাত্মক জয়– সোজা ভাষায় কার্লসেনের থেকে ভালো খেলে কার্লসেনকে হারিয়েছিলেন প্রজ্ঞানন্দ। ম্যাচ হেরে কার্লসেন প্রজ্ঞানন্দর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলোচনা করেছিলেন, কোথায় কীভাবে ভুল হল খুঁজতে চাইছিলেন। অকপটে প্রজ্ঞানন্দর দাবামেধার গুণগান করেছিলেন। ভেতরে ভেতরে পরাজয়ের জ্বালায় পুড়ে গেলেও ওই হার মেনে নিতে তাঁর দ্বিধা ছিল না। এই প্রতিযোগিতার পরে কার্লসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ভারতের এই তরুণ দাবাপ্রজন্ম মারাত্মক শক্তিশালী। যে কোনও প্রতিপক্ষকে দুরমুশ করে দেওয়ার জন্য সদাপ্রস্তুত। গুকেশ গণনা-নির্ভর খেলে, প্রজ্ঞাও দারুণ দানগণনা করে, তবে ইনট্যুইশনে ভরসা রাখে। আর, অর্জুন এরিগাইসি সম্বন্ধে কিচ্ছুটি আগাম আঁচ করা যায় না। বোর্ডে প্রতিপক্ষকে ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য যা-খুশি পরিকল্পনা করতে পারে।’
#
২০১৩ সালে কার্লসেন বনাম বিশ্বনাথন আনন্দের বিশ্বখেতাবী লড়াই এক নতুন দাবাযুগের সূচনা। ২২ বছরের কার্লসেন, যাঁকে অসম্ভব সমীহ করেন, সেই আনন্দের থেকেই খেতাব ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। কার্লসেন বিশ্বখেতাবী লড়াইয়ের শুরুর পর্যায়ে আনন্দকে অতিমানব ভেবেছিলেন, যে দাবাড়ু কোনও সাধারণ ভুল করতেই পারেন না, যে দাবাড়ু দুর্ভেদ্য প্রস্তুতি নিয়ে বিশ্বখেতাবী লড়াই শুরু করে প্রতিপক্ষকে দাঁড়ানোর সুযোগই দেবে না। পরে স্বীকার করেছিলেন যে, ‘আনন্দ এবং অন্য যে দাবাড়ুদের বিপক্ষে খেতাবী লড়াই লড়েছি, তাঁদের প্রত্যেকের প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ের ছিল, কিন্তু ক্রমশ বুঝেছিলাম যে ভুল তাঁদেরও হয়। খুব সাধারণ মানের কোনও অপ্রত্যাশিত ব্লান্ডার কিংবা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সঠিক ব্যূহরচনার কৌশল ভুলে যাওয়ার মানুষী দুর্বলতা তাঁদেরও আছে।’
ঠিক এই কথাগুলোই মনে রাখা জরুরি ম্যাগনাস কার্লসেনের দাবাপ্রজ্ঞার ক্ষেত্রে। চার রকমের দাবায় (ধ্রুপদী, র্যাপিড, ব্লিৎজ এবং ফিশার-র্যান্ডম) তিনি অতুলনীয়, সেরার সেরা। কিন্তু, ভুল তাঁরও হয়। অপ্রত্যাশিত ব্লান্ডার তাঁর রথের চাকা মাটিতে বসিয়ে দিতে পারে। প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা বুঝতে সামান্য ভুল তাঁর ব্যূহরচনায় ধ্বস নামাতে পারে। আর, এটা শুধু ম্যাগনাস কার্লসেন না, বিশ্বের যে কোনও ক্রীড়াবিদের ক্ষেত্রেই সত্যি। পরিকল্পনার ভুলে সহজ ম্যাচ কঠিন হয়ে যায়। নীতিপ্রয়োগের সংশয়ে অ্যাডভান্টেজ কমে যেতে থাকে। মুহূর্তের ভুলে ম্যাচের ফলাফল বিয়োগান্তক হয়। বিশ্বের যে কোনও ক্রীড়ায় এমনটাই হয়। অনিশ্চয়তা দাবার শেষ দান অবধি, ক্রিকেটের শেষ বল পর্যন্ত, ফুটবলের শেষ বাঁশি বাজার মুহূর্ত পর্যন্ত, টেনিসের শেষ সার্ভিসের আগে পর্যন্ত থাকে। আর, এই অনিশ্চয়তার রোমাঞ্চই ক্রীড়ার সৌন্দর্য। অনিশ্চয়তা রোম্যান্টিক। দর্শকের বুকের ধুকপুকানি বাড়তে থাকে। ক্রীড়াপ্রেমীর মন আর মস্তিষ্কের দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। এইসব রোম্যান্টিক অনিশ্চয়তার মুহূর্তে যে খেলোয়াড় পিছিয়ে রয়েছে, তার ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে কি শেষ বাঁশি বাজার আগেই হাল ছেড়ে দিচ্ছে? সে কি পরাজিত অস্তিত্ব মেনে নিয়ে দানগণনা বন্ধ করে দিচ্ছে? সে কি অমিতবিক্রমী প্রতিপক্ষের ব্যূহ ভাঙার কৌশলরচনা থামিয়ে দিচ্ছে? সে কি একটা অবিশ্বাস্য মুহূর্ত, একটা ম্যাজিক-দানের জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য হারিয়ে ফেলল?
