খাদ্যের ভাঁড়ারে টান পড়েছিল সে-ও অনেক দিনের কথা। এর পরের ধাপ হিসেবে শক্তিশালীদের দুর্বলের থেকে কেড়ে খাওয়াটা ছিল অবশ্যম্ভাবী। সমস্ত কমজোরি লোক এভাবে না খেয়ে মারা পড়ার পর, যখন আর কোনও উপায় নেই, তখন শুরু হয় খাওয়া কমানোর নিয়ম। আর, আধপেটা খেয়ে বেড়ে-ওঠা জেনারেশনের কাছে, বা তাদের একই রকম বুভুক্ষু নেতাদের কাছে দূরদর্শিতা আশা করা যায় না।
১৮.
‘অশান্তি ঘনিয়ে এসেছিল বহুকাল আগে থেকেই। যুগের পর যুগ কোনও দেশের রাষ্ট্রনায়কই জনসংখ্যা প্রতিরোধের কথা সিরিয়াসলি ভাবেনি। বরং কোথাও অজ্ঞতা থেকে, কোথাও ধর্মের দোহাই দিয়ে, কোথাও স্রেফ টাকার অহংকারে দ্বিগুণের চেয়েও অনেক বেশি হারে লোক বেড়েই চলেছিল সর্বত্র।
খাদ্যের ভাঁড়ারে টান পড়েছিল সে-ও অনেক দিনের কথা। এর পরের ধাপ হিসেবে শক্তিশালীদের দুর্বলের থেকে কেড়ে খাওয়াটা ছিল অবশ্যম্ভাবী। সমস্ত কমজোরি লোক এভাবে না খেয়ে মারা পড়ার পর, যখন আর কোনও উপায় নেই, তখন শুরু হয় খাওয়া কমানোর নিয়ম। আর, আধপেটা খেয়ে বেড়ে-ওঠা জেনারেশনের কাছে, বা তাদের একই রকম বুভুক্ষু নেতাদের কাছে দূরদর্শিতা আশা করা যায় না।
শেষ লড়াইটা ছিল জল নিয়ে। পানীয় জলের দখলের। যুদ্ধের চরম পর্যায়ে প্রত্যেক রাষ্ট্রনেতাই ভেবেছিলেন, আর কারোই তাঁর মতো সাহস হবে না।’
এভাবেই শুরু হচ্ছে অনুষ্টুপ শেঠের গল্প ‘ভিত্তি’। প্রবল রসবোধে টইটম্বুর এই লেখকের কলম। সাই-ফাই এর ভাষায় যাকে বলে বিশ্ব গঠন বা ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং, তার হদ্দুমুদ্দ করেন অনুষ্টুপ কিন্তু একইসঙ্গে সেটা করেন বাংলা-ইংরেজি মেশানো এক জগাখিচুড়ি ভাষায়, যে ভাষার বোধ তিনি আমদানি করেছেন তাঁর নিজস্ব পাঠবলয় থেকে, যে পাঠবলয় শরদিন্দু-পরশুরাম থেকে শুরু করে উপেন্দ্র-সুকুমার-সত্যজিৎ-লীলা অবধি উপস্থিত। সরস কিন্তু বুদ্ধিমন্ত নানা নামকরণে মনে পড়বেই হিজবিজিবিজ বা দ্রিঘাংচুদের।
‘ল্যাবের সামনে, তেয়াটুয়ার ঘরের বাইরের বাগানে হাঁটতে হাঁটতে ভিশি এসবই ভাবছিল। তেয়াটুয়ার হাঞ্চিক্স হয়েছে, এখন টানা তিন দিন অপরান-হো আসবেন না। তেমনই নিয়ম, যাতে আর কারও রোগটা না হয়। তাই ল্যাব এখন ভিশির একার দখলে বলা যায়।
এখন তো সব কিছুই প্লাস্টিকাই দিয়ে বানানো হয়। আর কিছু ভেবে না পেলে সেটা দিয়েই রেপ্লিকা করার কথা ভাবতে হবে ভিশিকে। কিন্তু আইডিয়াটা কেমন যেন খেলো-খেলো লাগছিল ওর, মন উঠছিল না। তেয়াটুয়া অবশ্য বলেছিলেন, পাঁচ নম্বর গ্রহ টেরামিরাহা থেকে আনা রকোপিস জুড়ে জুড়ে তৈরি করা যায় কি না দেখতে, কিন্তু আজই হিসেব শেষ হল ওর, ওটা ব্যবহার করলে ডেনসিটি এতটাই পাল্টে যাচ্ছে ইকুয়েশনের থেকে যে ব্যালান্স থাকবে না। সব ওলটপালট হয়ে যাবে, হয়তো দম দিলেও চলবে না আর।
তাই বেশ দুশ্চিন্তা নিয়ে পায়চারি করছিল ভিশি। বাগানের ছ-নম্বর কোনাটা ঘুরেই থ হয়ে গেল। এটা আবার কোত্থেকে এল?
