তপন রায়চৌধুরীর স্মৃতিকথায় পড়েছিলাম খাদ্য আন্দোলনের সময় একদিকে ৩০ লাখ লোকের মৃত্যু ও অন্যদিকে মধ্যবিত্তের কুৎসিত বিলাস। তা কি আবারও ফিরে আসেনি! লকডাউনের সময় যখন খাদ্যের হাহাকার চরমে ওঠে, তখন সামাজিক মাধ্যমে খুব বেশি করে চোখে পড়ছিল ফুড ব্লগারদের রমরমা।
২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় রেশন বিদ্রোহের স্মৃতি এখন ফিকে হয়ে গেছে। অনেক জায়গার মধ্যে নদিয়াতেও রেশন দোকানের মালিকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ফেটে পড়েছিল। তখন আমি একটি ছাত্র সংগঠন করতাম। সেই সূত্রে নদিয়ার এক গ্রামে যাওয়ার স্মৃতি এখনও খানিক মনে আছে। এই ধরনের বিক্ষোভ একসময় স্তিমিত হয়ে যায়। নদিয়ার সেই গ্রামেও গিয়েছিল। অন্যত্রও। কিন্তু, বাংলার মাটিতে ক্ষুধার রাজনীতির যে এক দীর্ঘ ধারাবাহিকতা আছে, সেটা ২০০৭-এর রেশন বিদ্রোহ আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু, স্মৃতি কি সত্যিই ফিকে হয়? বাংলায় পাঁচ ও ছয়ের দশকে খাদ্য আন্দোলন যে বাংলার রাজনীতির ছককে পুরো বদলে দিয়েছিল, তা কি আকস্মিক ছিল? না কি সাংগঠনিক ধারাবাহিকতার পাশাপাশি রয়ে গেছিল স্মৃতি? ক্ষুধার, দুর্ভিক্ষের, গণহত্যার? পাঁচ ও ছয়ের দশকে যখন খাদ্য আন্দোলনে বাংলার রাজনীতির ভিত নড়ে যাচ্ছে, তখন কি ভারতের অন্যত্র খাদ্য সংকট ছিল না? শুধুই কি বামপন্থী দলগুলি পশ্চিমবাংলায় শক্তিশালী ছিল বলেই বাংলায় খাদ্য আন্দোলন হয়েছিল, না কি বাংলার কৃষক ও কারিগরদের ওপর নেমে আসা একের পর এক দুর্ভিক্ষ ও গণহত্যার স্মৃতি জনগণের কৌমচেতনায় স্থান নিয়েছিল? স্মৃতি কি বিদ্রোহের জন্ম দেয় না?
বাংলায় খাদ্যর দাবীকে আন্দোলনের কেন্দ্রে রাখা শুরু হয় ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ঘটনা থেকে। কিন্তু, বাংলায় দুর্ভিক্ষের ফলে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু মিছিলের শুরু তার অনেক আগে থেকেই। বাংলার কৃষক ও কারিগরদের যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন ছিল, তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের পরে প্রায় সর্বার্থেই ভেঙে গিয়েছিল। এই সময় থেকেই একের পর এক কৃষক ও আদিবাসী আন্দোলন বাংলায় ফেটে পড়ে। ১৭৬৯-’৭০ সাল থেকে দুর্ভিক্ষের যে দীর্ঘ যাত্রা চলেছিল, তা কি কৃষক-কারিগরদের যৌথ স্মৃতিতে রয়ে যায়নি? মন্বন্তরের অভিজ্ঞতার স্মৃতি কীভাবে সাহিত্যে জায়গা পেয়েছিল, তার জন্য ‘আনন্দমঠ’-এর উদাহরণ টানা হয়। যে উপন্যাসের শুরুতেই অন্যতম নায়ক মহেন্দ্র ও কল্যাণীর বর্ধিষ্ণু জীবন ছারখার হয়ে যায় দুর্ভিক্ষের ধাক্কায়। মজার কথা, বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠের প্রথমবারের বিজ্ঞাপনে লেখেন– ‘ইংরেজরা বাঙ্গালা দেশকে অরাজকতা হইতে উদ্ধার করিয়াছেন। এই সকল কথা এই গ্রন্থে বুঝান গেল।’ হায় রে, বাংলার কৃষক! কিন্তু, সত্যিই কি মহেন্দ্রর মতো মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছিল? যদুনাথ সরকার ‘আনন্দমঠ’-এর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-এর এক সংস্করণের ভূমিকায় আনন্দমঠের ভূয়সী প্রশংসা করেও মনে করিয়ে দেন যে, সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সন্ন্যাসীরা মোটেও ‘বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ, কায়স্থের ছেলে’ নয়। হয়তো বাংলার সেই সময়কার যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ জনগণ সেই দুর্ভিক্ষে মারা গেছিল, তাদের উত্তরসূরিরাই ১৯৪৩ সালেও মারা যায়। হয়তো তাদের উত্তরসূরিরাই ফেটে পড়েছিল ১৯৫৯ আর ’৬৬-র খাদ্য আন্দোলনে।
কিন্তু, আনন্দমঠের বাইরেও কি স্মৃতি রয়ে যায়নি? আঠেরো শতকের সেই অরাজক সময়েই বাংলার ঘরে ঘরে চালু হয় ‘লক্ষ্মীর পাঁচালী’ পড়ার চল। যে লক্ষ্মী চঞ্চলা। যে ধান্য অধরা। যে বিশ্ব মাঝে মাঝেই নড়ে যায় ক্ষুধার জ্বালায়, সেই বিশ্বেই তো নারীরা লক্ষ্মীকে ঘরে চাইবে। কিন্তু, সেই লক্ষ্মীর চাঞ্চল্যের কারণ পাঁচালি বাইরে খোঁজেনি। খুঁজেছে ভেতরে। পরিবারের নারীর ‘সঠিক’ আর ‘বেঠিক’ আচরণে। যখন বহিরঙ্গকে পরিবর্তনের ক্ষমতা কমে যায়, তখন এইভাবেই অন্তরঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে দ্রোহ মাথা কুটে মরে। কিন্তু, স্মৃতি রয়ে যায়। প্রাচুর্যের স্মৃতি। দুর্ভিক্ষের স্মৃতি। প্রাচুর্যকে ফিরে পাওয়ার কামনা।
দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে একটি সমাজের ভেঙে যাওয়ার একটি অন্য সবল চিত্র পাই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির ১৯৪৩ সালের এক চিঠিতে– ‘মৃত্যু ও মহামারির ভিতর দিয়া বাংলার সামাজিক জীবন ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া যাইতেছে। যাহারা কয়েকমাস আগেও স্বাভাবিক গৃহস্থ ছিল আজ তাহারা সহায় আশ্রয়হীন ভিক্ষুক হইয়া বাহির হইয়াছে। ইহাদের অধিকাংশই গ্রাম্য মজুর ও গরীব চাষী।’ সেই সময়কার বামপন্থী সহ অনান্য দলগুলির প্রশংসনীয় রিলিফ ওয়ার্ক ও মজুতদার বিরোধী আন্দোলন সত্ত্বেও এ কথা সত্য যে সেই কাজ ছিল সিন্ধুতে বিন্দুসম। নইলে ৩০ লক্ষ লোক সবার চোখের সামনে ‘ফ্যান দাও, ফ্যান দাও গো’ এই আকুল ডাক ছেড়ে মারা যেত না। ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী তাঁর আত্মজীবনী ‘বাঙালনামা’য় লিখেছেন সেই সময়কার কলকাতার মধ্যবিত্ত জীবনে প্রাচুর্যের অভাব হয়নি। পার্ক স্ট্রিটের রেস্টুরেন্টে ভিড় ও অনান্য ফুর্তি কিছুই বাদ যায়নি!
এই সবকিছুই অন্য রূপ নেয় খাদ্য আন্দোলনের সময়। যদিও তার আগে ট্রাম ভাড়া বিরোধী আন্দোলন, ’৫৭ সালের শিক্ষক আন্দোলন, বাংলা বিহার সংযুক্তি বিরোধী আন্দোলন খাদ্য আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করেছিল। শহরের মানুষ কম দামে খাদ্য চাইল, আর কৃষক চাইল ফসলের ন্যায্য মূল্য। ১৯৪৩-এর সময়ে মধ্যবিত্ত ও গরিবের মধ্যে যে সমুদ্রস্পর্শী ব্যবধান ছিল, সেটা খানিকটা না মিটলে খাদ্য আন্দোলন এই ধরনের নাড়া দিতে পারত না। ‘পশ্চিমবঙ্গ মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’র ১৯৫৯ সালের যে মিছিলে লাঠি চালিয়ে ৮০ জন কৃষকের হত্যা হয়েছিল, তার সলতে পাকানোর কাজ তাই শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। ১৯৫২ সালের পরবর্তী সময়ের প্রচারপত্রগুলি পড়লে দেখা যাবে, যে কারণে ’৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলন হয়েছিল, তার মূল সূত্র লুকিয়েছিল কৃষির সংকটে। রেশন ব্যবস্থা ও চাল সংগ্রহের অব্যবস্থায়। প্রায় প্রত্যেক বছরেই বর্ষার সময় খাদ্যের সংকট দেখা যেত। জেলায় জেলায় বড় বিক্ষোভ হত। ৩১ অগস্টের ঘটনার পরে কলকাতা শহর জুড়ে যে আন্দোলন হয়েছিল, তাতে ছাত্ররা ব্যাপক সংখ্যায় অংশ নেয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ত্রিগুণা সেন ছাত্র ও শিক্ষকদের পক্ষ থেকে কালো পতাকা তোলেন। আরও অনেক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েও একই রকম বিক্ষোভ দেখা যায়।
সাতের দশক থেকে সেই ভয়ানক খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই আর সেইভাবে হয়নি। কখনও ২০০৪ সালের আমলাশোল খাদ্য আন্দোলনের স্মৃতিকে নাড়া দেয়, কখনও ২০১৪ এর চা-বাগানের মৃত্যু নাড়া দেয়। আর, লকডাউনের সময় আবার দেশ জুড়ে খাদ্যের হাহাকার, চারিদিকে কমিউনিটি কিচেন বুঝিয়ে দেয় খাদ্যের রাজনীতি এখনও শেষ হয়নি। এখনও যে সরকার কম পয়সায় চাল দেয়, ক্যান্টিন চালায়, তারা ভোটবাক্সে খানিক সুফল ফিরে পায়।
কিন্তু, অন্য একটি স্মৃতির কথা বলে ক্ষুধার রাজনীতির কথা শেষ করি। তপন রায়চৌধুরীর স্মৃতিকথায় যেমন পড়েছিলাম একদিকে ৩০ লাখ লোকের মৃত্যু ও অন্যদিকে মধ্যবিত্তের কুৎসিত বিলাস, তা কি অন্যভাবে ফিরে আসেনি! লকডাউনের সময় যখন খাদ্যের হাহাকার চরমে ওঠে, তখন সামাজিক মাধ্যমে খুব বেশি করে চোখে পড়ছিল ফুড ব্লগারদের রমরমা। গ্রুপে গ্রুপে নতুন রেসিপির ছবি। যেন ’৪৩-এর সমুদ্রস্পর্শী ব্যবধান আবার ফিরে এল চোখের সামনে। স্মৃতি তো আমদের এও বলে যে, মধ্যবিত্ত ’৪৩-র মহামারী সম্বন্ধে একটা কথাই পারিবারিক স্মৃতি থেকে শিখেছে– খাবার ফেলো না, মানুষ এক সময় ফ্যান চাইত। মহেন্দ্ররা সেই সময়েও না খেয়ে মরেনি। এখনও না। সে বঙ্কিমবাবু যাই বলুন না কেন!
দরজার সামনে শম্ভু মিত্র, রেকর্ডিং শেষ করে সবে ফ্লোর থেকে বেরিয়েছেন। গম্ভীর মানুষ, সাহস সঞ্চয় করে কাছে গিয়ে প্রণাম করি, মাথায় হাত রাখলেন। পাশে ছিল চৈতি ঘোষাল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বাড়ির টিভিতে আমাকে দেখতে পায় তাই এই বিস্ময়, নিচু গলায় জানাল ডাকঘরের অমল।