এই ছবিটা আসলে এক সময়ে বানানো একটা ছবির হাত ধরে, একজন মানুষের আত্মপ্রকাশের ভূত। এই শহরটাকে যদি একটা বাড়ি ধরি, মনে করি, সেখানে ভূত আছে– সেই জানলা দিয়ে তো আজকের কলকাতাই দেখা যাবে। আজকের আলো, আজকের বাড়ি, আজকের ফ্ল্যাট, আজকের রাস্তার আলো, আজকের লাল-নীল দেওয়াল। কিন্তু বাড়ির ভেতর যে ভূত রয়েছে, সেই ভূতের গল্পটা কোন সময়ের? ৩০ বছর আগেকার, না ৫০ বছর, না ১০০ বছর আগেকার? সেই ভূত তো আগের সময়টাকেই ধরে রেখেছে। খাঁচাটা আসলে এই কলকাতা শহর। তার মধ্যে একটি সময় এবং অ-মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটির হাত ধরে একজন মানুষের আত্মপ্রকাশ, আত্মানুসন্ধানের গল্প।
শিল্পীসত্তা আসলে ব্যক্তিসত্তারই এক্সটেনশন। নিজের ওই ব্যক্তিগতটুকু, কায়াসুদ্ধ ছায়াটুকু শিল্পের ওপর গিয়ে পড়ে। তাই শিল্প আলাদা আলাদা, ব্যক্তিবিশেষে। সে শিল্প চিত্রকলা হোক, চলচ্চিত্র হোক বা সাহিত্য হোক! আমার মনে হয়, ‘চালচিত্র এখন’-ও সেইরকম ছবি– যা অঞ্জন দত্ত– অঞ্জনদার একটা এক্সটেনশন। কম করে ২৫ বছর ধরে ওঁকে চিনি, নানারকমভাবে। ওঁর পরিচালনায় আমার অভিনয়ের হাতেখড়ি সেই ১৮ বছর বয়সে। মৃণাল সেনের সঙ্গে যে-সম্পর্ক দেখানোর চেষ্টা করেছেন অঞ্জনদা ‘চালচিত্র এখন’-এ, আমার কাছে অঞ্জন দত্ত-ও ছিলেন সেইরকমই। ভাববেন না যে, মৃণাল সেন-অঞ্জন দত্তর সঙ্গে অঞ্জন দত্ত-পরমব্রতর তুলনা করছি। আসলে বলতে চাইছি, সম্পর্কের মাত্রাটায় একটা মিল রয়েছে, ধরনে রয়েছে মিল। পরেও, ওঁর পরিচালনায় যখন অভিনয় করেছি, তখন ভয়ই পেতাম অঞ্জনদাকে। এখন অনেকটা সমমনস্ক কলিগের মতো। ২০১৯ সালে অঞ্জনদাকে পরিচালনা করেছি ‘বনি’ ছবিটায়। তখন অঞ্জনদা একটা আবেগঘন লেখা লিখেছিলেন ফেসবুকে, যা পড়ে আমি খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। সম্প্রতি অপর্ণা সেন এবং অঞ্জন দত্তকে নিয়ে একই সঙ্গে একটা ফিল্ম পরিচালনা করেছি। এগুলো বলছি কারণ, বোঝাতে চাইছি অঞ্জন দত্তর সঙ্গে আমার সম্পর্কের ধরনটা, গভীরতাটা। তাঁর ভালোবাসা ও রাগ– এই দুইয়ের ভেতর দিয়েই গিয়েছি আমি, আমার রাগ ও ভালোবাসার মধ্য দিয়েও গিয়েছেন অঞ্জন দত্ত। এই যোগাযোগের সূত্র ধরেই বলতে পারছি, অঞ্জন দত্ত মানুষটা যেরকম, ‘চালচিত্র এখন’ ছবিখানাও সেইরকম। কেন, বলছি সেকথা।
খুঁত, অসামঞ্জস্য, অসংগতি এই ছবিতে রয়েছে। রয়েছে তাড়াহুড়োও। ছবিতে সব সম্পর্কের সমীকরণ যে খুব স্পষ্ট হয়, তা নয়। সব কথাও স্পষ্ট করে বলা নেই। এসবই সেই অসঙ্গতির চিত্রনাট্যের মধ্যে চলে যাচ্ছে। কিন্তু শেষমেশ কোথাও একটা গিয়ে ম্যাজিক হয়ে ওঠাও আছে। এই ছবি দিনের শেষে ছকভাঙা জীবনের উৎসব। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এই ছবিটা আমি বানাতে চাইব কি না, আমি বলব– না। তার দুটো কারণ। এক, এতটা অসংগতিপূর্ণ, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছবি আমার হাত দিয়ে বেরবে না। এবং দুই, এরকম একটা ছবি হয়তো বা আমি বানাতে পারবও না।
