এই গ্রন্থে অতীত ও বর্তমানের উপস্থিতি সমান্তরাল অবস্থানে। যে বর্তমানকে তুলে ধরেছেন লেখক সেটাও আজকের কথা নয়, বছর তিরিশেক আগের অতীত, দেশ তখন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপনের দোরগোড়ায়। ফলে ঘষা কাচের মতোই স্মৃতি ভিড় করেছে এই আখ্যানে, মন্থর গতিতে। যা পাঠ শেষে ফেরিওয়ালার হাঁকের মতোই মায়া রেখে যায় পাঠকের মনে।
উপন্যাস কিংবা আখ্যান নির্মাণে প্রয়োজন পড়ে একটা আধার বা পটভূমিকার। অঞ্চল কিংবা জনপদ অনেকক্ষেত্রে সেই ভূমিকা পালন করে। হয়ে ওঠে আখ্যানের পরিপ্রেক্ষিত। প্রয়োজন কিংবা রুজি-রোজগারের তাগিদে অনেকক্ষেত্রে লেখক সেই স্থানে যান, সেখানে থাকার সূত্র ধরে স্থানীয় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। ভবঘুরে জীবনে সেই খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতা কল্পনার সাযুজ্যে হয়ে ওঠে একটা নিটোল গল্প। লেখকের সৃজনে ভাব ও ভাবনার সঙ্গে সংযোগ ঘটে পাঠকের। কৌশিক বাজারীর ‘ফেরিওয়ালার ডায়েরি’ তেমনই বিশেষ এক আখ্যান, যেখানে কল্পনার সঙ্গে মিশেছে বাস্তব। অভিজ্ঞতার মেলবন্ধন ঘটেছে উপলব্ধির সঙ্গে।
‘ফেরিওয়ালা ডায়েরি’ আদপে এক যাত্রিকের জীবনের গল্প। যে যাত্রার শুরু আছে। শেষ নেই। আর সেই অভিযাত্রিক আর কেউ নন, লেখক স্বয়ং। তাঁর জীবন-অভিজ্ঞতা নিজস্ব ন্যারেটিভে ইতস্তত এগিয়ে চলে কালি-কলমের হাত ধরে। যেমনভাবে পথের ধুলোমাটি গায়ে মেখে এগিয়ে চলে পসারের ঝুলি কাঁধে ফেরিওয়ালা। লেখকও সেই অজানা পথে পা রেখেছেন অসচ্ছল পরিবারে অর্থ উপার্জনের ভাবনায়, জুটিয়ে নিয়েছেন ফেরিওয়ালার কাজ। আর সেইসঙ্গে আপন করে নিয়েছেন পথ ও পথের প্রান্তকে। সেই পথের নেশা শুধু ক্লান্ত ও রিক্ত করেনি লেখককে। শিখিয়েছে সঞ্চয়। সেই সঞ্চয় জীবনকে দেখার ও বোঝার উপলব্ধিতে ভরপুর।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পথের নেশার সূত্র ধরেই লেখকের জীবনে ভিড় করে এসেছে সুরা, নিত্য, নয়ন, নৌসাদ কিংবা ওড়িশার মধুপুর থেকে দলে ভিড়ে যাওয়া ঠাকুরের মতো বিচিত্র মানুষগুলো। যাদের চোখে লেখক আদপে স্নেহের ‘কানাই’, ‘রাইটার’ বলে তাঁর আলাদা খাতির। সেই মানুষগুলোর জীবনস্রোত লেখকের মনকে যতবার ধাক্কা দিয়েছে, তত উপলব্ধি করেছেন এক গভীর টান। সেই আকর্ষণ আসলে ফেলে আসা নিস্তরঙ্গ আটপৌরে জীবনের প্রতি, যেখানে কড়িবর্গার অন্ধকারে জমাট বেঁধে থাকে মাকড়শার সংসার, স্থির হয়ে থাকে সন্ধ্যাপ্রদীপ হাতে মায়ের মায়াঘন মুখ। সর্বপরি সেই পিছুটান আসলে ফেলে আসা জীবনের শ্রেষ্ঠ সমকাল– কৈশোরের প্রতি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ফেরিওয়ালা-রূপী লেখকের সেই ঝোলায় ভিড় করে এসেছে শহরবাসের কথা। সেই শহর কলকাতার মতো মেট্রোপলিটান-সিটি নয়। বরং মফসসল-ঘেঁষা ঝাড়খণ্ডের বোকারো, ধানবাদের কোলিয়ারি অঞ্চল। যেখানের মাটি লেখকের জন্মভূমি বাঁকুড়ার মতো উঁচুনিচু ল্যাটেরাইটের কাঁকর-প্রান্তর নয়, যাকে লেখক বলছেন– ‘রামকিঙ্করের ভাইটাল মেটেরিয়াল’। বরং সেই পরিযায়ী জীবনে খুঁজে পাওয়া কর্মভূমির বিস্তৃত অঞ্চল চাপ-চাপ কয়লার মতো নিকষ কালো। তোপচাঁচি, পাঞ্চেত, ভজুদিহ, দুমকা, চাসনালার মতো খনিখাদময় কয়লার স্তূপে আবদ্ধ জীবনকে যেমন দেখেছেন লেখক, তেমনই