বাভুমা জিতেছেন। জিতিয়েছেন। নিজে, নিজের দেশকেও। তাঁর মতো এমন অনেক কৃষ্ণাঙ্গকে, যাঁদের জন্মাবধি বর্ণবিদ্বেষের শিকার হতে হয়েছে, তাঁদের জেতালেন সাদা পোশাকের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে। বাভুমার এই জয়, অবশ্যই শক্তি জোগাবে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ার, স্বপ্ন দেখাবে এক নতুন ঘৃণাহীন দেশের, মানসিকতার। কিন্তু শুধু এই জয় কি অতটা পারে? বাভুমা যা ক্রিকেটে করলেন, তা অন্যান্য পরিসরে, বিশ্বজুড়ে না ঘটলে এই বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের জয়ের স্মৃতিতেও পলি পড়ে যাবে।
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি হাতে তেম্বা বাভুমার মুখ বোধহয় এই জন্মের অন্যতম সেরা স্মৃতি হয়ে রইল। এক সংগ্রামী যোদ্ধার জয়টীকা লাভের হাসি। এ শুধু বিশ্বজয় নয়, রাজার খেলায় সব থেকে শুদ্ধ ফরম্যাটে জয়, তাও আবার ক্রিকেটের ‘ভ্যাটিকান সিটি’ লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। গোটা বিশ্বে ‘চোকার্স’ নামে পরিচিত দক্ষিণ আফ্রিকা অবশেষে কাপ জয়ের মুখ দেখল প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়কের নেতৃত্বে।
লর্ডসে সিঁড়ি দিয়ে প্যাভিলিয়নের দিকে ওঠা শুরু করলে দেখা যায়, দু’পাশে বহু ক্রিকেটারের ছবি, বিখ্যাত লং রুমের দেওয়াল ছবিতে ভর্তি। ক্রিকেটের রথী-মহারথীদের চাঁদের হাট। সেই কুলীন আসনে এবার আসীন হলেন বাভুমা নিজেও।
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরের উপকণ্ঠে ছোট্ট শহর লাঙ্গা (Langa)। যার নামের অর্থ সূর্য। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় অ্যাপার্থাইডের অভিশাপ নেমে আসে গোটা দেশে। লাঙ্গা হয়ে ওঠে কৃষ্ণাঙ্গদের কলোনি। দারিদ্র, বঞ্চনার সেখানে সহাবস্থান। সস্তার শ্রমিক এই অঞ্চল থেকে সরবরাহ হত দেশের অন্যত্র। তবু এতকিছুর মধ্যেও এই অঞ্চল ছিল বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অন্যতম পীঠস্থান। ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ, কুখ্যাত শার্পভিল গণহত্যার সময়ও বহু মানুষের প্রাণহানি দেখেছে এই শহর।
১৯৯০ সালে সেই লাঙ্গায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা হোসা (Xhosa) উপজাতিভুক্ত এক বালক, তেম্বা বাভুমার। তার কয়েকদিন আগেই দীর্ঘ ২৭ বছরের কারাবাস থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন অ্যান্টি-অ্যাপার্থাইড আন্দোলনের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা! তেম্বার গায়ের রং কালো, উচ্চতা মাত্র পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। চেহারার কারণে সমাজমাধ্যমে তাঁর উদ্দেশে ভেসে আসে কদর্য ট্রোলের বন্যা। সে কী কুৎসিত সব ভাষা, গায়ের রংকে কটাক্ষ করে! কী কুরুচিকর ‘মিম’ উচ্চতা ও শারীরিক গঠনের উদ্দেশে! মনে পড়ে যায়, ২০২৩ বিশ্বকাপে ইডেন গার্ডেনে সেমিফাইনালের কথা। ক্রিকেটের নন্দনকাননও সেদিন তেম্বার ওই খর্বকায় শরীরকে লক্ষ্যবস্তু করে মেতে উঠেছিল জঘন্য মন্তব্যে।
পল রোবসনের আত্মজীবনীর প্রথম বাক্য ছিল, ‘আমি নিগ্রো’। পৃথিবীর সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে আজন্ম দাগিয়ে দেওয়া হয় ‘নিগ্রো’ হিসাবে চিহ্নিত করে। যেন তাঁরা মানুষ নন– নিগ্রো! তাঁদের হাতে হাতকড়া পরানো যায়, খাটানো যায় বিনা পয়সায়। কথায়-কথায় গুলি করেও মারা যায়। জন হেনরির সময় যা ঘটত, তা থেকে হয়তো বর্তমান সময়ে এই কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অত্যাচার কিছুটা হ্রাস পেয়েছে; কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের মনে বিদ্বেষ যে আজও আছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই দশকের গোড়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিরস্ত্র জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা করে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার। জন্ম হয় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের।