এ ছবির একটা চরিত্র কলকাতা। এই কলকাতা শহরটা এখনও ছেড়ে থাকা যায় না। শুধু নিজের শিকড় আছে বলে নয়, এই শহরের এমন অনেক জিনিস আছে, যা আর কোত্থাও নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসম্ভব রাগ ধরে। বিরক্ত হই। কিন্তু কলকাতার মধ্যেই তো এইসব, এর একটা উপাদান বাদ দিলে কি আর কলকাতা-কলকাতা লাগবে? অঞ্জন দত্তও এক্কেবারে এই কলকাতার মতোই। মাঝে মাঝে এত রাগ হয়– ভাবি– কখনও আর কথা বলব না। ব্যবহারেরও কোনও চালচুলো নেই– একথা ওঁর মুখের ওপরও বলি। কিন্তু তারপরও ওঁকে ভালো না বেসে থাকা যায়? ওঁর গান, ওঁর কিছু ছবি, ওঁর বিশ্লেষণ-বীক্ষণ এবং বৈশ্বিক চিন্তনের বা দর্শনের ভক্ত না হয়ে উপায় নেই! ঠিক একইরকমভাবে এই ছবিটাও, ‘চালচিত্র এখন’– নানা খুঁত থাকলেও তা আমাকে জড়িয়ে নেয়, বন্ধুত্ব করে ফেলে। ভালোবাসব না, বললেও, ভালোবাসা হয়ে যায় কী করে যেন।
ছবিতে আশির গোড়ার দিকের গপ্পো বলা হচ্ছে। আমরা দেখছি, রঞ্জন (শাওন চক্রবর্তী) হেঁটে গেল, পিছনে আজকালকার গাড়ি যাচ্ছে। অঞ্জন দত্ত এটাকে ‘টাইমলেস’ বলেছেন, এখন কেউ তো বলতেই পারে, টাকা ছিল না পিরিয়ড রিক্রিয়েট করার– তাই ‘টাইমলেস’ বলে ম্যানেজ করেছেন। বাদল সরকার, পিটার উইয়ারের নাটকের রেফারেন্স উঠে আসছে, কিন্তু টাইমলেসই যদি হয় তাহলে সত্তরের ফিল্ম ক্যামেরা কেন? ‘টাইমলেস’ ব্যাপারটাকে অনেকে বলতেই পারেন– আত্মপক্ষ সমর্থন। কিন্তু আমি টাইমলেস তত্ত্বকেও মান্যতা দেব না, আর ওই আত্মপক্ষ সমর্থনের কথাটাকেও না। কারণ আমার কাছে নিজের মতো করে একটা বিশ্লেষণ আছে।
এই ছবিটা আসলে এক সময়ে বানানো একটা ছবির হাত ধরে, একজন মানুষের আত্মপ্রকাশের ভূত, মানে প্রেত। এই শহরটাকে যদি একটা বাড়ি ধরি, মনে করি, সেখানে ভূত আছে– সেই জানলা দিয়ে তো আজকের কলকাতাই দেখা যাবে। আজকের আলো, আজকের বাড়ি, আজকের ফ্ল্যাট, আজকের রাস্তার আলো, আজকের লাল-নীল দেওয়াল। কিন্তু বাড়ির ভেতর যে ভূত রয়েছে, সেই ভূতের গল্পটা কোন সময়ের? ৩০ বছর আগেকার, না ৫০ বছর, না ১০০ বছর আগেকার? সেই ভূত তো আগের সময়টাকেই ধরে রেখেছে। খাঁচাটা আসলে এই কলকাতা শহর। তার মধ্যে একটি সময় এবং অ-মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটির হাত ধরে একজন মানুষের আত্মপ্রকাশ, আত্মানুসন্ধানের গল্প। এই শহরে যে ভূত বাস করে, তার গল্পই ‘চালচিত্র এখন’। সকলেই তো জানেন, ভূতের আরেক অর্থ অতীত।
