এই তো, হাতের স্মার্টওয়াচে কানেক্টেড অক্সিজেন ক্যাপসুল। যদি শ্বাসবায়ু কমে আসে, অমনি দুয়ারে অক্সিজেন, মানে অ্যাপ। দু’মিনিটে ইনস্ট্যান্ট অক্সিজেন। কিন্তু সেই অ্যাপ তৈরি করা মানুষটাই যদি খামোখা গাছ-চাওয়া আবদার করে বসে, তাকে তো আর এসব বলা যায় না। স্রেফ বুড়ো বয়সের ভীমরতি। না হলে পঞ্চাশ বছর আগে শেষবারের মতো দেখা একখানা গাছের জন্য এমন আদিখ্যেতা করবেন অক্সি অ্যাপের মাস্টারমাইন্ড, এ তো শুনিলেও না হয় প্রত্যয়! সে গাছ কবে শান্তির ঘুম ঘুমোতে গেছে, বলতে চেয়েছিল গোয়েন্দা। উলটে একটা আর্তনাদ মাঝপথেই তার কথা থামিয়ে দিয়েছিল, শান্তি না! শান্তি নেই! গায়ের ওপর একেকটা করে কুঠারের কোপ এসে পড়ে যদি, শান্তি হয়, মিস্টার মিত্তির?
একটা গাছ খুঁজতে হবে।
যে গাছে ছোট্ট ছোট্ট সাদা ফুল ফোটে। সবুজ পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়া টিপ টিপ আলোর মতো। যে গাছের কাছে দাঁড়ালে বৃষ্টির মতো ঝরঝরিয়ে নামে আলগা পাপড়িরা। ছুঁয়ে দিতে বলে চুপটি করে। যে গাছটাকে অনেক দিন আর কেউ দেখেনি। সে গাছ, যেন নিজেই এক হারিয়ে যাওয়া সভ্যতা।
অন্য কেউ কথাটা বললে পেটের ভেতর থেকে সমস্ত হাসিটা উঠে আসতে দিত গোয়েন্দা। বাদশাহী আংটিও নয়, নয় গোলাপি মুক্তাও, তার বদলে একটা গাছ? যা পাওয়াই যায় না, তাকে খুঁজে কী হবে! আর তা দিয়েই বা হবেটা কী! অক্সিজেন সাপ্লাই? ওসব আদ্যিকালের কনসেপ্ট, মশাই! একখানা অক্সি অ্যাপই যদি বের করা না যেত, তবে বিজ্ঞানের এত লাফঝাঁপ বৃথাই যেত না! এই তো, হাতের স্মার্টওয়াচে কানেক্টেড অক্সিজেন ক্যাপসুল। যদি শ্বাসবায়ু কমে আসে, অমনি দুয়ারে অক্সিজেন, মানে অ্যাপ। দু’মিনিটে ইনস্ট্যান্ট অক্সিজেন। কিন্তু সেই অ্যাপ তৈরি করা মানুষটাই যদি খামোখা গাছ-চাওয়া আবদার করে বসে, তাকে তো আর এসব বলা যায় না। স্রেফ বুড়ো বয়সের ভীমরতি। না হলে পঞ্চাশ বছর আগে শেষবারের মতো দেখা একখানা গাছের জন্য এমন আদিখ্যেতা করবেন অক্সি অ্যাপের মাস্টারমাইন্ড, এ তো শুনিলেও না হয় প্রত্যয়! সে গাছ কবে শান্তির ঘুম ঘুমোতে গেছে, বলতে চেয়েছিল গোয়েন্দা। উলটে একটা আর্তনাদ মাঝপথেই তার কথা থামিয়ে দিয়েছিল, শান্তি না! শান্তি নেই! গায়ের ওপর একেকটা করে কুঠারের কোপ এসে পড়ে যদি, শান্তি হয়, মিস্টার মিত্তির?
