নাদাল হয়তো ফেডেরারের মতো সৌন্দর্যের পূজারী নন, নোভাকের মতো অলকোর্ট গেমও নেই তাঁর। তবু অদম্য ফিটনেস, হার না মানা মনোভাব এবং ভীমসেনী ফোরহ্যান্ড– যাতে ছিল গোখরোর ছোবল, তা নিয়ে রজারকে টপকে ২২টা গ্র্যান্ডস্ল্যামে শেষ করলেন তিনি। ফ্রেঞ্চ ওপেনের অবিসংবাদিত সম্রাট নাদালই। ১-২ বা ৫-৬ নয়, একেবারে ১৪টা চ্যাম্পিয়নশিপ। কিন্তু সুরকির কোর্টই কি একমাত্র নন্দনকানন রাফার? সিনথেটিক কোর্টে, এমনকী ঘাসের কোর্টেও একাধিক গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে নিজের জন্য ইতিহাসের একটা বিস্তীর্ণ অংশ বরাদ্দ রেখে গেছেন নাদাল।
দশ বছর বয়স পর্যন্ত রাফায়েল নাদাল মনিকা সেলেসের মতো দু’হাতে ফোরহ্যান্ড আর ব্যাকহ্যান্ড মারতেন। কিন্তু মামা টনি নাদাল বলেন যে দু’হাতে ফোরহ্যান্ড মেরে কেউ কখনও বড় টেনিস খেলোয়াড় হননি। যদিও রাফা ডানহাতে খেতেন বা বল ছুড়তেন, তবুও মামা টনি নাদাল খেয়াল করেন যে ডানহাতের জায়গায় বাঁ-হাতে ফোরহ্যান্ড মারার সময় অনেক বেশি জোরে বল মারেন।
সেমি ওয়েস্টার্ন গ্রিপে, আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হতে পারে টেকনিকালি শটটায় স্বাভাবিকত্ব নেই। কারণ হেভি টপস্পিন মারার জন্য হাতের গ্রিপ ঠিক করে নিতে হত। খেয়াল করে দেখবেন, বাঁ-হাতের তর্জনি এবং মধ্যমার গাঁটগুলোতে টেপ লাগানো। কারণ হাই টপস্পিন মারতে গেলে অনেক চেপে র্যাকেট গ্রিপ ধরতে হয়। আঙুলে চোট লাগার সম্ভাবনা। কিন্তু সেটাই সবথেকে বড় অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু সে তো একদিনে হয়নি। মামার নির্দেশ ছিল বল সবসময় জোরে মারতে হবে। তাতে বল ঠিক জায়গায় না-ই পড়তে পারে, কিন্তু মেরেই যেতে হবে। আর ফিটনেস। হালকা পলকা রাফা ছুটতে পারতেন প্রচণ্ড, আর তেমন নাছোড়বান্দা মনোভাব। ব্যস, মায়োরকার ডাকাবুকো ছেলেটাকে নিয়ে টনি পড়লেন ঘষেমেজে তৈরি করতে।
তখন ডুবন্ত টেনিস সূর্যকে উদ্ধার করতে পৃথিবীতে আগমন ঘটে গেছে রজার ফেডেরারের। বাসেলের রাজকুমারের। কিন্তু তার থেকেও বছর পাঁচেকের ছোট আইবেরিয়ান যে গোকূলে বাড়ছে সে খেয়াল কেউ রাখেনি। ফেডেরারের শৈল্পিক তুলিতে তখন সবাই বিমোহিত। দুটো উইম্বলডন জিতে তৃতীয়টির দিকে যাচ্ছেন তিনি। ফ্রেঞ্চে কিন্তু সুবিধা করতে পারছেন না। ফেডেরারের খেলার স্টাইলের সঙ্গে ধীরগতির লাল সুরকির কোর্ট মেলে না যে!
২০০৫-এ অবশ্য ফেডেরার বেশ ভালোই খেলছেন। সেমিফাইনালে উঠেছেন, সামনে মাথায় হেড ব্যান্ড বাঁধা, হাত-কাটা টি-শার্ট পরিহিত ১৯ বছরের এক ছোকরা। কিন্তু কোর্টের বাইরের জায়গা অনেক বড় হয়ে গেছে। ফেডেরারের রেশমি গ্রাউন্ড স্ট্রোক আর ভলির মোকাবিলার জন্য ছেলেটির হাতে আছে ফোরহ্যান্ড টর্নেডো। সেমি ইউরোপীয় গ্রিপে বলটাকে নিচ্ছেন রাফা র্যাকেটের সামান্য নিচের দিকে, তারপর মাথার ওপর সুদর্শন চক্রের মতো ঘুরিয়ে শব্দভেদী বাণ ছাড়ছেন ফেডেরারের ব্যাকহ্যান্ডে। বল খুব ডিপে নয়, পড়ছে সার্ভিস লাইনের কাছাকাছি আর তারপরেই বিষাক্ত ফণা তুলছে ফেডেরারের কাঁধের কাছে। কত আর স্লাইস করে সামলানো যায়, ব্যাকহ্যান্ডে এক হাতে টপস্পিন মারতে গেলেই বলে নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। ফোরহ্যান্ড, অনবদ্য কোর্ট কভারেজ আর তার সঙ্গে টেরিয়ার কুকুরের মতো নাছোড়বান্দা মানসিকতা।
……………………………………………………..