ইয়াব্বড় একটা গোলক। এবড়োখেবড়ো গা। সারা গা ভর্তি বেজায় নোংরা। বাগানটা এদিকে এমন তছনছই বা হয়ে গেল কী করে!
চেনা কিছু নয়, সেটা নিশ্চিত। তবু, ভিশির কেমন চেনা-চেনা লাগে সাইজটা…’
………………………………………………
প্রবল রসবোধে টইটম্বুর এই লেখকের কলম। সাই-ফাই এর ভাষায় যাকে বলে বিশ্ব গঠন বা ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং, তার হদ্দুমুদ্দ করেন অনুষ্টুপ কিন্তু একইসঙ্গে সেটা করেন বাংলা-ইংরেজি মেশানো এক জগাখিচুড়ি ভাষায়, যে ভাষার বোধ তিনি আমদানি করেছেন তাঁর নিজস্ব পাঠবলয় থেকে, যে পাঠবলয় শরদিন্দু-পরশুরাম থেকে শুরু করে উপেন্দ্র-সুকুমার-সত্যজিৎ-লীলা অবধি উপস্থিত।
………………………………………………
নামকরণের হদ্দ হয়েছে তাঁর দু’টি চরিত্রে, বহুবিজ্ঞব্যতিক্রমী এবং ভাবাবেশচূর্ণকেশ। তাছাড়াও গ্রহের নামকরণ করেছেন অনুষ্টুপ, যথা, গ্যালাক্সি উনোর সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম সূরিয়াকোটি। সমাজে বর্ণাশ্রম কল্পনা করে নানা ধরনের জাতি বা গোষ্ঠীর নাম দিয়েছেন। ‘‘সব কাজ তো ‘বিয়াশ-ও’রা আর আমরা ‘সু-ড্রো’রা করি। ব্রো-মাহনীগুলো স্রেফ বসে বসে আয়েশ করে।’’ কাউকে বদমায়েশ বললে, ইস্কুলের ‘স্ল্যাংপিকার’ যন্ত্র লাল হয়ে যায়, বা কোন জিনিস দূরে ছুড়ে দিলে, লোঞ্জোন-এর ভেতরে মেরুন গাছের ভেতর দিয়ে (একাকীত্বের এলাকা? ভাষার খেলায় আবিষ্ট করে দেন অনুষ্টুপ) লাক্সম্যান লাইন (লক্ষ্মণরেখা) পেরিয়ে চলে যায়… এমন কত যে ভালো ভালো আরোপ, ভাল ভাল সৃষ্টি, ভালো কনস্ট্রাক্ট করেন লেখক, মেধাবী ও রসবোধ সম্পন্ন। মনে পড়ে যায় গিরগিটিয়ার কথা। মনে পড়ে যায় সিংহরিণ।
এই ‘ভিত্তি’ নামক অনুষ্টুপের সিগনেচার গল্পটি সংকলিত আছে নারী কল্পবিজ্ঞানের বই ‘কঙ্কাবতী কল্পবিজ্ঞান লেখেনি’ নামক বইতে, কল্পবিশ্ব প্রকাশনা থেকে যে বই ইতিমধ্যেই বেশ জনপ্রিয়।
সুকুমারকথিত হযবরল-র সেই একটা লোক যে বাড়ির নাম ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ রাখতেই সেটা ভেঙে পড়ে গিয়েছিল– সেই ফরমুলাকেই যেন অনেকদূর অবধি এগিয়ে নিয়ে গেছেন এই মেধাবিনী, যিনি কর্মসূত্রে আইটিবাজ। ইনফোসিস বা ওরাকলের মতো কোম্পানিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর ঝুলিতে। ছোটবেলায় ‘ফ্যান্টাস্টিক’ বার্ষিকী কিনে পড়তেন। নেশাটা তখন থেকেই। প্রথম বড় উপন্যাস লিখতে যখন ইচ্ছা হল, ‘মিশন: পৃথিবী’ নামের উপন্যাস লিখলেন অনুষ্টুপ। যা সম্ভবত এপার বাংলার প্রথম প্রাপ্তমনস্ক ফ্যান্টাসি। তারপর কল্পবিশ্ব পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হলেন, ২০১৬ থেকে যে পত্রিকাটি চলেছে ক্রমাগত বাংলায় কল্পবিজ্ঞান চর্চার পথে। অনুষ্টুপের এই মুহূর্তে ১২টা বই। বড়দের-ছোটদের বিভিন্ন জঁরে। শুধু সায়েন্স ফিকশন ফ্যান্টাসির মধ্যে আছে ‘মিশন: পৃথিবী’, ‘অন্তপ্রহর’ আর ‘শোণিতসোপান’। ‘অন্তপ্রহর’ সায়েন্স ফিকশন, বাকি দুটো লো ফ্যান্টাসি।
অনুষ্টুপ বলেন, তাঁর প্রিয় বিষয়, মানুষের নিজের মধ্যের দ্বন্দ্ব। নিজের ফ্যান্টাসির ভেতরে সে গল্পই বারবার বলতে চান তিনি।
মিশন পৃথিবী উপন্যাস দুই খণ্ড মিলিয়ে ৩৯২ পাতার। স্পেকুফিকশনের নিয়ম মেনে, এই কাহিনির ঘটনাকাল ভবিষ্যৎ। আর সেই ভবিষ্যৎ এ পৃথিবীর ওপর ঘটতে থাকা বিভিন্ন ঘটনা এবং তাদের সাক্ষী এই বই। আর সেই ঘটনা এতটাই ভয়াবহ যে তাতে পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য। কিন্তু সেই পৃথিবীকে বাঁচাতে বারবার ফিরে আসেন কেউ। হয়তো অন্য রূপে অন্য ভাবে। কিন্তু তিনি আসেন।
