‘নির্ঝর’ প্রকাশিত দেবাঙ্গন বসুর সম্পাদিত ‘অপ্রকাশিত-অগ্রন্থিত শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রস্মৃতি’ বইটিতে আছে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা থেকে রবীন্দ্র-তিরোধান পর্যন্ত প্রথম ৪০ বছরের নানা স্মৃতিবাহী ৩৪টি রচনা। এগুলির মধ্যে পাঁচটি ইংরেজিতে লেখা, বাকিগুলি বাংলায়। শান্তিনিকেতনের যে-ছবি আমাদের স্মৃতিতে খোদাই করা আছে, এ-বইয়ের শুরুতে অবনীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাটি সেই তারেই বেঁধে দেয় পাঠকের মনকে। তারপর এক লম্বা সফর– যে পথে গেল শান্তিনিকেতন। তার দিনরজনী। অমৃতরসের উথলে ওঠা। সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’-এর ‘সংযোজন’ অংশে দু’টি অভিনব শব্দবন্ধের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, ‘শিক্ষার কারাগার’ আর ‘শিক্ষার স্বাধীনতা’। সাহেবদের চালু করা বিদ্যাদানের কারখানায় ছোটবেলায় প্রচুর মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন তিনি। মালয়ালম কবিতায় নতুন যুগের অন্যতম পুরোধা আইয়াপ্পা পানিকর যাকে অনেক পরে বলবেন ‘শিক্ষার সার্কাস’, তার আয়োজন মাঝারি মাপের মানুষ তৈরি করার জন্য। সিলেবাস নামক প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন, নিরালোক, নিষ্ঠুর জরদ্গব মাথায় চাপিয়ে কোনওমতে নির্ধারিত বছরগুলো কাটানো। ‘নীরস পাঠ্য’, ‘কঠোর শাসনবিধি’ আর ‘প্রভুত্বপ্রিয়’ শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে শিশু তেমন লালন পায় না, যার জন্য সে ইশকুলমুখী হবে। এর সঙ্গে আধুনিক ভারতের অর্থব্যবস্থাও কম দায়ী নয়।
রবীন্দ্রনাথ সচেতন চেষ্টা চালিয়েছেন শিক্ষার কারাগারের অচলায়তন ভাঙতে। পাখি-পড়া শিক্ষাব্যবস্থার শেকলকে বিকল করতে। তিনি নিজে ছিলেন ইশকুল-পালানো ছেলে। কিন্তু পড়াশোনায় অনুৎসাহী ছিলেন না। ‘জীবনস্মৃতি’-তে যখন ফিরে দেখেন প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিন, তখন সেখানে কী শিখেছেন আদপেই মনে পড়েনি তাঁর। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি এবং নর্মাল স্কুলের পীড়াদায়ী দিনগুলি ‘এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায় দেখ’! রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ ছিল সেখানে সহপাঠীদের ‘বন্ধু’ হিসেবে না-পাওয়ায়। পরিণত বয়সে তিনি এই বিশ্বাসেও উপনীত হন যে, ‘অন্তত জীবনের আরম্ভকালে নগরবাস প্রাণের পুষ্টি ও মনের প্রথম বিকাশের পক্ষে অনুকূল নয়’। তিনি যে নিজেকে শিক্ষার কারখানা থেকে সযত্নে বাঁচাতে পেরেছিলেন, তাতে বিরাট ভূমিকা ছিল তাঁর পরিবারের।
বছর তিরিশেক বয়সে জমিদারি তত্ত্বাবধানের জন্য প্রত্যক্ষভাবে গ্রামবাংলার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সূত্রপাত। সেই সময় থেকেই তাঁর মনে বিশ্বপ্রকৃতির ঝরনামুখটি খুলে যায়। তিনি ক্রমশ অনুভব করতে থাকেন নিখিলকে নিজের প্রাণের মধ্যে পাওয়া, চেতনার অংশীদার করতে পারা, বোধের সংলগ্ন করে একান্ত আত্মীয়রূপে পাওয়াই ভারতবর্ষের উত্তরাধিকারকে আত্মস্থ করা। বেদের যুগ আর প্রতিবাদী বৌদ্ধ যুগ তাঁর দীর্ঘ অনুধ্যানের বিষয়। তাই খুব স্বাভাবিকভাবে তিনি বলেন– ইন্দ্রিয়, জ্ঞান বা কারখানার দক্ষতা বাড়ানোর শিক্ষা নয়, ভারতের দরকার প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে তপস্যার পবিত্রতাও। আবার একইসঙ্গে গ্রামের পানাপুকুরের ধারে ম্যালেরিয়ায় ফুলে-ওঠা-পেটের শিশুটির দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়াও মূল্যবোধের আবশ্যিক অঙ্গ বলে তিনি ভাবতেন। বোলপুরে ব্রহ্মচর্যাশ্রম গড়ে তোলার চেষ্টাও ছিল প্রায় এমনই এক সিদ্ধান্ত। ব্রহ্মচর্যাশ্রম কার্যত ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় গড়পড়তা মানুষ বানানোর যে আদল, তারই কাউন্টার স্টেটমেন্ট।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
