শিল্পজগতে এমন কথা শোনা যায় যে, শিল্পীর আবার পুরুষ-নারী এই লিঙ্গভেদ কীসের! কিন্তু বাস্তবে লিঙ্গপরিচয় আমাদের সমাজে একজন পুরুষ আর মহিলাশিল্পীর জীবনের পথকে অনেকটাই আলাদা করে দেয়। নানা মহিলাশিল্পীর জীবনী তাঁদের জীবনের প্রভূত বাধাবিপত্তির সাক্ষ্য বহন করছে, যা আসে পরিবার ও সমাজ থেকে। শিল্পের পথ মোটেই সুগম নয়, কিন্ত মেয়েদের জন্য তা আরও কণ্টকপূর্ণ।
কর্মজীবন আর বিবাহিত সংসারজীবন– এই দুইয়ের দোটানায় পা রেখে চলেন মেয়েরা। বিবাহ একটি মেয়ের জীবনে বহুলাংশে পরিবর্তন এনে দেয়, আমরা জানি। পুরুষদেরও আনে বই কি! তবে সচরাচর পাল্লাটা মেয়েদের দিকে বুঝি-বা ভারী। অনেকটাই। একদিকে যেমন পরিবেশ, আরেকদিকে সম্পর্কের সমীকরণে বদল আসে। চেনা চারপাশ ছেড়ে তাঁকে যেতে হয় নতুন আস্তানায়, একাধিক নতুন সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। আর প্রেমের বিয়ে হলেও প্রেম সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে যখন বিয়ের আঙিনায় ঢোকে, তার রং তো বদলায়ই। এর ব্যতিক্রম থাকলেও মোটের ওপর চিত্রটা এইরকম। এর সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটিকে পালন করতে হয় কর্মজগতের দায়দায়িত্ব। অনেক ক্ষেত্রে বিয়ে তাঁর কর্মজগতে যবনিকা টানে। এমনকী, কখনও কখনও জীবনেও।
অতি সম্প্রতি যেমন ঘটেছে ডোমজুড়নিবাসী অনুশ্রী হাজরার জীবনে। নৃত্যশিল্পী অনুশ্রীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল চন্দন মাঝির সঙ্গে, যিনি পেশায় একটি শিল্পসংস্থার গোডাউনের ম্যানেজার। দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হলেও বিয়ের পর থেকেই তাঁকে নাচ ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয় চন্দনের পরিবারের তরফ থেকে। এই নিয়ে অশান্তি, গঞ্জনা আর মারধোরও চলতে থাকে। পরিস্থিতি এমনই খারাপ হয় যে, বিয়ের ১৪ মাসের মাথায় অনুশ্রী চলে আসেন তাঁর বাবা-মায়ের বাড়িতে। বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলাকালীন চন্দনের পরিবারের লোকজন তাঁকে হুমকি দেন ও নানাভাবে অপমান করতে থাকে। শেষমেশ তাঁর বাড়ি থেকে দু’-কিলোমিটার দূরে একসরা রোডের ওপরে পাওয়া গেছে অনুশ্রীর গুলিবিদ্ধ, রক্তাক্ত দেহ। তাঁর স্বামীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এই ভয়াবহ দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি আমাদের সভ্য মানবসমাজের অনেকগুলি ক্ষতচিহ্নের দিকে আঙুল তোলে। ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে’ বা ‘এনএফএইচএস’-এর ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে মাত্র ৩২ শতাংশ কর্মরত, বাকি ৬৮ শতাংশ মহিলা বিবাহ-পরবর্তী জীবনে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ, ভারতে বিপুলসংখ্যক মহিলাকে এখনও বিয়ের পরে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়, যা পুরুষদের ক্ষেত্রে সচরাচর দেখা যায় না। পুরুষ-নারীর যৌথজীবনে এই চরম অসাম্যের জায়গাটির সমাধানের পথ থেকে আমরা এখনও অনেকটাই দূরে। যার ফলস্বরূপ বহু মেয়েদেরই জীবনেই নানা দুর্ভোগ নেমে আসে, যেমন শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন।