এই কাহিনি আগামীর, পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়েছে এক আতঙ্ক, আর সেই আতঙ্কের বীজ বপন করা ছিল পৃথিবীর নিজের বুকেই, বহুকাল ধরে, সবার চোখের আড়ালে। দিনের পর দিন মানুষ যেভাবে পৃথিবীর উপর শোষণ চালাচ্ছে, তাই সেই শোষণ রোধ করতে পৃথিবীর দখল নিতে আসে একদল প্রাণী। কিন্তু যতই হোক পৃথিবী তো মা, তাকে ছেড়ে কী মানুষ জীবনযাপন করতে পারে। পারে না, তাই তো রয়েছে আরও ঘটনা। আর সেই নতুনভাবে পৃথিবীকে বাঁচানোর এবং গড়ে তোলার লড়াই হল এই মিশন পৃথিবী।
আর এই লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছে অনেকেই। বিশেষ করে সেই পাঁচজন। লিজা, জিয়ান, জোহানা, করণ, আর ন্যাট। এদের সঙ্গে আছে পাঁচ অস্ত্র– কারও হাতে হাতুড়ি তো কারও আছে ঢাল, আবার কারও আছে ফলা। এর সঙ্গে সঙ্গে আছে পূর্বকথন। বানাকা নগরী এবং সেই চৌক পাতের কথা, কিন্তু তার সঙ্গেই মিলেমিশে গেছে অমরত্বের লোভ। ঊঙ্গাপাপা ও নোগা কিকি-র মতো মানুষরা। আরও আছে সুপার স্পিসিস এবং রেড ডায়াবোলা।
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….
শুধু তাই না, এর সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত হয়েছে মাইথোলজিকাল প্রাণী ‘বুরু’। আর আছে সাসান্দ্রা, ডেরেক, আং সুই, এবং রু। আর এদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে ‘দ্য কউন্টেস’ এবং ‘অপারেশন ভেনোমাডি গ্রিন’-এর মতো ঘটনা। আরও যে কত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে এই লেখা তার শেষ নেই, যেমন কে এই পাঁচ জন? তাদের কী কাজ? কী তাদের শক্তি? কী কাজে লাগে ওই চৌক পাত গুলো? কারা এই সুপার স্পিসিস? কী রেড ডায়াবোলা? ক্লাসিফায়েড লেভেল কী? আর সবথেকে বড় প্রশ্ন কে রু? কে এই রেজালিয়া দ্য ম্যাডাম সুপ্রিমো?
বাকিটা জানতে গেলে তো পড়তে হবে মিশন পৃথিবী ১ এবং ২ ।
(চলবে)
…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৭। একটি সন্তান অজৈবিকভাবে জন্ম নিচ্ছে পৃথিবীতে
পর্ব ১৬। অজানা জগৎ ঘিরে যে মুগ্ধতা, বন্দনা সিংয়ের কল্পবিজ্ঞানের সেটাই চালিকাশক্তি
পর্ব ১৫। মানুষ খুন না করেও যুদ্ধে জেতা সম্ভব, দেখিয়েছে এলিজাবেথ বেয়ারের কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১৪। শরীরের খোলনলচে পাল্টে ফেলে দৌড়তে থাকে যারা
পর্ব ১৩। মানুষের বিরুদ্ধে গাছের ধর্মঘট কি কল্পবিজ্ঞান না বাস্তব?
পর্ব ১২। বাড়ির দরজা খুলে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় পৌঁছনো যায়, দেখিয়েছে কল্পবিজ্ঞান
পর্ব ১১। ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?
পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও
পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?
পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে
পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে
পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য
পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!
পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা
পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?
পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ
পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই