বাঙালি কি আর আড্ডা দেয়? বাংলা নববর্ষের শুরুর দিনেই এই প্রশ্ন খোঁচা মারে মনে। একজোট হয় বটে তারা, বিবিধ কারণে, কিন্তু আড্ডার যে বহুস্তরীয় উপাদান, তার কি অভাব প্রকট নয়? আজকের আড্ডা, যেন বাঙালির পুরনো আড্ডার একপ্রকার অবিচুয়ারি, তাছাড়া কিছু নয়।
যতদূর চোখ যায়, যতদূর ছানি আর মায়োপিয়া নিয়ে দেখতে পাই আমি, খুঁজে কি পাই, দু’-একটি তরুণ-তরুণী ছাড়া, কিংবা দু’-এক পিস আমারই সমবয়সি নড়বড়ে, আবছা হয়ে আসা মানব-মানবী ছাড়া আড্ডা দেওয়ার বাঙালি? আড্ডার আসরে যে যাই না, তা নয়। কিছু বাঙালি কোনও কারণে সমবেত হয়েছে। টেবিলে যে-যার প্রিয় তারল্যও পেয়েছে। সঙ্গে স্বাদু স্ন্যাকস। কিন্তু কথা কোথায়? কোনও কথাই যে নেই, তাও নয়। কিন্তু কোনও বিষয় নেই কথার। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে নেই ভাবনার বিস্তার। নেই কথার সঙ্গে কথার বুনন। সেই বোধের আলো। ভাষার দীপন। রসবোধের ঝলক। বাক্যের নিয়ন্ত্রিত গঠন। আছে সাজপোশাকের বাহার। আছে ব্র্যান্ডের চমক। আছে নারী শরীরের প্রতাপ ও পদাবলি। আছে পুরুষের কবজিতে রোলেক্স, গলায় সোনার হার। পোশাকের উৎকট জাহির। কিন্তু এমন সাজানো বাগানে আমি খুঁজে পাই না একটি মনের মতো মন। একটি মনে রাখার মতো দৃষ্টি। গায়ে লাগে না কোনও চোখের চাওয়ার হাওয়া। হঠাৎ চোখে পড়ে, দরজা দিয়ে ঢুকল এই মাত্র, কে ওই তরুণী, যার হাসিতে, শুধু হাসিতে, ঝরে পড়ল অনেক কথা! তবু কাছে যেতে ভয় করে আমার, যদি হয় মৃগতৃষ্ণিকা! সোনার হরিণের সর্বনাশ মহাকাব্যের বিষয়। আড্ডার গণ্ডিতে ধরা কি যায় তাকে? হুইস্কির সঙ্গে গিলে ফেলি এই প্রশ্ন। অন্য এক প্রশ্ন জাগে মনে। বাঙালির আড্ডা মরেছে। অনেকদিন হল মরেছে। একালের বাঙালি আড্ডা বহু বছর আগে মরে যাওয়া আড্ডার অবিচুয়ারি।
অনেক দিন আগের একটি বাঙালি আড্ডার কথা মনে পড়ছে আমার। অনেক দিন আগে মানে, কোভিড অতিমারি তখন সবে উঁকি মারছে, সেই সময় একটা গেটটুগেদার! তখনও আমরা এতটুকু আন্দাজ করতে পারিনি কী হতে চলেছে! এবং আমি নিশ্চিত, ওরহ্যান পামুক তখনও দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি, তাঁর মধ্যে ঘুমিয়ে আছে ‘নাইটস অফ প্লেগ’-এর মতো বিপুল এক অতিমারির মহাকাহিনি!