নিজের ভাবনাকে সাকার করার প্রত্যক্ষ সুযোগ রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথের জন্য লেখাপড়ার আয়োজন করতে গিয়ে। প্রচলিত ব্যবস্থায় রথীন্দ্রনাথকে বিদ্যালয়ে পাঠালে কোনও সমস্যা হত না। কিন্তু কবি কী করে ভুলবেন বিশ্বক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন শিক্ষালয়ের সীমাবদ্ধতার কথা। আবার অন্যদিকে ছিল অনভ্যস্ত পথ আর অপরীক্ষিত পদ্ধতির ব্যর্থতার সম্ভাবনা। কিন্তু অদম্য মানসিকতার জোরে রবীন্দ্রনাথ ১৯০১-এ শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করলেন ব্রহ্মচর্যাশ্রম, যা ২০ বছর পরে পরিবর্ধিত হয়ে ‘যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্’-এর আদর্শ সামনে রেখে গড়ে ওঠে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
নিজের ভাবনাকে সাকার করার প্রত্যক্ষ সুযোগ রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথের জন্য লেখাপড়ার আয়োজন করতে গিয়ে। প্রচলিত ব্যবস্থায় রথীন্দ্রনাথকে বিদ্যালয়ে পাঠালে কোনও সমস্যা হত না। কিন্তু কবি কী করে ভুলবেন বিশ্বক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন শিক্ষালয়ের সীমাবদ্ধতার কথা। আবার অন্যদিকে ছিল অনভ্যস্ত পথ আর অপরীক্ষিত পদ্ধতির ব্যর্থতার সম্ভাবনা। কিন্তু অদম্য মানসিকতার জোরে রবীন্দ্রনাথ ১৯০১-এ শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করলেন ব্রহ্মচর্যাশ্রম, যা ২০ বছর পরে পরিবর্ধিত হয়ে ‘যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্’-এর আদর্শ সামনে রেখে গড়ে ওঠে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। শান্তিনিকেতনের এই শিক্ষাসত্রের জন্য রবীন্দ্রনাথ তাঁর সঞ্চয়ের শেষ কণাটুকুও ব্যয় করেছেন। রিক্ত হাতে সারা দুনিয়া ঘুরে বেরিয়েছেন কিছু অর্থসংগ্রহের আশায়। কোথাও সফল হয়েছেন, ব্যর্থমনোরথেও ফিরতে হয়েছে কখনও। তবু শান্তিনিকেতনে প্রাত্যহিকতার সঙ্গে কলাবিদ্যার এমন শিল্পিত সমাধান যে কোনও সৃজনশীল মানুষকেই আবিষ্ট করে। যদিও এই সব পেয়েছি-র দেশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে-স্বপ্ন দেখেছিলেন তাতে কেবলই অনন্ত সূর্যোদয় ছিল না।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: লেখক, প্রকাশকের জন্য ‘আত্ম-উন্নয়নমূলক’ কাজ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রবীন্দ্রনাথের এই শিক্ষাভাবনা যে সমকালে সর্বত্র খুব সমাদৃত হয়েছিল, এমনও নয়। বন্ধু যদুনাথ সরকারের সঙ্গে তাঁর শিক্ষানীতির বিরোধের কথা তো বেশ প্রচারিত। রবীন্দ্রনাথ নিজেই জানিয়েছেন একটি বক্তৃতাসভার কথা, যেখানে তিনি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভারতীয় উপাচার্য গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সেখানে কথা প্রসঙ্গে বলেন আধুনিক যুগে শিক্ষার উপাদান বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তাঁর রূপ ও রস নির্মাণ করতে হবে প্রকৃতির সমবায়ে এবং শিক্ষকের আধ্যাত্মিকতার কোমল স্পর্শে। এই কথা শুনে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন: ‘এ কথাটি কবিজনোচিত, কবি এর অত্যাবশ্যকতা যতটা কল্পনা করেছেন আধুনিক কালে ততটা স্বীকার করা যায় না।’