২০০৫-এ অবশ্য ফেডেরার বেশ ভালোই খেলছেন। সেমিফাইনালে উঠেছেন, সামনে মাথায় হেড ব্যান্ড বাঁধা, হাত-কাটা টি-শার্ট পরিহিত ১৯ বছরের এক ছোকরা। কিন্তু কোর্টের বাইরের জায়গা অনেক বড় হয়ে গেছে। ফেডেরারের রেশমি গ্রাউন্ড স্ট্রোক আর ভলির মোকাবিলার জন্য ছেলেটির হাতে আছে ফোরহ্যান্ড টর্নেডো। সেমি ইউরোপীয় গ্রিপে বলটাকে নিচ্ছেন রাফা র্যাকেটের সামান্য নিচের দিকে, তারপর মাথার ওপর সুদর্শন চক্রের মতো ঘুরিয়ে শব্দভেদী বাণ ছাড়ছেন ফেডেরারের ব্যাকহ্যান্ডে।
……………………………………………………..
প্রায় লাইন আম্পায়ারের সামনে থেকে হাই টপস্পিন গেমে ফ্রেঞ্চ ওপেনে রাজত্ব শুরু হল। কিন্তু তাতেই থেমে থাকলেন না নাদাল। খেলায় সামান্য পরিবর্তন আনলেন, সব সার্ফেসে মানিয়ে নেওয়া শুরু হল। ঘাস বা সিনথেটিক কোর্টে কোর্ট কভারেজ এবং কাউন্টার পাঞ্চিং দিয়ে বিপক্ষের ত্রাস হয়ে উঠলেন। ঘাসের কোর্টে ফেডেরারের রাজত্বে ভাগ বসালেন ২০০৮ সালেই। ফাইনালে শেষ সেটে স্রেফ অদম্য হার না মানা মানসিকতা এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলের পিছনে ধাওয়া করাকে মূলধন করে ৯-৭-এ ফেডেরারকে পরাভূত করলেন। আর সেই সঙ্গে ১৯৮০-র বিয়র্ন বর্গের একই বছরে ফ্রেঞ্চ ও উইম্বলডন জেতার ইতিহাসকে পুনরাবৃত্তি ঘটালেন। বর্গ একই ঘটনা পরপর তিনবছর করেছিলেন ১৯৭৮-’৮০।
যদিও চোটগ্রস্ত নাদাল তার পরের বছর ফ্রেঞ্চের কোয়ার্টার ফাইনালে রবিন সোডারলিং-এর কাছে হেরে গেলেন আর ফেডেরার একমাত্র ফ্রেঞ্চ জিতলেন আর তারপরের মাসেই উইম্বলডন জিতে বর্গের পরে তৃতীয় ব্যক্তি হিসাবে একই কৃতিত্বের অধিকারী হলেন।
কিন্তু চোট সারিয়ে ফিরে এসে নাদাল অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন আবার। ২০১০-এ অস্ট্রেলীয় ওপেন ছাড়া পরপর তিনটে গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিতলেন। ২০১৪ অবধি তখন রজারের সিংহাসনে ভাগ বসাতে রাফার সঙ্গে এসে হাজির হয়েছেন সার্বিয়ার নোভাক জোকোভিচও। এক অদম্য অল কোর্ট ডিফেন্সিভ গেম নিয়ে। ’১৫ এসে প্রায় কেরিয়ার শেষ হয়ে যাওয়া দুটো আঘাতের মুখোমুখি হলেন রাফা। টর্নেডো ফোরহ্যান্ড কবজি এবং কোমরের ওপর থাবা বসাল। বিশেষত কবজির অস্ত্রোপচারের পর খেলা পাল্টাতে বাধ্য হলেন রাফা।
কে সর্বকালের সেরা, রজার, রাফা না নোভাক– সেই বিতর্ক তখন তুঙ্গে। কিন্তু আজ, রজার টেনিস ছেড়েছেন বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। রাফা আর আগের সেই রাফা নেই। বিদায়বার্তা দিয়ে তিনিও অবসরের পথে এক পা বাড়িয়ে রাখলেন। একমাত্র টিকে আছেন নোভাকই। সর্বকালের সেরা বিতর্কেও বোধহয় দাঁড়ি পড়ে গেছে নোভাকের পক্ষে।
কিন্তু তিনজনের মধ্যে রাফার লড়াইটাই সবথেকে কঠিন ছিল, সর্বকালের সেরা হবার। যে সময় তাঁর উদ্ভাস, তখন ফেডেরারের সোনার সময়। তাও সমানে সমানে লড়ে, মানসিক কাঠিন্য দেখিয়ে, (একটা ফ্রেঞ্চ ফাইনালে ১৭টি ব্রেক পয়েন্টের মধ্যে শুধুমাত্র ১টাই হারেন রজারের কাছে) তিনি লড়ে নিয়েছিলেন এক নম্বরের শিরোপা। কিন্তু বেশিদিন নয়, তার পরে পরেই নোভাক জোকোভিচ এসে ছিনিয়ে নেন রাফার সিংহাসন। তবু রাফা লড়ে গেছেন, কবজির চোট, ম্যুলার-ওয়েইস সিন্ড্রোম (পায়ের প্রধান হাড়ের অস্বাভাবিকভাবে বেঁকে যাওয়া) জয় করে তিনি ২০১৭ থেকে টানা চার বার ফ্রেঞ্চ জিতেছেন, জিতেছেন দুটো ইউএস ওপেন। আর ২০২২-এরটা তো রূপকথা।