সেই সময়ে কলকাতার গঙ্গাবক্ষে এক কোহলরঞ্জিত নৌকাবিলাসে রাত করে পৌঁছলাম। পার্টি ম-ম করছে। তপ্ত মৌতাত গড়িয়ে নামছে বুকের আঁচল, মুখের উচ্চারণ, নদীর জলের মতোই টলমল করছে চলন-বলন-গলন। আমি কোণের একটি টেবিলে, অপেক্ষাকৃত নিরিবিলির মধ্যে, কিছু চেনা-মুখের সান্নিধ্যে আশ্রিত হয়ে নিশ্চিন্তে চুমুক দিলাম প্রিয় ব্লেন্ডেড হুইস্কিতে। টেবিলের আর সব নারী-পুরুষ দেখলাম সিঙ্গলমল্টে, সমসময়ের হুজুগে সাড়া দিয়ে। আমি সচেতন অশ্লীলতার হিড়িক মেরে, আড্ডাকে কারবাইড-পাকামোতে নিয়ে যেতে, বললাম, আজ সন্ধ্যায় একটা কাণ্ড ঘটেছে। চোখের সামনে। তাই আড্ডায় আসতে দেরি হল।
‘কী কাণ্ড?’– সিঙ্গলমল্ট উথলে ছুটে এল একটিই প্রশ্ন একাধিক মিশ্রিত উৎকণ্ঠায়।
‘আর বলেন কেন? স্রেফ দুর্মতি! একেবারে ভরসন্ধেবেলা, বাঙালির সংসারে, হড়কে গেল সব!
যেন আগুনে ঘি পড়ল! যে যার মতো গলায় সিঙ্গলমল্ট ঢেলে হড়কেই এগিয়ে এলেন আমার দিকে। পুরুষরা বললেন, বলুন দাদা, এতক্ষণ আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। সিঙ্গলমল্টিনীরা মুখে যত না বললেন, বলল তাঁদের বিভাজিকার ঝিলমিলে, ঘর্মবিন্দু। আমি বললাম, ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়, ষোলো-সতেরো বছরের দেওর বছর ছাব্বিশ-সাতাশের বউদির কোলে বসে ভাত খাচ্ছে।
–বলছেন কী! ধরা পড়ে গেছে!
–তা তো বটেই?
–তারপর?
–আরে, বউদির নিজের একটা বাচ্চা আছে। পাঁচ-ছ’বছরের সে কখন কোথায় খাচ্ছে খেয়াল নেই। ষোলো বছরের দেওরকে কোলে বসে খাওয়াচ্ছে।
–ইশ! বলেন কী!
–আবার একটা কাদম্বরী-কেলেঙ্কারি। লিখে বসবেন না যেন, বললেন এক কচি-বয়সিনী!
–কাদম্বরী মানে জানেন?
–না।
–কাদম্বরী, না কি কাদম্বিনী? কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল– এই কাদম্বিনীই তো রবি ঠাকুরের বউদি?
আমি এই গভীর এবং মৌলিক জিজ্ঞাসার কোনও উত্তর না দিয়ে বললাম, কাদম্বরী মানে মদ।
–সিঙ্গলমল্ট না ব্লেন্ডেড? পুরুষ কণ্ঠে এল প্রশ্ন।
–অবশ্যই ব্লেন্ডেড। ব্লেন্ডেড না হলে নারীর আকর্ষণ বাড়ে না। পাওলো কয়েলহোর ‘অ্যাডালটেরি’ পড়েছেন তো?
পুরুষ কণ্ঠ কিছু বলে না।
আমি: জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে পাশের ফ্ল্যাটে।
–আপনি মাইরি ভাগ্যবান! আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে বুড়ো-বুড়ি। কিছু রসের ঘটনার কোনও চান্স নেই। বললেন, সেই কচি-বয়সিনী।
–পাশের ফ্ল্যাটে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে ওই সাতাশ বছরের বউটার মা। তিনি আবার দেওরকে নিয়ে মেয়ের এই আদিখ্যেতা দু’চক্ষে দেখতে পারেন না।
–হেল উইথ হার। বউটার স্বামী জানে? কিছু বলে না? বললেন কবজিতে রোলেক্স ঝিকানো অভিজাত বাঙালি।
আমি বললাম, দাদাকে দেখে নাকি সতেরো বছরের দেওর বউদির কোলে ভাত খেতে খেতে বউদির বুকে মুখ লুকায়! দাদার সামনেই এই কাণ্ড। সেই সময় বউদিটির মাতৃদেবীও এসে পড়লেন। অবস্থা খারাপ, দেখেই বুঝলেন। এবং বললেন মেয়েকে, তোর কি সত্যি কাজকম্ম নেই? দেওরকে নিয়ে সোহাগ হচ্ছে? নিজের ছেলেটা কোথায়, তার হদিশ রাখিস?