শেষ দৃশ্যে, দেখলাম, অনেকের চোখেই জল চলে এসেছে, যখন বড়পর্দা থেকে গলা শুনতে পাই: কেমন লাগছে কলকাতা? –ফ্যান্টাস্টিক। এর চেয়েও অনেক বেশি অ্যাটাচ করতে পেরেছি আমি আরেকটা দৃশ্যের সঙ্গে, তা খাবার টেবিলের দৃশ্য। শাওন বসে থাকে, আর ওর সহ-অভিনেতা বলে, মুর্শিদাবাদ থেকে রোজ আসি, ফিরে যাই। এবং তার পাশের লোকের সঙ্গেও সংলাপ চালায়। একটা আনকোরা শহুরে ছেলে সিনেমা-ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বৃহৎ বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হয়। যে নিজের ছোট পৃথিবীতে থাকলে জানতেই পারত না! আমি এখানেই নিজের সঙ্গে রিলেট করি। আমি ঠিক এই ছেলেটাই ছিলাম। আমার আসার কথাই ছিল না অভিনয়ে। এসেছিলাম অঞ্জন দত্তর হাত ধরে। প্রথম দুটো বছর কেটে গিয়েছিল এই জগতের বাস্তবতা বুঝতে, সংযম, ভালো-মন্দ এবং ভালো ও মন্দ মিশিয়ে তৃতীয় কোনও মাত্রাকে বুঝতে। মনে আছে, একদিন মা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোদের জগৎটা খুব নোংরা, না?’ আমি বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ ভীষণ নোংরা আর ভীষণ পরিষ্কার, ভীষণ কুৎসিত আর ভীষণ সুন্দর।’ এই অদ্ভুত বৈপরীত্য, পরস্পরবিরোধী জগৎকে আবিষ্কার করেছিলাম আস্তে আস্তে।
মৃণাল সেন ও অঞ্জন দত্তর মধ্যেকার যে রাজনৈতিক নীতিগত দূরত্ব, তার সরলীকরণ করা উচিত হবে না। ওগুলো বৃহত্তর আলোচনার মধ্যেকার একটা স্থিরচিত্র। ওঁদের মধ্যে বহু জিনিস নিয়েই কোনও পার্থক্য ছিল না বলে বিশ্বাস করতে চাই, যেমন– প্রগতিশীলতা, ধর্মনিরপেক্ষতা। দু’জনেই বিশ্ব মানবিকতায় বিশ্বাসী– যেখানে কলকাতার এঁদো গলির মধ্যেও বসেও জার্মানির এক কোণের নাট্যকার, টার্কির সুরকার বা লেখক, ইজিপ্ট বা সাউথ আমেরিকার কোনও চিত্রশিল্পী একসঙ্গে একযোগে যেন অনেক মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারত। এটাই ছিল সেই বৃহত্তর ছাতাটা যার তলায় বসে মতান্তর অল্পবিস্তর ছিলই। আজকের ভারতের যে রাজনৈতিক চিত্রটায় বড়ই কদর্য মেরুকরণ। সেই মেরুকরণ-উত্তর ভারতে মৃণাল সেন ও অঞ্জন দত্তর ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে আলোচনায় তাঁদের মতান্তরকে মেলাতে পারব না।
অঞ্জনদা আমাকে বলেছিলেন, লোকে আমাকে পাহাড়-পাহাড় বলে বটে, আমি কিন্তু আসলে কলকাতা। ওঁর হয়তো একটা বয়স লেগেছে একথা উপলব্ধি করতে। ছোটবেলাটা সারাজীবন ধরেই একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে চলে। এমনকী, ছোটবেলা এ-ও বিশ্বাস করায়, এটাই আমরা। কিন্তু সেই ছোটবেলার স্মৃতি নিয়ে বাঁচতে বাঁচতে কখন যেন আমরা দেখি, যৌবনটাই আমরা হয়ে উঠেছি। ছোটবেলাটা নয়। অঞ্জনদার যৌবন, অঞ্জনদার মধ্যবয়স, অঞ্জনদার প্রৌঢ়ত্ব– সবটাই কলকাতা। অঞ্জন দত্ত শেষমেশ এই কলকাতার গল্প ভালোবাসেন। থাকতে চান এই কলকাতাতেই। এই কলকাতাই তো তাঁকে উপহার দিল এই ছবি। সত্তর বছরের আত্মানুসন্ধান হয়তো বা এইবার শেষ হল।