বোলানে আছে নাটকের আভাস। নাটকে ভিন্ন চরিত্রের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কুশীলব থাকে। তবে নাটকের মতো সংলাপ মুখস্থ করে শরীর সঞ্চালনা করে দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে পারে না। বোলানে মূল গায়েন বলেন যেমন, ‘তখন রাম বলে, ভাইরে লক্ষ্মণ চলেছে কুথাই?’ সঙ্গে সঙ্গে সহ-গায়কেরা সেই পদকেই পুনরাবৃত্তি করে গান। বোলান লোকনাট্যে এককের কথা থাকে না। সকলে মিলে গান গায়। সুধীর চক্রবর্তীর লেখায় জানতে পারি যে, একে লোকনাট্য বলার প্রধান কারণ এর বিষয় লৌকিক জীবনবৃত্ত আশ্রয়ী। এর রূপকার ও শ্রোতা গ্রামীণ লোক জীবনের শরিক।
চৈত্র মাস। বসন্তের শেষ, গরমের রাজত্ব শুরু। মাথার ওপর সূর্যের প্রখর রোদেও মানুষ কাজ করে চলে। বাঙালি কাজের পাশাপাশি এই সময় অনেক ধর্মীয় অনুষ্ঠানও পালন করে। আমরা জানি, বাঙালিদের বারো মাসে তেরো পার্বণ। তাই বর্ষা হোক বা গ্রীষ্ম– পার্বণ বন্ধ থাকে না। চৈত্র মাসের শেষ কয়েক দিন পালিত হয় নীল পুজো, চড়ক পুজো– যা আসলে শিবের আরাধনা। ‘বোলান’ তেমনই একটা আরাধনা বলা যায়।
বোলান বাংলার লোকসংস্কৃতির এক উজ্জ্বল অংশ। গ্রামীণ জনজীবনকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্যই বোলান আয়োজিত হয়। একাধিক বাদ্যযন্ত্রের তালে মুখরিত নৃত্যগীতে উদ্বেলিত এই লোকনাট্যে অপরকে যেমন আনন্দ দেওয়া হয়, তেমন বোলান শিল্পীরাও আনন্দ পান। তাই বোলান কোনও পেশাদার অনুষ্ঠান নয়, মনের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের প্রকাশ। ব্যক্তিচেতনার সঙ্গে সমাজচেতনার মিশ্রণ বোলান। লোকজীবন ও লোকবৃত্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ সম্পর্কযুক্ত লোকনাট্য বোলান।
আমরা বাংলা সাহিত্য বা সিনেমায় ভাটিয়ালি, ভাদু, ছৌ নাচের কথা পড়ে থাকি বা দেখে থাকি। কিন্তু একমাত্র বোলান লোকগান ও নাট্যের কথা হাতে গোনা দু’-একটি সাহিত্য ও সিনেমায় ধরা পড়েছে। বাংলায় সেরকম একটি সিনেমা ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’। এই সিনেমায় মুখ্য চরিত্রে থাকা ঋত্বিক চক্রবর্তী ও অমিত সাহা এক গ্রামে যান। গ্রামের নাম ‘মোহিনী’। সেখানেই এক সন্ধ্যায় দেখেন ‘বুলান’ নামের এক গ্রামানুষ্ঠান। ঋত্বিক সেই অনুষ্ঠান দেখতে দেখতেই পাশে বসা একজনকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘বুলান গান আসলে কী?’ লোকটি বলে, এ তো ‘বুলান’ গান। চৈত্র মাসের শিবের গাজন উপলক্ষে করা হয়। তারপরে সিনেমায় দেখা যায় যে, সেই মোহিনী গ্রামটি হারিয়ে যায়। সিনেমার গ্রাম হারিয়ে যাওয়ার মতো বোলানও আস্তে আস্তে আমাদের সমাজ থেকে, সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ এই বোলান আমাদের প্রাচীন লোকনাট্যগুলির মধ্যে একটি অন্যতম লোকনাট্য।
বোলান চৈত্রমাসে শিবের গাজন উপলক্ষে অভিনয়ের মাধ্যমে গাওয়া হয়। বোলান লোকসমাজে যা দেখে, যা বোঝে, যা জানে, তাই তুলে ধরে। লোকশিল্পী স্রষ্টার মুখে সৃষ্টি হয়ে মৌখিকভাবে প্রসারিত হয় বোলান। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান জেলায় এই গানের প্রচলন আছে। বোলান লোকগান ও লোকনাট্য– দুয়ের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে। বোলানের উৎপত্তি নদীয়া জেলাতেই, যা পরবর্তীকালে বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমানে ছড়িয়ে পড়ে। লোকসংস্কৃতি দপ্তর সূত্রে জানতে পারি, ‘‘৩৫০-৩৭৫ বছর আগে ‘বোলান’ শুরু হয় রাঢ় বাংলায়। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচাঁদের সময় এই বোলানের রমরমা শুরু হয়। তখন বোলান মুখে মুখে গেয়েই মনে রাখত। ১৮৫০ সালের পর খাতায় পালাগান লেখা শুরু হয়।’’ তবে বাংলায় তুর্কি আক্রমণের পর থেকেই শিবের গাজন উপলক্ষে বোলান গান গাওয়া শুরু। বোলান নৃত্য-গীত-অভিনয় সমন্বয়ে পরিবেশিত হয়। শুরু হয় চৈত্র মাসের গাজনের দিন সন্ধ্যায়, টানা পর পর দুই থেকে তিনদিন ধরে চলে বোলান গান। জেলায় জেলায় এখনও যে যে অঞ্চলে প্রতি বছর একটা-দুটো দলের বোলান গান হয়ে থাকে, সেগুলি হল, বীরভূম জেলার লাভপুর ও নানুর, মুর্শিদাবাদের কান্দি, ভরতপুর, দেচাপড়া, বর্ধমান জেলায় কাটোয়া ও কেতুগ্রামে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
প্রত্যেকটি দল গায়ক, বাদক ও অভিনেতাদের সমন্বয়ে গঠিত। একজন ওস্তাদ দলের নেতৃত্ব দেন। বোলান গান বাঁধা হয় পালার আকারে। এর মুখ্য বিষয় পৌরাণিক। এতে লঘু-গুরু উভয় রসই থাকে। গুরু হল খণ্ডগীতি, লঘু হল রংপাঁচালি। রংপাঁচালি মূলত মূল পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পর হয়। এতে কৌতুক ও হালকা রসের বিষয় থাকে। সমাজের বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরা হয়, গোপন কথাগুলো বলে হাটে হাঁড়ি ভাঙা হয়।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ বাংলা অভিধানে ‘বোলান’ শব্দের অর্থ ‘প্রবচন’। এটি একটি বিশেষ্য পদ। কখনও বোলান অর্থে কথা বলা, যেমন– ‘ঘরে গেল্যা না দিয়া বোলান’(‘চণ্ডীমঙ্গল’ কবিকঙ্কন মুকুন্দ চক্রবর্তী)। আবার বোলান অর্থে সম্ভাষণ বোঝায়, যেমন, ‘আজি কেন না করে বোলান’ (‘পদ্মপুরাণ’ বিজয় গুপ্ত)। আবার ‘বুলা’ শব্দের অর্থ ভ্রমণ করা। অর্থাৎ, পাড়া ঘুরে ঘুরে এই গান গাওয়া হয় তাই একে ‘বুলান’ বলে। ‘বালা’ শব্দের অর্থে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘শিবের গাজন উৎসবে যারা বেতের ছড়ি লইয়া নৃত্য করে ও গান গায়’। ‘সন্ সন্ন্যাসী লইয়া বালা চলেন শিবের বাস/ শিব শিব বলিয়া ডাকে ঘন ঘনে’। (বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ/ বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়)।
বোলান মূলত চার ধরনের হয়ে থাকে। পোড়ো বোলান, দাঁড় বোলান, সখী বোলান, শ্মশান বোলান। এঁদের মধ্যে ‘পোড়ো বোলান’ দলে মড়ার খুলি নিয়ে শিল্পীরা তাণ্ডব নৃত্য করে, জাদু দেখিয়ে দর্শকদের আনন্দ দেয়। আর ‘দাঁড় বোলান’ প্রধানত সামাজিক ও পৌরাণিক বিষয়ভিত্তিক হয়ে থাকে। এই দলের শিল্পীরা সুষ্ঠুভাবে নাচ-গানের মাধ্যমে কাহিনি পরিবেশিত করে। প্রত্যেকটি দল গায়ক, বাদক ও অভিনেতাদের সমন্বয়ে গঠিত। একজন ওস্তাদ দলের নেতৃত্ব দেন। বোলান গান বাঁধা হয় পালার আকারে। এর মুখ্য বিষয় পৌরাণিক। এতে লঘু-গুরু উভয় রসই থাকে। গুরু হল খণ্ডগীতি, লঘু হল রংপাঁচালি। রংপাঁচালি মূলত মূল পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ার পর হয়। এতে কৌতুক ও হালকা রসের বিষয় থাকে। সমাজের বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরা হয়, গোপন কথাগুলো বলে হাটে হাঁড়ি ভাঙা হয়। হাস্যরসই এর প্রধান উপজীব্য। হারমোনিয়াম, ঢোল, খোল, বাঁশি, কাঁসর বাজিয়ে গান গাওয়া হয় এবং তাঁর তালে তালে নাচ করে সুরধর্মী সংলাপ বলে সুরমুর্ছনায় শ্রোতাদের মোহিত করা হয়।
বন্দনা গীতির মাধ্যমে ‘বোলান’ গান শুরু হয় এবং পাঁচালির ঢঙে মূল পালা শুরু হয়। যেমন, ‘প্রথমে বন্দনা করি গণেশের চরণ/ তারপরে বন্দনা করি মা কালির চরণ’। তারপর শিবের বন্দনা করা হয়। যেমন, ‘বৃষব বাহনে এসো ওহে ভোলা পঞ্চানন/ তোমাবিনা হবে নাকো তোমার এই সিদ্ধগাজন।’ তারপর সংলাপ, গান ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে পুরো বিষয়টি পরিবেশিত হয়। গানের ক্ষেত্রে যে সুর ব্যবহার হয়, তা মূলত হিন্দি বা বাংলা গানের সুর। এই পালায় যিনি পালা রচনা করেন, তাঁকে বলা হয় ‘ছড়াকার’। কখনও কখনও বোলের মধ্যে চলে আসে রাজনৈতিক কথা। যেমন, নদীয়ায় ২০১১ সালের চৈত্রে বোলানে বলতে শোনা যায়, ‘ভোট, ভোট, ভোট এল বঙ্গে/ ওগো পরিবর্তনের হাওয়া নিয়ে এল সঙ্গে/ বঙ্গবাসীর মুখে মুখে একটিই কথা তাই/ খুনি বাম সরকারের পরিবর্তন চাই।’ আবার ২০১৩ সালেই বদলে গিয়েছিল গানের মেজাজ। শোনা গিয়ছিল, ‘ওগো রাজনীতিতে দাদাগিরি সব আমলেই ছিল/ এই আমলেও দাদাগিরি যে কমবেশি হল/ তাই তো বলি বঙ্গবাসী শুনুন দিয়া মন/ এইসব দাদারাই বাংলায় অশান্তির কারণ।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পড়ুন বহুরূপী ধনেশ্বর বৈরাগ্য-র সাক্ষাৎকার: একবার বহুরূপী সেজে ফেললে খিদে-জলতেষ্টা পায় না
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