প্রত্যেক ক্রীড়াবিদের জীবনে এমন এক অপেক্ষার চরম মুহূর্ত আসে। প্রায়-হেরে-যাওয়া ম্যাচেও শত্রুর একটা ভুলের জন্য, নিজের একটা ম্যাচ-জেতানো ভলির জন্য অপেক্ষা। শুধু অপেক্ষা না। সেই অপেক্ষার তাগিদ জরুরি। জেতার তাগিদ, জেতার খিদে। গুকেশ বনাম কার্লসেন– নরওয়ে দাবা প্রতিযোগিতার তৃতীয় রাউন্ডের ম্যাচ– এই অপেক্ষা, তাগিদ আর একটা মানুষী ভুলের ত্র্যহস্পর্শে ঘটে যাওয়া ম্যাজিক দেখিয়ে দিল। ম্যাগনাস কার্লসেন প্রায় জিতে-যাওয়া গেমে একটা ব্লান্ডার দিলেন। গেমের নিয়ন্ত্রণ প্রথম থেকেই ম্যাগনাসের হাতে ছিল। রুই লোপেজ ওপেনিং– বার্লিন ডিফেন্স। কপিবুক খেলা তথা ওপেনিং তত্ত্ব মেনে দানপর্যায়। গ্যারি কাসপারভের বিরুদ্ধে বার্লিন ডিফেন্সকে অতি-কার্যকর অস্ত্র বানিয়ে তুলেছিলেন ভ্লাদিমির ক্রামনিক। পরবর্তী দু’-দশকে ম্যাগনাস কার্লসেন সেই বার্লিন ডিফেন্সকে আরও শাণিত করেছেন। বদ্ধ মাছকে নাইট-বিশপ মহড়া দেবে। আর, ওপেন বা আধা-ওপেন ফাইলের অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করবে রুক। এই তো নীতি। সাবধানী ব্যূহ রচনা। ৩০ দানের পরে কার্লসেনের অ্যাকুরেসি ৯৮.৭%! মিডল গেমের শেষ পর্যায়ের খেলা শুরু হবে। এরপরে এন্ডগেম। কালো সাদার পন-কাঠামোর দুর্বলতা খুঁজে খুঁজে অ্যাডভান্টেজ আরও বাড়িয়ে নেবে। সাদার মাঝছক ভাঙবে। কার্লসেন সেটা ভাঙলেনও। গুকেশ তখন মরিয়া প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন। ডাবল রুক+নাইট আর ভাঙা মাঝছক দিয়ে অপ্রতিরোধ্য পন। দাবার একটা প্রাচীন প্রবাদ আছে– যখন তুমি জিতছ, তখন পজিশনকে আরও সরল করে দাও। আর, যখন হারছ, তখন পজিশনটা বিচ্ছিরি রকমের জটিল করে দাও। কার্লসেন কি এই চিরন্তন প্রবাদকে অস্বীকার করতে চাইলেন?
গ্র্যান্ডমাস্টার রাফায়েল লেইতাও যথার্থ বলেছেন, ‘যে পজিশন পেলে কার্লসেন আরও নির্মম নিষ্ঠুর হয়ে প্রতিপক্ষকে সামান্যতম সুযোগও দেন না, সেইরকম পজিশনে কার্লসেন গুকেশকে এত সুযোগ দিচ্ছেন কেন? কার্লসেন এই পজিশন থেকে জিততে দেরি করছেন, এটাই আশ্চর্যের!’ কার্লসেনের সংশয়, কার্লসেনের পরিকল্পনার দ্বিধার সুযোগ নিলেন গুকেশ। কার্লসেনের জেতার মুহূর্ত যত পিছতে থাকল, তত বেশি অক্সিজেন পেল গুকেশের প্রতিরোধ। শেষে ৫২ নম্বর দানে কার্লসেন খেললেন Ne2+। গুকেশের অপেক্ষা আর হার-বাঁচানোর তাগিদ এতক্ষণে ডানা মেলল। গুকেশের স্নায়ুর জোর আর লড়াকু মানসিকতা মর্যাদা পেল। এরপরে কার্লসেনের টেবিলে ঘুষি মারার ছবি আর ভিডিও-ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু ওই মানুষী দুর্বলতার পরে আত্মক্ষোভের হতাশার বহিঃপ্রকাশের পরেও কার্লসেনের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ শরীরীভঙ্গি রয়েছে। সেইটা ভাইরাল হয়নি। বলা ভালো, অহেতুক বিতর্ক চাগিয়ে-তোলা নেটিজেনরা তা ভাইরাল করেনি। কার্লসেন হল ছাড়ার আগে গুকেশের পিঠ চাপড়ে দিলেন। জেতা-ম্যাচ হারার যত হতাশাই থাকুক, প্রতিপক্ষকে সম্মান জানানো জরুরি। সেটা কার্লসেন ভোলেননি। তাঁর হাতের ভঙ্গিতে ক্ষমা চাওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। ওই বোর্ড আর পিস-পনের কাছে, দাবার কাছে। বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ তা ভোলেননি। আর, গুকেশের চোখেমুখেও ছিল অপার বিস্ময়! অপ্রত্যাশিত জয়ের পরে হতবাক মুহূর্ত, বাকি সব আবেগ তার কাছে ম্লান হয়ে যায়। তেমনই অপ্রত্যাশিত হারের যন্ত্রণার কাছে দুনিয়ার সব আনন্দ ক্ষণিকের জন্য মৃত। ক্রীড়াবিদ মাত্রেই এই আনন্দ আর যন্ত্রণার স্বাদ জানেন। এই দৃশ্যে, এই আবেগের প্রকাশে জবরদস্তি আগ্রাসন খোঁজা আর সাংস্কৃতিক ভালো-মন্দ খোঁজা নিরর্থক।
একইসঙ্গে এই ম্যাচের পরে যারা গুকেশের দক্ষতা ও মেধা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁকে খাটো করতে চাইছেন, তাঁরাও কম অপরাধ করছেন না। গুকেশ ভাগ্যের জোরে বিশ্বখেতাব জেতেননি কিংবা কার্লসেনকে ধ্রুপদী দাবায় ভাগ্যের সহায়তায় হারাননি। ক্রীড়াবিজ্ঞান মেনেই তাঁর জয়। দাবায় ভাগ্য বলে কিচ্ছু হয় না। প্রতিটি দান তত্ত্ব আর গণনার মিশ্রণ। একটি গেমে ভালো পজিশনে পৌঁছতে যেমন দক্ষতা প্রয়োজন, তেমনই খারাপ পজিশনকে স্থিতিশীল রেখে প্রতিপক্ষের কৌশল ব্যর্থ করার জন্যও দক্ষতা প্রয়োজন।