…………………………………
২০১৬ সালে টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন বাভুমা। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে কোনও কৃষ্ণাঙ্গের করা সেটাই প্রথম টেস্ট শতরান। হ্যাঁ, প্রথম। ২০২১ সালে যখন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক নির্বাচিত হন, তখন নানা ডামাডোলে কম্পমান প্রোটিয়া শিবির। নেতৃত্বের মুকুট বদলে গেল কাঁটার মুকুটে। ধেয়ে এল কটাক্ষ– ‘কোটার প্লেয়ার’, ‘কোটার ক্যাপ্টেন’। কিন্তু অধিনায়কত্ব যেন তাঁর মনের বাঘটিকে আরও পরিণত করল। ব্যাটিং গড় ৩৪.৫৩ থেকে পৌঁছল ৫৬-র ওপর।
…………………………………
এহেন পৃথিবীতে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেলেন তেম্বা বাভুমা, যেখানে অতীতেও মাথাচাড়া দিয়েছে বর্ণবাদ। সেই চেনা সূত্র ধরেই তাঁকে অসম্মান করা শুরু হল। ছোট থেকেই যিনি স্বদেশে বর্ণবৈষম্যের শিকার, তাঁর মন ও মনন যেন আঘাতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। কান্নার স্রোত পাথর হয়ে যায়। তেম্বার ক্ষেত্রে সেই পাথর হয়ে গিয়েছে বারুদ। বাড়ির সামনের চার রাস্তার মোড় ছিল তাঁর সাধনক্ষেত্র। তেম্বা জানতেন, তাঁকে বাউন্সারের থেকেও বেশি সামলাতে হবে বর্ণবৈষম্যকে। ২২ গজের বাইরে তাঁর জন্য থাকবে কুরুচিকর বডিলাইন। বাড়ির সামনের চারটে রাস্তার নামকরণ করেছিলেন তিনি। এবড়োখেবড়ো রাস্তার নাম ‘করাচি’, একটি রাস্তা ‘মেলবোর্ন’ আর সবথেকে সুন্দর রাস্তাটির নাম ‘লর্ডস’। এই রাস্তাটি যেন তাঁর জীবনের স্বপ্ন। যে স্বপ্নের ফুল ফুটল শনিবার, ঐতিহ্যের লর্ডসে।
২০১৬ সালে টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন বাভুমা। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে কোনও কৃষ্ণাঙ্গের করা সেটাই প্রথম টেস্ট শতরান। হ্যাঁ, প্রথম। ২০২১ সালে যখন দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক নির্বাচিত হন, তখন নানা ডামাডোলে কম্পমান প্রোটিয়া শিবির। নেতৃত্বের মুকুট বদলে গেল কাঁটার মুকুটে। ধেয়ে এল কটাক্ষ– ‘কোটার প্লেয়ার’, ‘কোটার ক্যাপ্টেন’। কিন্তু অধিনায়কত্ব যেন তাঁর মনের বাঘটিকে আরও পরিণত করল। ব্যাটিং গড় ৩৪.৫৩ থেকে পৌঁছল ৫৬-র ওপর। সমালোচনা, কটাক্ষের কোনও বিষবাক্য বাধা হতে পারেনি বাভুমার সংকল্পে। ওডিআই বিশ্বকাপে দলকে নিয়ে গেলেন সেমিফাইনালে। কিন্তু বিধি বাম! ‘চোকার্স’ তকমা ঘুচল না। যা দক্ষিণ আফ্রিকা বয়ে নিয়ে আসছিল ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে। অ্যালান ডোনাল্ড থেকে ল্যান্স ক্লুজনার, ডেল স্টেইন থেকে এবি ডিভিলিয়ার্স– অনেক রথী-মহারথীও সেই অভিশাপ ঘোচাতে পারেননি। ব্যতিক্রম শুধু ১৯৯৮ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। তারপর আর আইসিসি টুর্নামেন্টের নকআউটের গাঁট পার করতে পারছিল না প্রোটিয়ারা। অপেক্ষার এই দীর্ঘ ২৭ বছরে ‘চোকার্স’-এর ফাঁস যেন আরও চেপে বসছিল দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের গলায়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালেও সেই চেনা চিত্রনাট্যে বদল আসেনি। বদল এল অবশেষে লর্ডসে, বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের মঞ্চে। প্রতিপক্ষ ব্যাঘ্রসম অস্ট্রেলিয়া। শুধুমাত্র গতবারের বিজয়ীই নয়, ধারে ও ভারে দক্ষিণ আফ্রিকার থেকে বহু গুণ এগিয়ে থাকা এক দল, বিশ্ব ক্রিকেটে সাফল্যের নিরিখে যাদের ধারেকাছে কেউ নেই। আর ফাইনালে অজিরা বরাবর ভয়ংকর।