শেষে ভণিতার ঢঙে পরিচয় দেয় এভাবে– ‘শোভাকর ঘোষ রচিত এ গান/ ষষ্ঠী সর্দার বাজায় বাজনা/ বাপি আর জগেশ চালায় এ দলখান।’ বোলানে সাধারণত অংশগ্রহণ করে থাকে মাঠে চাষ করা, রিকশা চালক ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এরা কেউই পেশাদার ও অভিনেতা নয়। বছরে একটা সময় অপেশাদার শিল্পীরা নিজেদের জীবনের কষ্ট, সুখকে নৃত্য-গীত-অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করে জনসমাজের কাছে।
বোলানে অংশগ্রহণকারী চরিত্রের পোশাক হয় বেশ নজরকাড়া। রংবেরঙের পোশাক। কখনও কখনও পালায় ছেলেদের মেয়ে সাজতে দেখা যায়। পরনে থাকে ঘাঘরা, ফতুয়া, নাকে নথ, মাথার ‘পর কোমর অবধি পরচুল। কেউ কেউ মুখে খড়িমাটি মাখে, কেউ কেউ মুখের ওপর নীলবর্ণের প্রলেপ দিয়ে তার ওপর লাল, হলুদ রং দিয়ে বিভিন্ন কারুকার্য করে থাকে। পুরুষদের পোশাক সাধারণত লুঙ্গি, জামা, গেঞ্জি। তবে পৌরাণিক চরিত্রে অভিনয়ের সময় পোশাক যাত্রানুসারী হয়।
বোলানে আছে নাটকের আভাস। নাটকে ভিন্ন চরিত্রের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কুশীলব থাকে। তবে নাটকের মতো সংলাপ মুখস্থ করে শরীর সঞ্চালনা করে দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে পারে না। বোলানে মূল গায়েন বলেন যেমন, ‘তখন রাম বলে, ভাইরে লক্ষ্মণ চলেছে কুথাই?’ সঙ্গে সঙ্গে সহ-গায়কেরা সেই পদকেই পুনরাবৃত্তি করে গান। বোলান লোকনাট্যে এককের কথা থাকে না। সকলে মিলে গান গায়। সুধীর চক্রবর্তীর লেখায় জানতে পারি যে, একে লোকনাট্য বলার প্রধান কারণ এর বিষয় লৌকিক জীবনবৃত্ত আশ্রয়ী। এর রূপকার ও শ্রোতা গ্রামীণ লোক জীবনের শরিক। এ গানের রূপায়ণ হয় নাগরিক সংস্কৃতির বাইরে অর্থাৎ গ্রামীণ বাতাবরণে। এর রচনাশৈলী ও গঠনে প্রচলিত নাট্যরীতিকে বর্জন করা হয়। লোকনাট্যের স্বভাবধর্ম অনুসারে মুখে মুখে এ গান ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে গ্রামে।
বাংলার পুরনো লোকসংস্কৃতিগুলোর মধ্যে প্রায় হারিয়ে যেতে থাকার মধ্যে একটি হল ‘বোলান’। বেশিরভাগ জেলায় যেখানে এক সময় বোলানের রমরমা ছিল, সেগুলির অনেকাংশে আজ শিবরাত্রির সলতের মতো টিকে আছে। এর মূল কারণগুলির একটা হল আমাদের আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা। অনেক ‘বোলান’ শিল্পীই তাঁদের জীবনের ব্যস্ততার কথা যেমন বলেছেন, তেমনই অনেকে জানিয়েছেন অর্থসংকটের কথা। যেহেতু সরকার এই সকল গ্রামীণসংস্কৃতির প্রতি চিরকাল মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন, তাই আধুনিক জীবনে অর্থ রোজগারের জন্য দিনরাত ছুটে চলেছে মানুষ। সময় পাচ্ছেন না বিনোদন পরিবেশন করা ও দেখার। বিশ্বায়নের যুগে কেবল মাত্র শহরকেন্দ্রিক সংস্কৃতিগুলিই বহত্তর ক্ষেত্রে প্রকাশ পাচ্ছে। এছাড়াও আগে বোলান শিল্পীরা দূরদূরান্ত থেকে ডাক পেতেন, এখন আর পান না। আধুনিক প্রযুক্তি গ্রাস করে নিচ্ছে গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি।