একজন শক্তপোক্ত পাহাড়ি লোককে ঘিরে ধরেছে একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে। বাবা বলেছিল ‘ওই দ্যাখ, তেনজিং নোরগে।’ ক্লাস ফোরে পড়ি, তেনজিং-এর ছবিও দেখেছি, কিন্তু সামনে থেকে অমন একজন বিখ্যাত মানুষকে রাস্তায় ঘুরতে দেখব এটা বিশ্বাস হচ্ছিল না, বেশিরভাগ নেপালির চেহারা তো একই ধাঁচের হয়। তাছাড়া চান্স পেলেই বাবা এই ধরনের ঠাট্টা করত। লোকটা সত্যিই কে ছিল, এ নিয়ে আমার মনে এখনও কিন্তু একটা ধন্দ রয়ে গিয়েছে।
১৯৭২ সালে প্রকাশিত ‘বাতিকবাবু’ গল্পে সত্যজিৎ রায় জলাপাহাড় রোডকে বলেছিলেন দার্জিলিং-এর সবথেকে মনোরম আর নিরিবিলি রাস্তা। এর প্রায় ৩০ বছর বাদে গিয়েও দেখেছি, জায়গাটা বলতে গেলে সেইরকমই রয়েছে। একসময় সন্ধের ঝোঁকে কনকনে ঠান্ডাকে পাত্তা না দিয়ে, জাকির হোসেন রোডের শ্যামলদার হোটেল থেকে একটু চড়াই উঠে, জলাপাহাড়ের যে জায়গাটায় পৌঁছতাম– সেখানে আবছা অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখতে পাওয়া যেত মাথার ওপরে আকাশ-ভর্তি নক্ষত্র। আর সামনে সমস্ত পাহাড় জুড়ে ঝিকমিক করছে অজস্র আলোর ফুটকি। ইদানীং সকালের দিকে কেভেন্টার্সে ব্রেকফাস্ট সেরে অন্য রুট নিই জলাপাহাড়ের জন্য। গান্ধি রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাঁদিকে পাহাড়ের গায়ে বহুকাল বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা বিশাল ভগ্নপ্রায় মাউন্ট এভারেস্ট হোটেলের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াই। প্রতিবার ভাবি, ছোটবেলায় যখন এসেছিলাম, এর আশপাশেই তো ছিল বাবাদের অফিসের সেই হলিডে হোম। এই রাস্তায় দাঁড়িয়েই তো দেখেছিলাম একজন শক্তপোক্ত পাহাড়ি লোককে ঘিরে ধরেছে একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে। বাবা বলেছিল ‘ওই দ্যাখ, তেনজিং নোরগে।’ ক্লাস ফোরে পড়ি, তেনজিং-এর ছবিও দেখেছি, কিন্তু সামনে থেকে অমন একজন বিখ্যাত মানুষকে রাস্তায় ঘুরতে দেখব এটা বিশ্বাস হচ্ছিল না, বেশিরভাগ নেপালির চেহারা তো একই ধাঁচের হয়। তাছাড়া চান্স পেলেই বাবা এই ধরনের ঠাট্টা করত। লোকটা সত্যিই কে ছিল, এ নিয়ে আমার মনে এখনও কিন্তু একটা ধন্দ রয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: কালীঘাট মানেই পুরনো কলকাতার স্বাদ-গন্ধ
মাউন্ট এভারেস্ট থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে পাহাড়ের গা বেয়ে লালকুঠি হয়ে জাপানি মন্দির যাওয়ার রাস্তাটায় উঠে যাই একটা বড় তেমাথার মোড় অবধি। একপাশে একটা ছাউনি দেওয়া বসার জায়গা আছে। সেবার গোর্খাল্যান্ডের ঝামেলা একটু থিতিয়ে যাওয়ার পরেই এখানে এসে স্কেচ করছি, দেখলাম, আমার পিছনে এসে ভিড় করেছে কিছু স্থানীয় লোক। বেগতিক দেখে পাততাড়ি গোটাতে যাব, ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল, ‘আপ শান্তিসে বানাইয়ে, অভি সব ঠিক হ্যায়।’ বয়স্ক লোকটির নাম শরমন রাই, আলাপ হল তারপর ওর একটা ছবিও এঁকে নিলাম।
লালকুঠির দিকে না গিয়ে এরপর বাঁদিকের রাস্তা ধরে উঠতে শুরু করি জলাপাহাড়ের দিকে। কপাল ভাল থাকলে একদিকে ঝলমল করবে কাঞ্চনজঙ্ঘা, একেবারে শেষ মাথায় রয়েছে সেন্ট পল’স স্কুল, শুনেছি ইংরেজ অভিনেত্রী ভিভিয়ন লে-র জন্মস্থান। তবে কড়া পাহারা ফটকের সামনে, তাই বাইরে থেকে সামান্য উঁকিঝুঁকি মেরে চলে আসতে হয়। মনখারাপ হয়ে যায় যখন দেখি, গত দশ বছরে কী ভীষণ ঘিঞ্জি হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: আমার ছবি আঁকার ভিডিও করতে গিয়ে একজন কেভেন্টার্সের ছাদ থেকে পড়েই যাচ্ছিলেন!
এখানকার রাস্তাগুলো, একের পর এক কংক্রিটের সব ঘরবাড়ি হয়ে চলেছে, ফলে সেই খোলামেলা ভাবটা বেবাক উধাও। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড়-টাহাড় কিস্যু দেখা যায় না। ২০০০ সালে গিয়ে হঠাৎই আবিষ্কার করেছিলাম ২০০ বছরের পুরনো বিশাল কাঠের সেই বাংলো, যার একটা অংশে তখন ছিলেন এখানকার সরকারি কলেজের রসায়নের অধ্যাপক কিরণময় লাহিড়ী। অকপটে শুনিয়েছিলেন গোর্খা আন্দোলনের সময় নিজেরই সব ছাত্র কীভাবে তাঁর মুন্ডু কেটে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। সেই ফায়ারপ্লেস আর চিমনিওলা সাবেক বাড়িখানা কালের নিয়মে কবেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, বছর পাঁচেক আগে শেষবার গিয়ে অনেক এধার-ওধার করেও চোখে পড়েনি পাশাপাশি দাঁড়ানো সেই বিশাল উঁচু পাইন গাছ দুটোকে।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। ১৯১০-এ লক্ষ্মীনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাঁহী’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির নিজত্বকে যুক্তিনিষ্ঠভাবে প্রকাশ করেছিলেন।