এনএফএইচএস-এর রিপোর্টে এ-ও আছে যে, ভারতে প্রায় ৩০ শতাংশ বিবাহিত মহিলা গার্হস্থ্য নির্যাতনের শিকার। এরই একটা চরম রূপ আমরা দেখতে পেলাম অনুশ্রী হাজরার জীবনে। প্রেম বা যৌথতায় পুরুষ-নারীর একান্ত বোঝাপড়ার পথে আমরা এখনও বহুলাংশে ব্যর্থ। উপরন্তু, অনুশ্রী যে বিবাহবিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের পথে নিজের জীবন বেছে নেবেন, সেই অধিকারটুকুও তাঁর রইল না।
নৃত্য একটি প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলা। আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি ধ্রুপদী নাচের ধারা তো আছেই, তাছাড়াও আছে লোকনৃত্য ও অন্যান্য আধুনিক নাচ। ভারতের বহু রাজ্যের নিজস্ব নৃত্যশৈলী আছে। জগদ্বিখ্যাত নৃত্যশিল্পীদের আবাস আমাদের দেশ। অথচ সাধারণ জনমানসে এখনও আমরা নাচকে শিল্প হিসেবে গ্রহণ করতে পারিনি। আমাদের ভাবনা– ঘরের বউ বাইরে ধেই ধেই করে নেচে বেড়াবে? কিংবা ঘরের মেয়ে! এ বুঝি তাঁর পরিবারের জন্য বড়ই অসম্মানের। কিছু কিছু ধারায় পুরুষরা নাচলে তাঁদের ভাবা হয় মেয়েলি পুরুষ। মোটের ওপর নাচ শিল্পটি নিয়ে আমাদের ভিতরে অনেক ট্যাবু। যেজন্য অনুশ্রীর মতো বহু মেয়েরা নাচকে পেশা করতে চাইলে চরম পারিবারিক বাধার সম্মুখীন হন। তবে কোনও কাজ তথাকথিত শিল্পের আওতায় না পড়লেও সেই কাজটি করার স্বাধিকার যে-কারও আছে, লিঙ্গনির্বিশেষে– এ-কথা বলাই বাহুল্য।
শিল্পজগতে এমন কথা শোনা যায় যে, শিল্পীর আবার পুরুষ-নারী এই লিঙ্গভেদ কীসের! কিন্তু বাস্তবে লিঙ্গপরিচয় আমাদের সমাজে একজন পুরুষ আর মহিলাশিল্পীর জীবনের পথকে অনেকটাই আলাদা করে দেয়। পুরুষশিল্পী জীবনে যতটা স্বাধীন অবস্থান রক্ষা করতে পারেন, তা মেয়েদের জন্য মেলা দুষ্কর! নানা মহিলাশিল্পীর জীবনী তাঁদের জীবনের প্রভূত বাধাবিপত্তির সাক্ষ্য বহন করছে, যা আসে পরিবার ও সমাজ থেকে। শিল্পের পথ মোটেই সুগম নয়, কিন্ত মেয়েদের জন্য তা আরও কণ্টকপূর্ণ।
বাংলার চিরাচরিত কাব্য মনসামঙ্গলে, বেহুলা তাঁর মৃত স্বামী লখিন্দরকে ফিরে পাওয়ার জন্য মেতে উঠেছিলেন এক অপরূপ নৃত্যে। যা ফিরিয়ে দিয়েছিল তাঁর স্বামীকে। কবি আল মাহমুদ তাঁর ‘সোনালি কাবিন’ শীর্ষক কবিতার একটিতে বেহুলার উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘নিটোল তোমার মুদ্রা পালটে দিক বাঁচার নিয়ম’। সভ্যতার ব্যাটন ধরা আছে পুরুষ-নারী-তৃতীয় লিঙ্গ– সব্বার হাতেই। আমাদের মানসিক অবস্থানকে সহনশীলতা, সমানুভূতি, পারস্পরিক বোঝাপড়ার পথে নিয়ে গিয়ে বাঁচার নিয়ম আমরা কবে পালটাতে পারব? আদৌ পারব কি?
একজন অবতার-পুরুষ যুগকে কেন্দ্র করেই আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাই যুগের ব্যাধি, বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করতে কখনও ভুল করতে পারেন? আমরা এইবার কথামৃত পাঠ করব। ভগবানের কথা ব্যাখ্যা করার অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু ভগবানের কথা স্মরণ ও ভাবার প্রয়োজন।