উঠে এসেছে বিহারের মুঙ্গের, ভাগলপুর জেলার কাহালগাঁও, পৈরপৈঁতির মতো প্রত্যন্ত দেহাতগুলি। লেখকের কাজ একটাই– কথার ফাঁদে ফেলে তাঁকে মাল বেচতে হবে। কোলিয়ারি বস্তিতে, দেহাত অঞ্চলে ঘুরে মহল্লায় মহল্লায় বিক্রি করতে হবে ঝোলায় ভরা সুগন্ধি তেল, পাউডার, পমেটম, নানা হরেকমাল। সেই বিক্রিবাটার সূত্রেই ‘ফেরিওয়ালা’ লেখক চিনেছেন এক অন্য ভারতবর্ষকে। যে ভারতবর্ষ তিন খণ্ডে বিভক্ত– ‘একদিকে শীততপ নিয়ন্ত্রিত কাচ-ঢাকা কোলিয়ারি মালিকের অফিস থেকে হুস করে বেরিয়া আসছে টাটা-কোম্পানির সফেন সুমো গাড়ি, আর অন্যদিকে ওপেন-কাট মাইন থেকে লৌহ-যুগের গাঁইতি-কাঁধে উঠে আসছে অর্ধনগ্ন কালো মানুষের দল।–মাঝখানে সস্তার পটেটম, চুড়ি, মালা, চিরুনি, দাঁতের মাজন, সুগন্ধি তেল ভরা থলি হাতে এই অদ্ভুত তৃতীয় বিশ্বের ফেরিওয়ালা।’
পথের নেশার সূত্র ধরেই লেখকের জীবনে ভিড় করে এসেছে সুরা, নিত্য, নয়ন, নৌসাদ কিংবা ওড়িশার মধুপুর থেকে দলে ভিড়ে যাওয়া ঠাকুরের মতো বিচিত্র মানুষগুলো। যাদের চোখে লেখক আদপে স্নেহের ‘কানাই’, ‘রাইটার’ বলে তাঁর আলাদা খাতির। সেই মানুষগুলোর জীবনস্রোত লেখকের মনকে যতবার ধাক্কা দিয়েছে, তত উপলব্ধি করেছেন এক গভীর টান। সেই আকর্ষণ আসলে ফেলে আসা নিস্তরঙ্গ আটপৌরে জীবনের প্রতি, যেখানে কড়িবর্গার অন্ধকারে জমাট বেঁধে থাকে মাকড়শার সংসার, স্থির হয়ে থাকে সন্ধ্যাপ্রদীপ হাতে মায়ের মায়াঘন মুখ। সর্বপরি সেই পিছুটান আসলে ফেলে আসা জীবনের শ্রেষ্ঠ সমকাল– কৈশোরের প্রতি। তবু পথের সময় ‘ফেরিওয়ালা’র জীবনে বিশেষ পাথেয় হয়ে থাকে। প্রকৃতির উদাস খেয়ালি প্রান্তরের মতো দাগ কেটে যায় ফেরির জিনিস কিনতে অপারগ দেহাতি বউ, পরিত্যক্ত বিক্রমশীলা মহাবিহার, নিস্তব্ধ রেলস্টেশন। আর? অসংখ্য মানুষ, চোর-ডাকাত, ছিনতাইবাজ, উদার-মস্তান থেকে গৃহস্থ পরোপকারী দোকানি। মনে থেকে যায় ভাগলপুরিয়া ড্রাইভার ইলিয়াস, যে কি না নিস্পৃহচিত্তে কোমরে মুঙ্গেরি পিস্তল গুঁজতে গুঁজতে খানিকটা ‘শ্রীকান্ত’-র ইন্দ্রনাথের মতোই বলে উঠেছিল, ‘মরনা তো একদিন পড়েগা ভাই!’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ভাঙা কাচের মতো ছড়িয়ে থাকা স্বপ্নের আখ্যান
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
লেখকের আত্মকথনে ‘ফেরিওয়ালা ডায়েরি’ লেখা হলেও এই গ্রন্থ আত্মজীবনী নয় কৌশিক বাজারীর। নয় তারাশংকরের উপন্যাস কিংবা বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-এর হুবহু অনুসারি কোনও সাহিত্যকর্ম। এখানে ঘটনা আর কল্পনার পাশাপাশি সহাবস্থান। লেখকের বাবা-মা’র গল্পগুলো বাঁকুড়া লণ্ঠনের আলোয় সময়ের পলেস্তরা খসিয়ে সত্যি হতে চেয়েছে। আর সেই হয়ে উঠতে চাওয়ার প্রয়াসে লেগেছে জাদু-বাস্তবতার স্পর্শ। এই গ্রন্থে অতীত ও বর্তমানের উপস্থিতি সমান্তরাল অবস্থানে। যে বর্তমানকে তুলে ধরেছেন লেখক সেটাও আজকের কথা নয়, বছর তিরিশেক আগের অতীত, দেশ তখন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপনের দোরগোড়ায়। ফলে ঘষা কাচের মতোই স্মৃতি ভিড় করেছে এই আখ্যানে, মন্থর গতিতে। যা পাঠ শেষে ফেরিওয়ালার হাঁকের মতোই মায়া রেখে যায় পাঠকের মনে।
ফেরিওয়ালার ডায়েরি
কৌশিক বাজারী
ধানসিড়ি
মূল্য ২৭৫ টাকা