রাফার ২০১৭-য় পুনরুত্থানের পর খেলার ধরন অনেকটাই পাল্টেছে। আগে যেরকম বেসলাইন নির্ভর রক্ষণাত্মক টেনিস খেলতেন, সেখান থেকে চোটের কারণেই হয়তো কেরিয়ার দীর্ঘায়িত করতে রাফা টপস্পিনের হিংস্রতা কমিয়ে অলরাউন্ড খেলায় মন দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে সুবিধা হয়েছে জোকোভিচের। জোকোরের বয়স বেড়েছে নাদালের সঙ্গে সঙ্গে, কিন্তু ফিটনেসের বিষয়ে সতর্ক থাকার ফলে তাঁর ধার কমেনি। কিন্তু রাফার ব্রহ্মাস্ত্র হেভি টপস্পিন ফোরহ্যান্ড আর দ্রুত কোর্ট কভারেজ ছিল না আর। তাই একে একে রজার ও রাফাকে টপকে ২৪টা গ্র্যান্ডস্ল্যামের সিংহাসনে বসলেন জোকোভিচই।
………………………………………………………
আরও পড়ুন সৌরাংশু সিংহ-র লেখা: আমরা যারা স্টেফিকে ভালোবাসতে পারিনি…
………………………………………………………
রাফার রাস্তাও এবারে ফুরল। নাদাল হয়তো ফেডেরারের মতো সৌন্দর্যের পূজারী নন, নোভাকের মতো অলকোর্ট গেমও নেই তাঁর। তবু অদম্য ফিটনেস, হার না মানা মনোভাব এবং ভীমসেনী ফোরহ্যান্ড– যাতে ছিল গোখরোর ছোবল, সেই নিয়ে রজারকে টপকে ২২টা গ্র্যান্ডস্ল্যামে শেষ করলেন তিনি। ফ্রেঞ্চ ওপেনের অবিসংবাদিত সম্রাট তিনিই। ১-২ বা ৫-৬ নয়, একেবারে ১৪টা চ্যাম্পিয়নশিপ। খুব কাছাকাছি বলতে নোভাকের ১০বার অস্ট্রেলীয় ওপেন বিজয়ই রইল। কিন্তু সুরকির কোর্টই কি একমাত্র নন্দনকানন রাফার? সিমেন্ট বা সিনথেটিক কোর্টে, এমনকী ঘাসের কোর্টেও একাধিক গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিতে নিজের জন্য ইতিহাসের একটা বিস্তীর্ণ অংশ বরাদ্দ রেখে গেছেন।
প্রতিটি ট্রফির কান কামড়ে ছবি তোলা, সার্ভিস করতে স্ট্র্যাটেজিকালি প্রায় বরাদ্দ সময়ের পুরোটা নিয়ে ধৈর্যের খেলা খেলে যাওয়া, গেমসম্যানশিপ পেরিয়েও যে রাফার ছবিটা থাকে, সে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতাপরায়ণ হয়েও মানবিক। সামাজিক কাজে বারবার এগিয়ে আসা এবং কোর্টের বাইরে বোধহয় সবথেকে প্রিয়ংবদ এক চরিত্র রাফা।
চলে তো সবাইকেই যেতে হয়। রাফা অনেক দিনই টানলেন, কিন্তু যেতেই হল। কিন্তু শুরুটা যেখানে হয়েছিল সেইখানেই শেষ করার সুযোগ ক’জনার হয়? ২০০৪-এ সেভিয়ায় ডেভিস কাপ ফাইনালে অ্যান্ডি রডিকের যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি। সেই ডেভিস কাপ ফাইনালস দিয়েই শেষ হবে কোর্টের সাম্রাজ্য। ফরম্যাট পাল্টেছে অনেক, এখন কোয়ার্টার থেকে পরপর বেস্ট অব থ্রি ম্যাচের খেলা পরপর চার দিন চলবে। কিন্তু মালাগায় একবার শেষবারের মতো মায়োর্কার মস্তান তাঁর খেল দেখাতে তৈরি। সঙ্গে উত্তরসূরি আলকারাজ।
শুরুর মতো শেষটাও কি রূপকথার হবে না মুকুটহীন রাজার?
.…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………..