‘বেবি রেইনডিয়ার’-এর কাহিনিতে আরও বহু বাঁক আছে। নির্মাণের নাম ‘বেবি রেইনডিয়ার’ কেন, তাও দর্শক উপলব্ধি করবে। হয়তো কাউকেই দর্শক বিচার করবে না আবার মানুষের কতরকম চরিত্রের চড়াই-উতরাই থাকতে পারে সে সম্পর্কেও ধারণা গড়ে উঠবে। আধুনিক জীবনের যে শত জটিলতার মধ্যে দিয়ে মানুষকে যেতে হয় তার এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল এই নির্মাণ।
লন্ডনের এক পানশালায় বারটেন্ডারের কাজ করে ডনি (রিচার্ড গ্যাড)। শীর্ণ কিন্তু উদ্দীপ্ত চেহারা, দীর্ঘ নাসা, চওড়া চোয়াল আর সবুজ চোখের ডনি ভাবুক প্রকৃতির যুবক। তার আবেগকেও নিয়ন্ত্রিত বলা চলে না। এহেন ডনি একদিন পানশালায় আগত এক ক্রেতা-মহিলাকে ফ্রি চা-এর প্রস্তাব দেয়। সেই মহিলা– মার্থা, যার মুখটা বিষণ্ণ, মনে হয় একটু আগেই সে কেঁদেছে– ডনির হাতের চা পেয়ে খুশি হয়। কিন্তু তার এই ক্ষণিকের সুখ পর্যবসিত হয় এক রকম বদ্ধসংস্কারে, যা চলতি মনস্তত্ত্বে আমরা ‘অবসেশন’ বলে বুঝি। এরপর থেকে কেবল একদিন আগে দেখা হওয়া ডনির প্রতি মার্থার ব্যবহার কেমন পাল্টে যায়। সে প্রতিদিন পানশালায় আসতে শুরু করে। একেকদিন একেকটি সাজে আসে। কোথা থেকে ডনির ইমেল-ঠিকানা জেনে ক্রমাগত তাতে মেসেজ করে যেতে থাকে মার্থা (জেসিকা গানিং)। প্রতিটি বার্তাই ডনির প্রশস্তিসুলভ; মার্থা ডনির সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হতে চায়– সেইরকম বার্তাতেই ভরপুর মেসেজ সব।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীশরীর ভোগ্যবস্তু বলে নারীকে তথাকথিত সুরক্ষা দেওয়ার নামে অনেক আইন গড়ে উঠলেও ঠিক উল্টোটা যখন হয়, যখন একজন নারী কোনও পুরুষের সম্মতির তোয়াক্কা না করে তাকে যৌনতার নির্লজ্জ প্রস্তাব দেয় তখন সেসব ঘটনাকে আমরা লঘু করে দেখি। আমাদের মনে হয় ‘প্রিডেটর’ বুঝি কেবল পুরুষই হতে পারে, নারী নয়। ডনির ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটে চলে। ছ’মাস মার্থার দ্বারা হেনস্তা হতে হতে ডনি যখন পুলিশে নালিশ জানানোর সাহস সঞ্চয় করে থানায় উপস্থিত হয়, কর্তব্যরত পুলিশ-আধিকারিকও ডনিকে প্রথমে পাত্তা দিতে চায় না। কিন্তু যখন জানতে পারা যায় এহেন ব্যবহারের জন্য পুলিশের কাছে এর আগেও মার্থার অপরাধের রেকর্ড আছে তখন থানা নড়েচড়ে বসে।