–তারপর?
–তারপরই তো আসল খেলা, বলি আমি। দেওর কী করেছে জানো?
সবাই চুপ। কেলেঙ্কারিটা কতদূর গড়াতে পারে, সব্বাই জানতে উৎসুক।
আমি বললাম, দেওর তখন জোর করে নিজের মুখটা বউদির বুক থেকে টেনে হিচঁড়ে তুলে আনল। তারপর বউদির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছে, ওই ডাইনির আমি গলা টিপে দেব!
–ইশ! কী অসভ্য!
–রাস্কেল! পিটিয়ে সোজা করে দিতুম, আমি থাকলে, বলেন মিস্টার রোলেক্স।
–ভদ্র বাড়িতে এই ভাষার কথা? বললে মুক্ত গভীর সাহসী বিভাজিকার মিসেস সেন!
–যা কিছু ঘটেছে, সব কিছুর জন্য কিন্তু দায়ী শরৎবাবু।
–একদম ঠিক। মেনি মুখো ব্যাটাছেলে। বউটা ঘরের মধ্যে দেওরকে কোলে করে বসে ভাত খাওয়াচ্ছে।
–শুধু ভাত খাওয়াচ্ছে? বুকের মধ্যে দেওরের মুখ এমনভাবে চেপে ধরেছে যে দেওর রীতিমতো টেনে বের করছে সেই মুখ।
–শরৎবাবু এসব দেখেশুনে নীরব? বউটা যা করছে, বেশ করছে। বললেন কচি-বয়সিনী। আমি গলায় অনেকটা হুইস্কি একসঙ্গে ঢেলে, প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে, ধীর উচ্চারণে বললাম, দেখুন, ব্যাপারটা আমার পাশের ফ্ল্যাটে ঘটেনি। ঘটেছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্পে। গল্পের নাম ‘রামের সুমতি’। ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের বউদিটির নাম নারায়ণী। ষোলো-সতেরো বছরের দেওরকে নারায়ণী প্রতিদিন একলা ঘরে বসে, কোলে করে, ভাত খাওয়ায়। সেদিন নারায়ণীর মা দিগম্বরী নারায়ণীকে বলল, সতের বছরের দেওরকে কোলে বসিয়ে খাইয়ে দিচ্ছিস, এ কেমনধারা ব্যাপার নারায়ণী, সেদিন রাম কী করল মনে আছে আপনাদের?
ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়াদের দিকে তাকিয়ে মনে হল, ‘রামের সুমতি’ তাদের স্মৃতিতে আলোকবর্ষ দূরের কিছু। শরৎচন্দ্র কবে হারিয়ে গেছেন সুদূর ছায়াপথে! আমি সেই দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য না করে বললাম, দেওরটি তখন বউদির বুকে মুখ লুকিয়ে। সেই মুখ বুক থেকে তুলে বউদির মার দিকে তাকাল সে। কীভাবে জানেন?
