প্যারিসের পিগেল-এ দাঁড়িয়ে। প্যারিসে এসেছি। অথচ প্যারিসের সোনাগাছি পিগেলে আসিনি– এমন ভদ্রলোক আমি নই। পিগেলে এসেছেন ভুবনবিখ্যাত ভদ্রলোকরা, যেমন জেমস জয়েস, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, পাবলো পিকাসো, জর্জ অরওয়েল, ফিৎজিরাল্ড। আর এ-যুগের স্যর সূর্যপ্রসাদ বিদ্যাধর নয়পল থেকে মিলান কুন্দেরা– কে না? ‘পিগেল’ হল প্যারিসের নারীচর্চার তীর্থস্থান। পৃথিবীতে তুলনাহীন এই লাল-আলোর-অঞ্চল!
–কী নাম তোর ছোঁড়া? বয়স তো আঠেরো পেরিয়েছে মনে হচ্ছে। কিন্তু শরীর তো দশ বছরের।
সেই আঠেরো বছর পেরনো দশ বছরের খোকাকে মাটি থেকে তুলে টেবিলের ওপর বসিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে প্যারিসের মুলারুজ নাইট ক্লাবের লজ্জাহীন গা-দেখানো ছুঁড়ি। বলে, ‘ভুল জায়গায় এসেছিস তুই। তোকে আমাদের কোনও কাজে লাগবে না।’
–লাগতেও পারে। আমি তোমাদের ক্যানক্যান নাচের ছবি আঁকব।
–তুই ছবি আঁকতে পারিস? বেশ, আঁক তো দেখি! মেয়েটি, ক্যানক্যান ডান্সের ছবি তার প্রায় নগ্ন শরীরে ফুটিয়ে তুলে দাঁড়ায় সেই বয়স্ক খোকা, বামনাবতারের সামনে।
মেয়েটার গায়ে কোনওরকমে লেগে থাকা আলগা স্বচ্ছ লঁজারি। কোনও অন্তর্বাস পরেনি সে। তার একটা পা মাটিতে। অন্য পা যতদূর সম্ভব ওপরে তুলেছে। পায়ে লাল জুতো!
ছেলেটা মুহূর্তে এঁকে ফেলে সেই ছবি। মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়ে সেই ছবির দিকে। এইরকম ক্যানক্যান কি সে সত্যি নাচতে পারে? পারে কি ক্যানক্যান ডান্সে তার দলের ঊনষাট জনের অন্য কেউ? ছবিতে ছেলেটি এঁকেছে এমন এক মেয়ের ছবি, যার একটা পা পৃথিবীতে, অন্য পা স্বর্গে। আর মাঝখানে নদীর মতো বয়ে চলেছে সুবর্ণরেখা এক নদী– তার গোপনাঙ্গের কী অপূর্ব প্রকাশ!
মেয়েটা দৌড়ে এসে সে ওই খোকা-কিশোরের গালে চুমু খায়। তারপর প্রশ্ন করে, কী নাম তোর?
–তুলুস লত্রেক। বলে সেই বামনাবতার। তারপর বলে, ‘আমার হাড়ের অসুখ। আমার বয়স বাড়ছে। কিন্তু তবু আমি বাড়ছি না। আমার মস্ত ধনী বাপ আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে মুলারুজে তোমাদের সঙ্গে থাকতে দেবে? আমি রোজ তোমাদের ছবি আঁকব। আর সেই ছবি তোমরা ক্যানক্যান ডান্সের বিজ্ঞাপনে ছড়িয়ে দেবে সারা প্যারিস শহরে। আমার বন্ধু আমার ছবি খুব পছন্দ করে। সে আমার থেকে অবশ্য দশ বছরের বড়। সে আমাকে বলেছে, আমি যেন তোমাদের নাচের ছবি আঁকি।’
–কী নাম তোর বন্ধুর?