নেটফ্লিক্স দুনিয়ায় সাড়া ফেলে দেওয়া সাম্প্রতিক সিরিজ ‘বেবি রেইনডিয়ার’-এর দু’টি চরিত্র ডনি ও মার্থা। এই সিরিজের এত জনপ্রিয়তার একটি কারণ হতে পারে যে, ‘অ্যাবিউজ’ বা ‘স্টকিং’-এর চাপা ভয়বহতার শিকার বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ। কাজের জায়গায়, নিজের বাড়িতে, পথেঘাটে শিশু থেকে বৃদ্ধ– প্রতিটি মানুষই নানারকম ‘অ্যাবিউজ’-এর মধ্যে দিয়ে যেতে পারে। মুশকিল হল, একজন ‘ভিক্টিম’ অনেক সময়ই টের পায় না সে সত্যিই ‘অ্যাবিউজ’-এর শিকার হয়েছে। সেজন্য ডনির প্রাথমিক দিকে মনে হয়নি মার্থার ব্যবহারে সে মানসিকভাবে কতটা বিধ্বস্ত হচ্ছে। বরং উল্টে সে ভেবেছে যে মার্থার সাহচর্য দরকার। তবে সাত-সিরিজের এই নির্মাণ ধীরে ধীরে পাখা মেলতে শুরু করলে আমরা টের পাই, ডনির এমন ভাবনা-চিন্তার পেছনের অন্য কারণগুলি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীশরীর ভোগ্যবস্তু বলে নারীকে তথাকথিত সুরক্ষা দেবার নামে অনেক আইন গড়ে উঠলেও ঠিক উল্টোটা যখন হয়, যখন একজন নারী কোনও পুরুষের সম্মতির তোয়াক্কা না করে তাকে যৌনতার নির্লজ্জ প্রস্তাব দেয় তখন সেসব ঘটনাকে আমরা লঘু করে দেখি। আমাদের মনে হয় ‘প্রিডেটর’ বুঝি কেবল পুরুষই হতে পারে, নারী নয়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ডনির যৌনপছন্দ নানাবিধ। লন্ডনে এসে সে যখন অভিনয় শিখছে আর বিভিন্ন পানশালায় কৌতুকাভিনয় করছে তখন তার সঙ্গে আলাপ হয় ড্যারিয়েনের। ড্যারিয়েন (টম গুডম্যান-হিল) একটি জনপ্রিয় টিভি শো-এর লেখক। কাজ দেওয়ার প্রলোভনে দিনের পর দিন ডনিকে বাড়িতে ডেকে, বিভিন্ন নেশাদ্রব্য সেবন করিয়ে ড্যারিয়েন যখন দেখত ডনি অচেতন হয়ে পড়েছে সে তখন তার ওপর যৌননির্যাতন চালাত। ডনি এই সবকিছুই বুঝত। কিন্তু ড্যারিয়েনের কাছে আসা বন্ধ করত না। তবে কী সে নির্যাতিত হতে চাইত? অত্যাচারীর সঙ্গে অত্যাচারিতের সেই চিরাচরিত মর্ষকামের সম্পর্কই কী ছিল ড্যারিয়েন আর ডনির মিলনের ভিত্তি? ড্যারিয়েনের কাছ থেকে ডনি সরে আসে পরের দিকে কিন্তু তার আত্মাবিষ্কারের মত্ততা এরপরেও বহু লিঙ্গ ও যৌনতার মানুষের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে পড়তে চালিত করে। তবে কোনও জড়ানোতেই সে ভালোবাসা খুঁজে পায় না। এক সময় কিলি (শ্যালোম ব্রুন-ফ্র্যাঙ্কলিন) নামের কৃষ্ণাঙ্গি ক্লাসমেটের সঙ্গে তার সম্পর্ক তৈরি হয় বটে, কিন্তু কিলি ডনির অপারগতা উপলব্ধি করে। সে ডনির থেকে দূরে গেলেও তার বাড়িতেই ডনি বহুদিন বসবাস করতে থাকে।