–কীভাবে? কণ্ঠে ঈষৎ কম্পন নিয়ে জানতে চান মিসেস সেন।
আমি বললাম, শরৎচন্দ্র লিখেছেন, ‘রাম তৎক্ষণাৎ মুখ তুলিয়া চাহিল। তাহার চোখ দুটি হিংস্র শ্বাপদের ন্যায় জ্বলিয়া উঠিল।’
কেউ কিছু বললেন না। কারও চোখে বোধের কোনও আলো জ্বলল না।
আমি বললাম, বুঝতে পারছেন না, এই সেই প্রাইমাল, আদি ক্রোধ, যার মধ্যে ফুটে উঠছে, রামের তীব্র যৌনতা। সবাই এমব্যারেসড হলেন সম্ভবত। কিন্তু কেউ হ্যাঁ-না, কিছুই বললেন না।
আমি বলতে লাগলাম: নারায়ণী এবার তার মায়ের সামনেই তার দেওরের মুখ জোর করে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে মাকে জানিয়ে দিল, রাম ছাড়া তার জীবনে কেউ নেই, রামের ভালোবাসাই তার বেঁচে থাকার একটি মাত্র কারণ। ‘রামের সুমতি’ গল্পে কিন্তু ক্রমশ রাম ও নারায়ণীর সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠছে। নারায়ণী আর রাম– দু’জনেই বুঝতে পারছে, পরস্পরকে ছেড়ে যাওয়া অসম্ভব।
এরপর শরৎচন্দ্র কী বিপজ্জনক জায়গায় এই আপাত সরল সোজা গল্পটাকে নিয়ে যাচ্ছেন, আপনারা কখনও ভেবে দেখেছেন? কেউ উত্তর দিলেন না। দু’-একটা হাই উঠল। মিসেস সেন বিপুল বিভাজিকা প্রসারিত করে স্ট্যাচু হয়ে গেলেন।
আমি এবার গল্পটা শেষ করতে পারলে বাঁচি: নারায়ণীর স্বামী তার মাথার দিব্যি দিয়ে স্ত্রী নারায়ণীকে রামের সঙ্গে দেখা করতে বারণ করল। বাড়িও দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। রামকে নির্বাসিত হতে হল তার ভাগে। মাঝখানে পাঁচিল উঠে গেল।
এরপর কী?
কারও কিছু মনে পড়ল না।
বললাম, এর পর শরৎচন্দ্র বোঝালেন তিনি কোন মাপের লেখক। কী দুঃসাহস তাঁর।
তিনি লিখছেন: নারায়ণীর মা একদিন রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন সাজানো ভাতের থালার সামনে রাম নারায়ণীর কোলে। রামের বুক নারায়ণীর বুকের গভীরে।
বলে উঠল নারায়ণীর মা: আমার জামাই যে এত বড় দিব্যিটা দিল, সেটা ভেসে গেল বুঝি?
এর উত্তরে নারায়ণী রামের মুখটি নিজের বুকের গভীর থেকে তুলে তার কপালে চুমু খেল।
নারায়ণীর মা বলল, আমার আর এখানে থাকা চলে না। আমি এখান থেকে বিদায় নিচ্ছি।
নারায়ণী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সে বলে, মা, আমি এই কথাটাই তোমাকে মুখ ফুটে বলতে পারছিলাম না!
আমি থামি। বেশ কিছুক্ষণ থেমে থাকি। বিভাজিকা-বিলাসিনী ক্রমাগত হাই তুলতে থাকেন। মিস্টার রোলেক্স যুৎসই কিছু বলতে পারেন না। মিসেস সেনের মুক্ত রূপের দিকে তাকিয়ে বলেন, গঙ্গার গুমটে বড্ড ঘামছেন মিসেস সেন!
আমি উঠে পড়ি। যে-কথাটা বলতে গিয়েও বলি না, তা হল, দেওর-বউদির চাপা যৌনতা নিয়ে এমন গল্প বাংলায় কেন, বিশ্বসাহিত্যে বিরল। আড্ডা জমতে পারত এখান থেকে। চলতে পারত ভোররাত পর্যন্ত। কিন্তু কোথায় সেই বাঙালি? বাঙালির আড্ডা নিয়ে লিখতে গিয়ে তা-ই বাঙালি-আড্ডার এই অবিচুয়ারি!