৮৫ বছর ছুঁয়ে কীরকম আছেন মনোজ মিত্র? সোশাল মিডিয়ায় তাঁকে নিয়ে নিরন্তর গুজব রটেছে সাম্প্রতিককালে। রোববার.ইন পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর বাড়ি। জানা গেল, তাঁর সাজানো বাগান নিয়ে বড় করে কাজ করার স্বপ্ন। নিজের বই থেকে পড়ে শোনালেন একাংশ। স্মৃতি তাঁকে নিয়ে গেল এ-গলি ও-গলি। আসুন, মনোজ মিত্রর সঙ্গে সেই স্মৃতির গলিতে হেঁটে বেড়াই। অহেতুক গুজবের উত্তরে রইল এই কথাবার্তার টুকরোটাকরা। রোববার.ইন-এর পক্ষ থেকে সে কথা শুনেছেন তিতাস রায় বর্মন। ছবি: সায়ন্তন ঘোষ।
তখন ভরা কোভিড। ফোনে ভেসে উঠল ‘মনোজ মিত্র কলিং’। ধরলাম। নানা কথা পেরিয়ে বললেন, ‘একদিন বাড়ি এসো। আড্ডা মারব।’ বুঝতাম, ‘লকডাউন’ ব্যাপারটা বিশ্বাস হয়নি এখনও। তাই লোকসঙ্গ চাইছেন। অদূরেই থাকতাম আমি। তবুও নিয়ম না মানার সাহস আমার ছিল না। আর যাওয়া হয়নি। তবু, মাঝেসাঝে খোঁজ নিতে ফোন করলেও প্রতিটি ফোনে দেখা করার, আড্ডা মারার প্রসঙ্গ একবার না একবার উঠতই। অবশেষে গেলাম, তিন বছর পর। যখন স্মৃতি আর জোরালো নয়, তবুও ছোটবেলার জেদ নিয়ে বেঁচে আছেন মনোজ মিত্র। সল্টলেকের বাড়িতে ঢুকে গিয়ে বসলাম তাঁর লেখার ঘরে। একটা বড় লেখার টেবিল। খাতাপত্র গোছানো, কিন্তু গোছানো না। আর ঘরের ছাদ অবধি বইয়ের তাক। তারই মাঝে ছোট্ট বসার আয়োজন। ওঁকে যিনি দেখাশোনা করেন– আশাদিদি, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শরীর কেমন এখন? কথা বলতে অসুবিধা হবে না তো?’ ‘না না, একেবারেই নয়। বরং আনন্দ পান লোক আসলে, কথা বলতে পারলে।’ কিছুক্ষণ পর টিপটপ সেজেগুজে তিনি এলেন। অল্প অল্প পায়ে। একগাল হাসিমুখ নিয়ে। ‘তিতাস, কতদিন পর দেখা পেলাম।’ আমিও আলতোভাবে অযথা কিছু অজুহাত দিলাম। কথা শুরুর আগে বই এগিয়ে দিলাম সই করার জন্য। বইয়ে যা লিখলেন, বুঝলাম স্মৃতি নিভে নিভে আসলেও অভিমান এখনও জোরালো। অনায়াসে তা প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে।
–তিতাস, তুমি অনেক পাল্টে গেছ। তোমায় চিনতে পারছিলাম না।
–হ্যাঁ, তা ঠিক। আপনার মনে আছে আপনার রোববারের অফিসে আসা, সবাই মিলে একসঙ্গে চপ-মুড়ি খাওয়া? দ্রুত পায়ে চারতলা উঠে গেছিলেন।
মনে আছে, কিন্তু মনে থাকার এক মুশকিল আছে। সেটা আবার রিপিট করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু এখন তো আর সেসব পারব না। আর কি চারতলা ওঠা সম্ভব?
তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আবার চলে আসুন রোববারের দপ্তরে। এখন তো রোববার.ইন-ও হয়ে গেছে।
না না, ততও অসুস্থ নই আমি। ঠিকই তো আছি।
এখনও আমাদের কথায়-কথায় আপনার ‘মনোজাগতিক’-এর প্রসঙ্গ উঠে আসে। এত ভালো একটা কলাম লিখেছিলেন আপনি। কী বিস্তার এই ধারাবাহিকটার।
হ্যাঁ, আনন্দ পেয়েছিলাম ওই লেখাটা লিখে। অনেকদিন লিখেছি। সব এখন মনেও নেই যদিও।
(কথাটা বলে ‘মনোজাগতিক’-টা হাতে তুলে নিলেন। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মাঝে মাঝে থমকে যাচ্ছেন। হয়তো কিছু কিছু ভুলে গেছিলেন। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আবার মনে পড়ে যাচ্ছে। এক-একটা জায়গা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, এটা আমি লিখছিলাম না? স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে কখনও কখনও অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ বললেন–)
মন্মথ রায় আমাকে খুব ভালোবাসতেন। এত ভালোবাসার কথা না লিখলে হত? লিখতেই হত আমাকে মন্মথদার কথা।
মন্মথ রায়কেই কি নাট্যগুরু হিসেবে মানেন?
অবশ্যই। যা কিছু শেখা, ওঁর থেকেই।
কলকাতার নাট্যজীবনের কথা লিখতে লিখতে আপনি বারবার ফিরে যেতেন ওপার বাংলার কথায়। খুব মনে পড়ে ওদেশের কথা? ছোটবেলার কথা?
মনে পড়লেই বা কী! ফেরত তো যেতে পারব না। স্মৃতি শুধুই কষ্ট বয়ে আনে। তবে অনুভবগুলো একটু একটু করে কমে আসছে। এমন কিছু প্রত্যাশাও গড়ে ওঠেনি এর মধ্যে, যা নিয়ে নতুন করে কিছু লেখা যায়। শুধু ছেলেবেলার কথা লিখতে ইচ্ছে করে। আমার এই লেখাগুলো লোকে পড়ে এখনও? এটাই তো আশ্চর্যের কথা!
বহু লোকে পড়ে। আপনার লেখা তো আজ থেকে নয়, বহুদিন ধরে পঠিত, বহুল পঠিত।
শুনে ভালো লাগল। আমি এতটা জানতাম না।
(আবারও নিজের বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখা। এবার চোখে বিস্ময়!)
তবে জানো তো, আমার বিপিনবাবুকে খুব মনে পড়ে। আমার মাস্টারমশাই ছিলেন। স্কটিশের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। অসাধারণ মানুষ ছিলেন। যারা ওঁর কাছে টিউশন পড়তে চায়, তাদের কলেজ থেকেই ডেকে নিয়ে যেতেন। তার মধ্যে আমিও ছিলাম। উনি কিন্তু কোনও পারিশ্রমিক নিতেন না। বিনে পয়সায় পড়াতেন। এবং ওঁর বাড়িতে গিয়ে পড়তে হত। ক্লাসের পর, দুপুরবেলায়। সাড়ে তিনতলায় ওঁর পড়ানোর ঘর ছিল। রোদ তখন মিলিয়ে যেত। পড়া শেষ হয়ে গেলে ওখান থেকে বেরিয়ে যেতাম রসগোল্লা খেতে। বিপিনবাবুই খাওয়াতেন। পড়ার সঙ্গে রসগোল্লা খাওয়াটাও জুড়ে যেত বিপিনবাবুর কল্যাণে। বিপিনবাবুকে নিয়ে লিখব একদিন।
হ্যাঁ। আরও বিশদে জানতে ইচ্ছে করছে। আপনি লিখুন। আমরাও সেই সময়টা একটু জানি।
লিখব। কত কথাই যে মনে পড়ে যাচ্ছে এগুলো বলতে বলতে। ওদেশের কথাও।
উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে আসা কি নাট্যচর্চায়, নাট্যচর্যায় কোনও প্রভাব ফেলেছিল?
সেভাবে স্পষ্টভাবে আসা নয়। কিন্তু দেশ হারানো, জমি হারানো ছেলেপুলেদের কাছে আর কী বা ছিল বেঁচে থাকার মতো? নাটকই ছিল। নাটকের প্রতি টান আমার আগে থেকেই ছিল। ছোটবেলা থেকে নাটক দেখতাম, নাটক করতাম। কিন্তু নাটককে জীবনের সঙ্গে জুড়ে নেওয়ার পিছনে আমার শিকড়-ছেঁড়া অতীতের অবদান রয়েছে।
আপনি বলেছিলেন যে, থিয়েটার করতে হলে ধারদেনা করেও করা উচিত। এই প্যাশন কোথা থেকে আসে?