খেলা লর্ডসে– তেম্বা বাভুমার স্বপ্নের সেই লর্ডস। যেখানে স্বপ্নও বাস্তবে রূপান্তরিত হয়। যেমনটা হয়েছিল ৪২ বছর আগে। কপিল দেবের নেতৃত্বে বিশ্বজয়ের স্বাদ পেয়েছিল ভারত, এমনই এক শীতকাতর লন্ডনের জুন মাসে। ‘আন্ডারডগ’-এর তকমা ঘুচিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটের মঞ্চে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছিল ভারতীয় দল। ক্রিকেটের আরেক ফরম্যাটে বাভুমাদের স্বপ্নপূরণ যেন সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।
গ্রীষ্মের শুরুতে লর্ডসের পিচ সিমারদের স্বর্গরাজ্য। এর আগে দু’বার বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেললেও শিরোপা জয় করতে পারেনি ভারতীয় দল। সিমারদের বিষাক্ত ছোবল প্রতিবার স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটিয়েছে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মাদের। সেই চেনা ছকেই অজি ব্যাটিং লাইন আপে ভাঙন ধরিয়েছিলেন আরও এক কৃষ্ণাঙ্গ বোলার– কাগিসো রাবাদা। অথচ সেই লড়াই ম্লান হয়ে গিয়েছিল প্রথম ইনিংসে প্রোটিয়াদের ব্যাটিং বিপর্যয়ে। তবু হাল ছাড়েননি বাভুমারা। এ যে অন্য দক্ষিণ আফ্রিকা। দ্বিতীয় ইনিংসে প্রত্যাঘাত। ব্যাটিং ও বোলিং-এ। দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্নপূরণে হাল ধরলেন ধরলেন এইডেন মার্করাম এবং তেম্বা বাভুমা। ক্রিকেট তো আসলে জীবনের কথাই বলে। যে জীবন লড়তে জানে। লড়ে জিততে জানে। এমন লড়াইয়ের মঞ্চে কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ মেলবন্ধন– এমনটাই তো চেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। চেয়েছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। কৈশোরের স্বপ্নের মাঠে সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে পরিণত করলেন বাভুমা। এমন দিন তো রোজ আসে না। অবশেষে তা এল দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে শাপমুক্তি বার্তা নিয়ে। সঙ্গে শাপমোচন ঘটল যেন দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদেরও।
আসলে ২০২৫ যেন শাপমুক্তির শপথ নিয়েই এসেছে। যদিও ক্রিকেটের শুদ্ধতম ফরম্যাটের পাশে চটকদার আইপিএলকে রাখলে তা গুরুচণ্ডালী দোষ হবে। তবু সেখানেও একই বিষয় দেখি। ট্রফির জন্য ১৮ বছর ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনছিল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর। বিরাট কোহলি তাঁর ক্রিকেট জীবনে আন্তর্জাতিক স্তরে একাধিক ট্রফি জয় করলেও অধরা ছিল আইপিএল জয়। সেই অস্বস্তির কাঁটা তাঁকে মনে করিয়ে দিত– ট্রফি ক্যাবিনেটে সবই আছে, কিন্তু আইপিএল ট্রফিটা নেই! সেই অপেক্ষারও অবসান ঘটেছে ২০২৫-এ। আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়ে শাপমুক্তি ঘটেছে বিরাট কোহলির আরসিবি-র।
ফুটবল? সেখানেও চোকার্সদের জিতে যাওয়ার রূপকথা। প্রতিষ্ঠালাভের দীর্ঘ ৫৫ বছর পর এই প্রথম উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতল প্যারিস সাঁ জাঁ। একই রূপকথার শরিক বায়ার্ন তারকা হ্যারি কেন, টটেনহ্যামের সন হিউন-মিন। ১৯৫৫ সালে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের লেখা গল্পকে ভিত্তি করে পরিচালক সুধীর মুখোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন ‘শাপমোচন’। ‘শাপমোচন’-এর ৭০ বছর যেন ক্রীড়া জগতে শাপমুক্তির বছর।
…………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………………