ডনির উচিত ছিল ড্যারিয়েনের বিরুদ্ধে পুলিশে রিপোর্ট করা। কিন্তু সে সেটা করে উঠতে পারে না। মার্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেও সে দেরি করে। ডনি নিজেকে চিনে ফেলতে ফেলতেও নিজের কাছেই প্রতি মুহূর্তে অচেনা রয়ে যায়। টেরি (নাভা মাউ) নামের যে আমেরিকান থেরাপিস্টের প্রতি তার ভালবাসা জন্মায় তাকেও নিজের কাছে পুরোপুরি টেনে নিতে তার কোথাও অস্বস্তি হয়। কারণ, টেরি রূপান্তরকামী-নারী। কিন্তু টেরিই ডনির মনস্তত্ত্বের প্রায় আশি ভাগ প্রকৃত হিসেব তৈরি করে দেয়। তার মতে, ডনির প্রতি মার্থা নানারকম হেনস্তা-হিংসার ঘটনা ঘটালেও ডনি মার্থার প্রতি আরও কর্কশ হয়ে উঠতে পারে না, তার কারণ ডনি নিজেকে যেভাবে দেখতে চায় সেই প্রতিষ্ঠিত, সাফল্যমণ্ডিত, দুর্বার পুরুষের রূপরেখা মার্থা বারবার এঁকে দিতে চায়। এতে ডনির কোথাও মানসিক প্রশান্তি হয়তো আসে। মার্থার জন্যই কমেডি প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে পৌঁছে যায় ডনি। কিন্তু জীবনের এমন বিবিধ জটিলতার মধ্যে দিয়ে নিজেকে বয়ে নিয়ে চলা ভীষণই কঠিন কাজ। ডনির মন, মস্তিষ্কে ভাঙন নেমে আসে। সে সাময়িক সাহচর্যের জন্য মা-বাবার কাছে ফিরে যায়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন ভাস্কর মজুমদার-এর লেখা: যৌনসারল্যে শরীরকে আবিষ্কার করার স্বাভাবিকতাই ‘পুওর থিংস’-এর ম্যাজিক
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কিন্তু ‘বেবি রেইনডিয়ার’-এর কাহিনিতে আরও বহু বাঁক আছে। নির্মাণের নাম ‘বেবি রেইনডিয়ার’ কেন, তাও দর্শক উপলব্ধি করবে। হয়তো কাউকেই দর্শক বিচার করবে না আবার মানুষের কতরকম চরিত্রের চড়াই-উতরাই থাকতে পারে সে সম্পর্কেও ধারণা গড়ে উঠবে। আধুনিক জীবনের যে শত জটিলতার মধ্যে দিয়ে মানুষকে যেতে হয় তার এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল এই নির্মাণ।
অসাধারণ এক চিত্রনাট্য ‘বেবি রেইনডিয়ার’ এবং তেমন অপূর্ব প্রতিটি কলাকুশলীর অভিনয়। পুরনো ব্রিটিশ সিনেমার যে ঘরানা– সেই মধ্যবিত্তের, মানবিক সম্পর্কের সংলাপধর্মী গল্প, যা কেন লোচ কিংবা মাইক লি-এর নির্মাণগুলিতে দেখতে পাওয়া যায়– সেই সুর ‘বেবি রেইনডিয়ার’-এ ধরা আছে। কিন্তু লিঙ্গ-যৌনতা ও মনস্তত্ত্বের বিবিধ প্রকরণ নিয়ে এমন গভীর নির্মাণ বিশেষত সিরিজ, এর আগে তেমন করে চোখে পড়েনি।
‘বেবি রেইনডিয়ার’ সেদিক থেকে যেন একটি নতুন ‘টেক্সট’। আর এ-নির্মাণের উজ্জ্বলতা এখানেই যে অত্যাচারী ও অত্যাচারিত– দু’জনের প্রতি সমান মায়াভরা বিশ্লেষণে সে এগিয়ে পড়েছে। এই সিরিজ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা খুব শিগগির বন্ধ হবে না। ভাবনার আরও নানা পরত খুলে যাবে নিঃসন্দেহে। ‘বেবি রেইনডিয়ার’-এর নির্মাতা রিচার্ড গ্যাডকে ধন্যবাদ।