মানুষের কিছু কিছু জেদ আছে, যেগুলো থেকে যায়। কোথাও না কোথাও। তবে, সবসময়ই যে জেদটা তৈরি হবে, এমন কোনও কথা নেই। কিন্তু যাদের হয়, তাদের রয়ে যায়। কেউ যদি চায় আমি এটা করব, সে সেটা করে। এবং সেটা সে করে যায়। বাধা আসে, বাধা পেরনো যায়। জেদ থেকেই সাফল্য আসে। পরে তো দেখলাম, লোকে ভালো বলছে, লোকের মনে আছে। অনেকের খারাপও লেগেছে নিশ্চয়ই।
আপনি বলেছিলেন প্রথমবার নাটক দেখার পর দর্শকের রিঅ্যাকশন দেখার জন্য আপনার আকুলিবিকুলি। সেই অভ্যাস কতদিন ছিল?
সবসময়ই ছিল। যতবার মঞ্চে উঠেছি, ততবার দর্শকের প্রতিক্রিয়ার জন্য ছটফট করেছি। মানুষের ভালো লাগাই তো আমাদের পারিশ্রমিক। দর্শক কী দেখল, কী দেখতে পেল না, দর্শন কোথায় বদলে গেল। নিজের কাজের মূল্যায়ন তো নিজে করা যায় না, তাই দর্শকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা। লেখালেখির ক্ষেত্রেও তো তাই। পাঠক যতক্ষণ না প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, ততক্ষণের রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা।
ছোটবেলায় তো গল্প লিখতেন। একসময় ইচ্ছে ছিল গল্পকার হওয়ার।
হ্যাঁ, আগে শুধু লিখতেই চাইতাম। স্কুলের দেওয়াল পত্রিকা থেকে লেখালেখি শুরু। সে কী আয়োজন। তবে লিখতে চাইতাম বটে, পারতাম কি না জানি না। এদেশে চলে আসার পরও লিখেছি গল্প। কিন্তু ততদিনে নাটক আমাকে পেয়ে বসল। হয়তো দেশভাগ, সহায়সম্বলহীন মানুষের নাটকই থাকে। এখানে একটা অবশ্য ব্যাপার আছে। যা নিয়ে লিখতে চাইতাম, পরে সেই বিষয়গুলো নিয়েই নাটক লিখেছি। আসলে লেখাটা কখনও ছাড়েনি। যা লিখতে চেয়েছি, শেষমেশ তা লিখেছি।
গল্প লিখেছেন, নাটক লিখেছেন, নাটক করেছেন, সিনেমা করেছেন, বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি রয়েছে, তার ওপর শিক্ষকতাও করেছেন– এই যে এত জমজমাট ব্যাপ্ত জীবন। সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছেন কোন সময়টায়?
এখন তো স্কটিশ চার্চের কথা বেশি মনে পড়ে। আমার কলেজবেলার কথা। কী করেছি, কোথায় করেছি, সেসব মনে পড়ে না, মনে করি না। বরং আমার বন্ধুদের কথা, বিপিনবাবুর কথা বেশি মনে পড়ে। কলেজের অধ্যাপকদের এখনও সেই সম্মান ও আনুগত্য আমার রয়েছে। তাঁরা কেউই আর নেই যদিও। বন্ধুরা মিলে অধ্যাপকদের নিয়ে কত মজা করেছি। সেইসব খুব সুখের স্মৃতি।
শেষ কবে নাটক দেখতে গেছেন?
অসুস্থ হওয়ার ১০ দিন আগেই গিয়েছি।
আর লেখালেখি?
লেখালেখি করি তো। কেউ বললেই লিখব। অসুস্থ হওয়ার আগে প্রতিদিনই লিখতে বসতাম, এখন একটু কমে গেছে। একটা বইয়ের কাজ করছি। প্রায় শেষ হয়ে গেছে। মেলানো বাকি। ‘সাজানো বাগান’ নিয়ে এক বড় কিছু করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তাই? আমরা অপেক্ষায় রইলাম। ‘সাজানো বাগান’ নিয়ে অনেক কাজ হল। নাটক থেকে সিনেমা। এই নাটকটা আপনার জীবনের কতটা জুড়ে রয়েছে?