বিশ্বখেতাবী লড়াইয়ের আগে ক্যান্ডিডেটসে গুকেশ সাতজন সেরা দাবাড়ুকে পিছনে ফেলেছেন। ডিং লিরেনের বিপক্ষে ভুল করেছেন, কিন্তু শুধরে নিয়েছেন সেই ভুল। মানসিক দৃঢ়তায় ছাপিয়ে গেছেন তাঁকে। তাঁর শ্রম আর মেধা পুরস্কৃত হয়েছে। নরওয়ে দাবার ষষ্ঠ গেমে ৩২ নম্বর দান পর্যন্ত কার্লসেন যতটা সেরা, তারপর থেকে শেষ দান অবধি গুকেশ ঠিক ততখানিই সেরা। গেমটা হেরে যাওয়ায় কার্লসেনের এযাবৎ কৃতিত্ব একটুও খাটো হয় না। আর, গেমটা জেতার জন্য গুকেশের স্নায়ুর জোর এবং একাগ্রতা বাহবা পায়। ভারতীয় দাবাকে পাকাপাকিভাবে ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা দিচ্ছেন গুকেশ, অর্জুন, প্রজ্ঞানন্দ, অরবিন্দ, নিহালরা। কতিপয় ক্রীড়াশত্রুর সংকীর্ণ মানসিকতায় এই কৃতিত্বে দাগ লাগে না।
#
এইবার এই প্রতিযোগিতারই অন্য একটা গেম নিয়ে দু’-চারকথা বলা যাক। প্রতিযোগিতার প্রথম গেম। সেখানেও গুকেশ এবং কার্লসেন মুখোমুখি হয়েছিলেন। কালো নিয়ে খেলেছিলেন গুকেশ। মাত্র ৪ নম্বর দানেই চেনা ওপেনিং তত্ত্ব ছেড়ে বিরল একটি দান দিয়েছিলেন। বোঝা গেছিল যে, গুকেশ ওই রকমফেরে প্রস্তুতি নিয়েছেন। কিন্তু কার্লসেন প্রস্তুত ছিলেন না। তা সত্ত্বেও স্বীয় দাবামেধা দিয়ে গুকেশের পরিকল্পনা আটকেছিলেন কার্লসেন। এখানেও ডাবল রুক+নাইট এন্ডগেম এসেছিল। গেমটায় ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছিলেন কার্লসেন। তবুও ড্র হতেই পারত, যদি না অপ্রত্যাশিত ভুলটা করতেন গুকেশ। ৪৬ নম্বর দানে ধৈর্য হারিয়ে Qh6+ দিলেন গুকেশ। সেখান থেকেই নিখুঁত দানগণনায় নিজের দিকে খেলা ঘুরিয়ে দিলেন কার্লসেন। ডেভিড হাওয়েল বললেন, ‘বছরের সেরা গেম এটাই!’ গুকেশ বহুক্ষণ গেম সমান-সমান রেখেছিলেন। এমনকী ঝুঁকিও নিয়েছিলেন। গেম থেকে ফলাফল নিংড়ে বের করার এবং প্রতিপক্ষকে শেষ সীমায় ঠেলে নিয়ে যাওয়ার জেদ দু’জনেরই ভরপুর ছিল। কার্লসেন গেমের পরে বলেছিলেন, ‘আমি সর্বশক্তি দিয়ে দানগণনা করছিলাম। গুকেশের দানগণনার ক্ষমতা কী দুর্দান্ত, তা জানি। সেইজন্যেই বারবার হিসেব করছিলাম কোথাও যেন ভুলচুক না হয়ে যায়।’
যারা ষষ্ঠ গেমে কার্লসেনের আচরণকে গুকেশের প্রতি অসম্মান হিসেবে দেখছেন কিংবা কার্লসেন গুকেশকে হেয় করেন এমনটা বলছেন, তাঁরা হয়তো এই প্রথম গেমটা দেখেননি। গুকেশকে হারানোর পরে কার্লসেনের চোখেমুখে প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপভোগ করার তৃপ্তিটুকু দেখেননি। ক্রীড়াবিদের জীবনে ওতঃপ্রোত এগুলো। এসব আবেগ, এরকম অনিশ্চয়তা, এরকম অবিশ্বাস্য জয়-পরাজয় এবং এসব শীর্ষস্তরীয় নৈপুণ্য আছে বলেই ক্রীড়া উপভোগ্য। খামোকা ফাঁপা সাংস্কৃতিক অহং, সারবস্তুহীন ব্যক্তিগত গপ্পোগাছা আর বৈষম্যের বয়ান দিয়ে ক্রীড়াক্ষেত্রকে দূষিত করা খুব প্রয়োজন কি?
………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
………………………………