আর্তনাদটা আস্তে আস্তে খাদে নামছিল। যেন মানুষটা শামুকের মতো নিজেই নিজেকে খোলসের ভিতরে ঢুকিয়ে নিচ্ছিল ক্রমশ। আর সেই একান্ত গহ্বরের গহিন থেকে বলার চেষ্টা করছিল, গাছেরা রেগে যাচ্ছে। একদিন আমাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেবে সব্বাই। ও বলত। ও বলেছিল।
গোয়েন্দা এতক্ষণ একটা পায়ের ওপর পা তুলে বসেছিল। এবার পা-টা নামিয়ে নিল। নিজের বাড়িতে থাকলে যার অর্থ হত একটাই, এবার আসুন। বিশ্বের প্রথম সারির এক বিজ্ঞানীর বাড়িতে বসে সে কথাটা বলার উপায় নেই, তবে এই প্রলাপটাকে ও এবার কাটাতে চাইছে। নাকের ডগায় এসে বসা মাছির মতো এই অস্বস্তিটা ওর মোটেও ভালো লাগছে না। মনটা অন্যদিকে ঘোরাতেই হাতে ধরা ডায়েরিটাও উলটে গেল অন্যমনস্কভাবে, একটু আগে যেটা বিজ্ঞানী সবক’টা আঙুলে আঁকড়ে রেখেছিলেন। এ ডায়েরি নাকি তাঁরই, যিনি গাছের কথা বলতেন। যে গাছটা খুঁজে দেওয়ার বরাত মিলেছে, সেই গাছের কাছেই প্রথমবার দেখা হয়েছিল দু’জনের। তারপর আরও অগুনতি বার। কিন্তু একদিকে গাছ-বন-জল-মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা এক মানবী, অন্যদিকে যন্ত্রের নিত্যনতুন আবিষ্কারে মজে তরুণ বিজ্ঞানী, এমন বেজোড় সম্পর্ক মেলে কখনও!
১১ মে, ২০২৪
‘মানুষের থেকে মানুষের দূরত্ব বাড়ে, কিন্তু একটি গাছের থেকে আরেকটি গাছের দূরত্ব বাড়তে কোনও দিন দেখিনি আমি।’ এ কলকাতায় কি এই কথা, এইভাবেই বলা যেত? যে শহরের মুখ ঢেকে গিয়েছে বিজ্ঞাপনে? একটা আধখাওয়া আকাশে ধাক্কা খেয়ে থমকে গিয়েছে গাছের ডাল। মাথাটা এবড়োখেবড়ো করে খুবলে দেওয়া হয়েছে, যাতে হোর্ডিংয়ে টাঙানো জ্যাকুলিন ফার্নান্ডেজের বুক আরও উপচে উঠতে পারে। সেই ক্ষতবিক্ষত কপালে আলতো আদর বুলিয়ে দিতে পারছে না উলটোদিকের গাছের ডাল। কেটেছেঁটে নিজেদের নাগালে এনে তার সারাগায়ে টুনিবাল্বের তার জড়িয়েছে মানুষ। আসলে, মানুষ নিজে ভালোবাসে বলেই দৃশ্য নয়, দূরত্বের জন্ম দেয় প্রতিনিয়ত। গাছের একসঙ্গে থাকাও তাই আমাদের সহ্য হওয়ার কথা ছিল না।
ঠিক আমাদের মতোই।
****************
ডায়েরির লেখাগুলো বড় অদ্ভুত। যেন কোন প্রত্ন যুগ থেকে ভেসে আসা। পাতার পর পাতা জুড়ে গাছের কথা। যেন গোটা খাতাটাই আস্ত একটা অরণ্য। পাতা ওলটালে মাঝে মাঝে একটা শুকনো ফুলের পাপড়ি, কি একটা দূর্বা ঘাস, গাছের পাতাও। শুকিয়ে ঝুরঝুরে। খাতা কলমে এমন হাতে লিখত কে? কবে লিখত? তার মধ্যে যেন এমন আবর্জনাই বা জমিয়ে রাখার মানে কী?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বোঝো! এরা সবাই কি ইতিহাসের পাতা থেকে টপকে পড়েছে? গাছ নিয়ে এমন আদিখ্যেতা করছে কেন! আর বিজ্ঞানীর গোটা ঘরটা জুড়ে তো দিব্যি সুদৃশ্য টবে সাজানো রয়েছে নিয়ন অ্যালগি। কোনও একটা ইন্টেরিয়র ডেকরের ওয়েবজিনে পড়েছিল, দিব্যি অক্সিজেন বানাতে পারে এই অ্যালগিগুলো। গাছের মতোই ফোটোসিন্থেটিক। তার ওপর প্রোক্যারিওটিক বলে তরতরিয়ে জায়গা দখল করে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