কিন্তু তাঁর এই নিরীক্ষা নেহাত খামখেয়াল ছিল না, ছিল গভীর বিশ্বাসের প্রতিফলন। তিনি চেয়েছিলেন আধুনিক পৃথিবীতে একটুকরো তপোবন। বিশ্বমানবের ধারণায় বিশ্বাস রেখে কোনওদিন প্রশ্রয় দেননি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে। তাই গোটা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানুষ আর মানবসমাজের সামূহিক ইতিবাচক মূল্যবোধের নির্যাস দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিলেন আশ্রমের চৌহদ্দি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: বহুস্বরে বিশ্বদর্শন
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এ-বাগ্বিস্তারের কারণ সম্প্রতি হাতে আসা ‘নির্ঝর’ প্রকাশিত একটি সুসম্পাদিত বই– ‘অপ্রকাশিত-অগ্রন্থিত শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রস্মৃতি’। দেবাঙ্গন বসুর সম্পাদনায় প্রকাশিত বইটিতে আছে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা থেকে রবীন্দ্র-তিরোধান পর্যন্ত প্রথম ৪০ বছরের নানা স্মৃতিবাহী ৩৪টি রচনা। এগুলির মধ্যে পাঁচটি ইংরেজিতে লেখা, বাকিগুলি বাংলায়।
শান্তিনিকেতন যে-লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই ব্যতিক্রমের কতটুকু আজ অবশিষ্ট, তা নিয়ে বিস্তর তর্ক চলতে পারে। কিন্তু সাধারণভাবে বাঙালির আগ্রহ শান্তিনিকেতনের সেকাল নিয়ে। তাই এ-বিষয়ে স্মৃতিমূলক লেখার অভাব নেই কোনও। আর রোমন্থনের স্বাভাবিক রসায়নে তাতে পুনরাবৃত্তির চর্বিতচর্বনের পরিমাণ কম নয়। ফলে এ-বিষয়ে কোনও সংকলনে চোখ রাখলে কেবলই পুরনো লেখা নতুন করে পড়ে যেতে হয়। কিন্তু দেবাঙ্গন আমাদের সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছেন বলা যায়। রবীন্দ্রভবন অভিলেখ্যাগার থেকে মোট ২৩টি লেখা উদ্ধার করেছেন সম্পাদক। তার মধ্যে সাতটি আগেই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তাই অপ্রকাশিত লেখার সংখ্যা ১৬।
শান্তিনিকেতনের যে-ছবি আমাদের স্মৃতিতে খোদাই করা আছে, এ-বইয়ের শুরুতে অবনীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাটি সেই তারেই বেঁধে দেয় পাঠকের মনকে। তারপর এক লম্বা সফর– যে পথে গেল শান্তিনিকেতন। তার দিনরজনী। অমৃতরসের উথলে ওঠা। সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………
এই ধরনের সংকলনের আরেকটি সমস্যা হল বহুলপঠিত লেখা বর্জনে। সম্পাদকরা খুব স্বাভাবিক কারণেই সে-লেখাগুলি এড়িয়ে যেতে চান। কিন্তু কিছু মানুষ শান্তিনিকেতনের কথামালায় এমনই অচ্ছেদ্য যে, তাঁদের বাদ দিলে সংকলন সামগ্রিকতা পায় না। এই সংকট শান্তিনিকেতন-বিষয়ক যে কোনও সংকলনকেই বয়ে বেড়াতে হয়। দেবাঙ্গন বসুর বাড়তি ধন্যবাদ প্রাপ্য এই কারণে যে, বইয়ের পরিশিষ্টে তিনি শান্তিনিকেতন-চর্চায় জরুরি বইপত্রের (নির্বাচিত) একটি তালিকা প্রণয়ন করে দিয়েছেন। তবে যেহেতু এই বইয়ের ভরকেন্দ্র অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত স্মৃতিমূলক রচনা, তাই বইয়ের শেষে সংযোজিত সম্পাদক-প্রণীত ‘স্মৃতিদীপালোকে শান্তিনিকেতন’ রচনাটি অপরিহার্য মনে হয় না।
অপ্রকাশিত-অগ্রন্থিত শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রস্মৃতি
সম্পাদনা দেবাঙ্গন বসু
প্র. প্র. জানুয়ারি ২০২৪
নির্ঝর। মূল্য ৬৯৫ টাকা