–ভ্যান গঘ।
ক্যানক্যান ডান্সের আঁতুড়ঘর প্যারিসের মুলারুজ। ২৯ অগাস্ট গিয়েছিলাম সেই সেক্সমন্দিরে। তুলুস লত্রেক সেই মন্দিরে থাকেন তিন বছর। শুধুই আঁকেন ক্যানক্যান ডান্সের ছবি। অশ্লীল হয়ে ওঠে সুন্দর। বারবণিতা হয়ে ওঠে চিরন্তন যৌনতার দেবী! এবং যৌনতা হয়ে ওঠে প্যারিসের আরাধনা ও উৎসব।
আজও, এই ২০২৩-এও, সেই উৎসব ক্লান্তিহীন চন্দ্রালোক হয়ে ফুটে আছে প্যারিসের সন্ধ্যায়, রাত্রে! এবং সেই যৌন-জ্যোৎস্নাকে একের পর এক ছবিতে ধারণ করেছেন ক্যানক্যান নৃত্যের ছবি-আঁকার অনন্য শিল্পী তুলুস লত্রেক!
আজ তুলুসের ছবির কেমন দাম? অর্থমূল্য বিচারে যদি কোনও শিল্পীর বিচার করতেই হয়, তবে এই প্রশ্নের উত্তর হল, ভারতে অন্তত এমন কোনও ধনী নেই যিনি একটি ‘ওরিজিনাল’ তুলুস লত্রেক ‘ক্যানক্যান’ কিনে তাঁর ড্রয়িংরুমে টাঙাতে পারেন!
ভারতে সত্যিই এমন কোনও ধনী আছেন কি, যিনি একটি ‘তুলুস’ কিনে টাঙাবেন তাঁর পেন্ট হাউসে, যে-ছবিতে ক্যানক্যান-সুন্দরী তার একটি পা মর্ত্যে রেখে অন্যটি রেখেছে স্বর্গে, এবং তার অন্তরবস্ত্রবিহীন গোপনাঙ্গের মুক্তি নদীর মতো বহতায় সুবর্ণরেখা! হয়তো ধনীরা স্বপ্ন দেখবেন তুলুস লত্রেক এসেছেন স্বপ্নে, বাস্তবে আসবেন কি না, তা থেকেই যায় ‘টু বি অর নট টু বি’-র দৈগন্তিক দোলাচলে।
আমার একটি ভয়ংকর প্রশ্ন জাগল মনে, প্যারিসের পিগেল-এ দাঁড়িয়ে। প্যারিসে এসেছি। অথচ প্যারিসের সোনাগাছি পিগেলে আসিনি– এমন ভদ্রলোক আমি নই। পিগেলে এসেছেন ভুবনবিখ্যাত ভদ্রলোকরা, যেমন জেমস জয়েস, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, পাবলো পিকাসো, জর্জ অরওয়েল, ফিৎজিরাল্ড। আর এ-যুগের স্যর সূর্যপ্রসাদ বিদ্যাধর নয়পল থেকে মিলান কুন্দেরা– কে না? ‘পিগেল’ হল প্যারিসের নারীচর্চার তীর্থস্থান। পৃথিবীতে তুলনাহীন এই লাল-আলোর-অঞ্চল! পৃথিবীর আদিবাণিজ্যের এমন সোনালি অঞ্চল আর একটিও নেই! পাশের শহর লন্ডনের সোহোর রাত্রি-আহ্বান, শরীরবাদ, প্যারিসের পিগেলের ধারে-কাছেও আসে না।
আমি এই মুহূর্তে পিগেলে। পিগেলের বহ্নিত বর্ডারে মুলারুজ। মুলারুজ-ই জগতের আদিরসের শ্রেষ্ঠ বিতরণক্ষেত্র। আর ঠিক তার উল্টোদিকে ‘সেক্সি লঁজারি’ এবং সেক্স খেলনার বিদগ্ধ বিপণি ‘নিউ গার্লস’! এ-যুগের মেয়েরা ঠিক কী চায় পুরুষের কাছে, সেক্সুয়ালি? আর আর এ-যুগের পুরুষ স্বপ্ন দেখে কেমন মেয়ের? তাছাড়া, বয়স বাড়লে কি কমে যায় যৌনস্বপ্ন? সেই তাড়নাকে সামলাবে কীভাবে এ-যুগের পুরুষ ও নারী, সব প্রশ্নের উত্তর, ওষুধ ও যন্ত্র নিয়ে সারি সারি দোকান প্যারিসের সেক্সনগরী পিগেল-এ, যার প্রথমটি হল ‘নিউ গার্লস’! কিন্তু কলকাতার সোনাগাছি কি পিগেল নয়? তার কোনও জয়েস, কামু, পিকাসো, তুলুস লত্রেক নেই কেন? আজও? বাঙালির কামিনীচর্চা কি প্যারিসের কাছে হেরে গেল?