প্রশ্নটা শুনে আহত চোখে তাকিয়েছিলেন ওর ক্লায়েন্ট। তারপর চোখ সরিয়ে ফিসফিস করে বলেছিলেন,
‘‘এখন আমার ইচ্ছে করে
জল দিই ফের সেই শিকড়ে
একটি যদি স্থলপদ্ম ফোটে
আঁকশি দিয়ে ন’পিসিমা
পান যদি সেই ফুলের সীমা
দুঃখ আমার থাকবে না আর মোটে।’’
বোঝো! এরা সবাই কি ইতিহাসের পাতা থেকে টপকে পড়েছে? গাছ নিয়ে এমন আদিখ্যেতা করছে কেন! আর বিজ্ঞানীর গোটা ঘরটা জুড়ে তো দিব্যি সুদৃশ্য টবে সাজানো রয়েছে নিয়ন অ্যালগি। কোনও একটা ইন্টেরিয়র ডেকরের ওয়েবজিনে পড়েছিল, দিব্যি অক্সিজেন বানাতে পারে এই অ্যালগিগুলো। গাছের মতোই ফোটোসিন্থেটিক। তার ওপর প্রোক্যারিওটিক বলে তরতরিয়ে জায়গা দখল করে। হ্যাঁ, ওর গোয়েন্দাগিরির ফিজে অবশ্য এসব অ্যাফোর্ড করা চাপের। কিন্তু বিজ্ঞানীর তো আপনা হাত জগন্নাথ। অক্সি অ্যাপের ক্রেডিট ওঁর কাছে এখন অতীত, আপাতত পাঁচতলা ল্যাব, পুরোটাই অ্যালগি। অ্যালগির অক্সিজেন উৎপাদনের হার আর পরিমাণ, দুটোই বাড়ানোর জন্য অনেকদিন ধরে উনি ডুব দিয়েছেন জিন রিসার্চে। আর যে ডায়েরিটা একটু আগে নিজেই ওর হাতে তুলে দিলেন ক্লু হিসেবে, গাছের মতো সেই মানুষকেও তো ছেড়ে এসেছেন কবেই। সুতরাং সেখানে গাছগাছালি নিয়ে এমন নস্টালজিয়ার সত্যিই থই পাচ্ছে না ও। ব্যাপারটা বুঝতে ফের চোখ নামাল ডায়েরির পাতাতেই।
২৬ জুলাই, ২০২৩
যশোর রোড।
মুম্বাই।
লাদাখ।
এক-একটা খুনের জায়গা। শুধু ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল, এর মধ্যেই মোটামুটি ৬ লক্ষ ৬৮ হাজার হেক্টর বন হারিয়ে গিয়েছে আমাদের দেশ থেকে। আর এবার তড়িঘড়ি বন সংরক্ষণ আইনও পাশ করিয়ে নিল কেন্দ্র। পুঁজিকে সুবিধা দিতে হবে তো! রেললাইন বসানোর নামে, কারখানা তৈরির নামে কাটা পড়বে হাজারে হাজারে গাছ। বনের মধ্যে এসি রিসর্টে বসে কলাপাতায় অথেন্টিক থালি খাবেন বাবু-বিবিরা। সমুদ্রের পাড়ে যথেচ্ছ বোল্ডার ফেলে, সারি সারি ঝাউগাছ উপড়ে ফেলে তাঁদের জন্য বানানো হবে থিম পার্ক। আর কী মজার কথা, এসবের জন্য অরণ্যের মানুষদের কোনও অনুমতি নিতে হবে না। অনুমতি নিতে হবে না গাছে বাসা বেঁধে থাকা পাখি, পোকা, পিঁপড়েদের।
অবশ্য, যাকে উদ্বাস্তু করে দেওয়া হয়, তার অনুমতি কে-ই বা কবে নিয়েছে!
****************
শুধু অক্সিজেন নয়। কাঠ থেকে খাবার থেকে ঔষধি। দেওয়ার লিস্ট অনেকটা লম্বা। তবে সেটাও শেষ কথা নয়। গাছ আসলে কী দিতে পারত, জানেন?