আমার মনে হয়, আমার নিজের কাজের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ‘সাজানো বাগান’। এটাই বোধহয় আমার প্রাণের কাজ। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এর একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে। তপন সিনহা যখন সিনেমা করতে চেয়েছিলেন, শর্ত ছিল আমাকে চিত্রনাট্য লিখতে হবে। আমার ওপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন কীভাবে আমি সিনেমায় এটাকে ইনকর্পোরেট করতে পারি। আমি বলেছিলাম, ‘আর ইউ সিরিয়াস অ্যাবাউট ইট?’ উনি বললেন, আমাকে কি আপনার সিরিয়াস বলে মনে হয় না? আমি হেসে বলেছিলাম, সে তো বটেই। তপন সিনহাও শর্ত দিয়েছিলেন একটা। যতদিন ধরে আমি লিখব, প্রতিদিন আমাকে ওঁকে গিয়ে দেখিয়ে আসতে হবে প্রোগ্রেসটা। ‘যেদিন লিখবেন না, সেদিন আপনাকে আসতে হবে না।’ আমি কিন্তু যেতাম রোজই। খুব অন্য ধরনের মানুষ ছিলেন তপন সিনহা। ও আমার খুব কাছের মানুষও ছিলেন। শুটিংয়ের গল্পগুলো আমি ‘মনোজাগতিক’-এ লিখেছি।
সিনেমা না থিয়েটার– কোনটা বেছে নেবেন?
থিয়েটার। ‘মনোজাগতিক’ থেকে একটু পড়ে শোনাব তোমাদের?
(একটা পাতা খুলে পড়তে শুরু করলেন। এতক্ষণ যে স্বরে, যে ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন, বদলে গেল সব। মনে হল, ঘরের আলো কমে এসে স্পট লাইট জ্বলে উঠল। চোখের সামনে দেখলাম লেখক মনোজ মিত্র, স্মৃতি-হাতড়ানো মনোজ মিত্র, উদাসীন মনোজ মিত্র মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। কোনও প্রস্তুতি নেই। বা হয়তো গোটা জীবনটাই তাঁর মঞ্চে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি। উচ্চারণ দৃপ্ততর হল। চোখ উজ্জ্বল। ভাঙা স্বরে ঈশ্বর এসে বসল। দর্শক আছে না নেই, পরোয়া নেই। তিনি একা। মঞ্চে। স্বভাবে। তেজে।
আমরা দর্শকাসনে বসে অন্ধকারকে অনুভব করতে পারলাম। আমরা অন্ধকারে, তিনি আলোয়, স্পট লাইটে। কতক্ষণ সময় কেটে গেছে, খেয়াল নেই। হয়তো সামান্যই, পনেরো মিনিট। কিন্তু আমাদের কাছে অনন্ত। হয়তো তাঁর কাছেও। অবশ্যই তাঁর কাছে।)
তোমরা এলে আমার দিনটা ভালো কাটে। কিন্তু রোজ রোজ তো কেউ আসে না।
ফিরে আসার আগে, পড়ার টেবিলের দিকে চোখ গেল। তিনটে রুলটানা লেখার খাতা। একটা খাতায় সুন্দর করে লেখা, ছোট ছোট অক্ষরে লেখা। আরেকটা রাফ খাতা। মনের খেয়ালে লেখা। তিন নম্বর খাতাটা মাঝপথ থেকে খালি। লিখছিলেন অনেকদিন ধরে। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আর টেবিলে গিয়ে বসা হয় না। তবে নিশ্চিত জানেন কয়েকদিন পরই আবার লিখবেন। যে জেদের কথা শুরুতে বলেছিলেন, সেই জেদের কাছে নিজেও তো সমর্পিত। লিখবেন, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বইটা শেষ করবেন, আমরা নিশ্চিত।
…পড়ুন অন্যান্য সাক্ষাৎকার…
রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার: সত্যজিৎ বলেছিলেন, তোমার আঁকায় সই লাগে না
সন্দীপ রায়ের সাক্ষাৎকার: সন্দেশে লেখকদের পারিশ্রমিক ছিল লেখার সঙ্গে বাবার অলংকরণ
শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার: থিয়েটার আর বেঁচে থাকার মধ্যে খুব একটা দূরত্ব নেই