বিজ্ঞানী উঠে এসেছেন কখন। গোয়েন্দার পিছনে দাঁড়িয়ে তাঁরও চোখ ডায়েরিতেই। প্রশ্নের মতো উত্তরটাও দিলেন নিজেই,
আশ্রয়।
যেমনটা কোনও কোনও মানুষও দেয়। আমরাই চিনতে পারি না। চিনতে পারিনি। গাছ, বন, সবুজকে কেন বাঁচিয়ে রাখতে হবে, বুঝিনি। তাই অক্সি অ্যাপ। তাই অ্যালগি। যেটুকু প্রয়োজন, শুধু সেটুকু হাসিল করে নেওয়া বিজ্ঞানের জোরে। করতে করতে সবাই কেমন ধূসর হয়ে গেলাম, খেয়ালই করিনি।
শ্যাওলা কাউকে আশ্রয় দিতে পারে না, মিস্টার মিত্তির।
অ্যালগির কথা বলছেন? কিন্তু তার সঙ্গে আশ্রয়ের কী! তাছাড়া আশ্রয় কে-ই বা চেয়েছে! গোয়েন্দার চোখের প্রশ্নটা পড়তে পারলেন বিজ্ঞানী। হাত ধরে টানলেন, আসুন। দেখে যান।
বিজ্ঞানীর ল্যাবরেটরি। ভরে গিয়েছে অ্যালগিতে। টেবিল থেকে চেয়ার, চেয়ার থেকে মেঝে, ক্রমশ ভরে উঠছে সবুজ শ্যাওলার আস্তরণে। মুহূর্তে মুহূর্তে ঢেকে যাচ্ছে কোণে কোণে লুকিয়ে থাকা শূন্যস্থান। কাচের দরজার গা বেয়েও উঠে এসেছে সবুজ সবুজ ছোপ, যেন আর এইটুকু জায়গায় কুলোচ্ছে না ওদের। একদিন নিজের সুবিধেমতো সবুজের বসতিতে দখলদারি চালিয়েছিল মানুষ। কোণঠাসা করতে করতে একসময় এসেছিল উচ্ছেদের বিবরণ। এতদিন বাদে যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে, তবে উলটো পথে।
বিজ্ঞানী আস্তে আস্তে বললেন, গাছের স্বভাবে দখলদারি ছিল না বলেই সে ফুরিয়ে গিয়েছিল। যেমনটা যায় কোনও কোনও মানুষও। অন্যকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে, হারিয়ে যায়। তবে এরা হারাবে না। হারবেও না। দখল করে নেবে আমাদের বসার ঘর থেকে শোয়ার ঘর। লাইব্রেরি থেকে ল্যাবরেটরি, পার্ক থেকে শপিং মল, সব ঢেকে যাবে শ্যাওলায়… আদিম যুগের গর্ভজলের মতো গহনে টেনে নেবে মানুষকেও… আমাদেরই তৈরি করা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনেরা!
বলতে বলতে দরজাটা খুলে ফেললেন বিজ্ঞানী। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন কতগুলো সবুজ শুঁড় এসে জড়িয়ে ধরল তাঁকে। আদরের ছলে যেন গিলে নিতে লাগল নিজেদের ভেতরে। গোয়েন্দার পা নড়ছে না আর। ধাঁধা লেগে যাচ্ছে চোখে। ঠায় দাঁড়িয়ে ওর মনে হচ্ছিল, একটা মানুষই এবার গাছ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
গাছটা খুঁজুন মিস্টার মিত্তির। আমরা সব্বাই হারিয়ে যাওয়ার আগে, গাছটাকে আমাদের খুঁজে পেতেই হবে।
ঘন সবুজের ভেতর থেকে স্বরটা ভেসে আসছে। ভেঙে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে, তবু মরিয়ার মতো। অ্যালগিরা বেড়েই চলেছে এখনও। তাদের বাড়ানো শুঁড়গুলোর সামনে দাঁড়িয়ে এই প্রথম ফেলু মিত্তির টের পেল, ওর ভয় করছে।
(এ লেখার সবকিছুই কাল্পনিক, কেবল গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া ছাড়া)