একদিকে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব-পরিবার। অন্যদিকে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর নিজের সংসার। প্রতিমার ক্ষেত্রে কোনওটিই বোঝা হয়ে ওঠেনি। সংগঠনের কুশলতা আর সৌন্দর্যবোধের যে রসায়ন তাঁর মনে ছিল, তা দিয়েই তিনি এই দু’টি ক্ষেত্রকেই গুছিয়ে নিয়েছিলেন। এবং পরবর্তীতে তার বৃহত্তর প্রয়োগ দেখা যায় শান্তিনিকেতনে।
রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে অল্প বয়সে প্রতিমা যে গানটি প্রথম শুনেছিলেন, সেটি ছিল, ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’। ঠাকুরবাড়ির উৎসবের এক সন্ধ্যায় ভৈরবীর সুরে সকলকে ‘অনির্বচনীয়ের স্পর্শ’ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবিকণ্ঠ সেদিন ছোটদের কাছে যেন ছিল পৃথিবীতে ‘নতুন স্বর’ এবং ‘মর্তলোকের নতুন পরিচয়’। বহু পরে স্মৃতিচিত্রে সেই মুহূর্ত তুলে রাখতে ভোলেননি প্রতিমা। যে প্রতিমা উত্তরজীবনে রবীন্দ্রনাথের অভিভাবিকা হয়ে উঠবেন, তাঁর এই স্মৃতির সম্পদ খুব ইঙ্গিতবাহী মনে হয়। আলোকপরশে যে কর্মচঞ্চল ভোরের ছবি এ গানে আক্ষরিকভাবে বিধৃত, সেই ভোর অন্য মাত্রা নিয়ে ছড়িয়ে গেল প্রতিমার জীবনেও। আমরা ক্রমে দেখতে থাকি, বাঙালির আশ্রয় রবীন্দ্রনাথ; আর রবীন্দ্রনাথের প্রতিমা।
রবিজীবনীর পাতা ওলটালেই বোঝা যায়, বিশ্বখ্যাত একজন মানুষের সঙ্গে তিনি শুধু আত্মীয়তায় নয়, কর্মজীবনেও ওতপ্রোত জড়িয়ে। সম্ভবত আমাদের গোড়ার ভুলটাও সেখানেই হয়ে যায়। আমরা, রবীন্দ্রনাথের পাশে পাশে প্রতিমাকে চিনতে শিখি বলেই, তাঁকে আলাদা করে আবিষ্কারের কথা তেমন ভাবি না। রবীন্দ্রগবেষক এবং বিশেষজ্ঞরা এ-কথায় ক্ষুণ্ণ হতে পারেন, কেন-না প্রতিমার লেখা, ছবি-নৃত্যের ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা একেবারে যে হয়নি, তা নয়। অনেক সময় রবীন্দ্রনাথকে বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়েছে সেই সব রচনা। তা সত্ত্বেও বলা যায়, রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে প্রতিমা যতখানি সাক্ষ্যদানের ভূমিকায় হাজির থাকেন, তাঁর প্রতিভা নিয়ে আলোচনা বরং অন্তরালেই। অথচ রবীন্দ্রভাবনায় কর্মের যে প্রেরণা, সংগঠনের ভাবনা, কাজ ও সৌন্দর্যের ভারসাম্যে জীবনের অনন্যতা খোঁজার যে প্রয়াস, তার একান্ত অনুসারী যদি কাউকে বলা যায়, তিনি প্রতিমা-ই। রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ‘স্বর ও বর্ণ’ পত্রিকাটি সাম্প্রতিক সংখ্যায় সেই প্রতিমাকে ফিরিয়ে এনেছে আলোচনায়; তা জরুরি নানা দিক থেকেই।
ব্যক্তিজীবনের ট্র্যাজেডি থেকে ঠাকুরবাড়ির প্রথম বিধবা-বিবাহে রবীন্দ্রনাথের বউমা হয়ে ওঠার পর্ব দিয়েই শুরু এই আলোচনার। তপতী মুখোপাধ্যায়ের নিবন্ধ এখানে আমাদের জানিয়ে দেয় যে, প্রতিমার চিন্তার জগৎ গোড়া থেকেই আলাদা। সময়ের দ্বন্দ্ব থেকে প্রগতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যুগ। অন্তঃপুরের বাসিন্দা হলেও সেই পথটি কিন্তু অনুমান করতে পেরেছিলেন প্রতিমা। ব্যক্তিগত জীবনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে না এলে কী হত বলা মুশকিল! তবে, তাতে তাঁর ভাবনার প্রসারতা আটকা পড়ে না। এমনকী, বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির বাসিন্দা হয়েও প্রতিমা বুঝতে পারছিলেন, ‘সেদিনের জীবন মেয়েদের পক্ষে যে খুব আরামের ছিল তা বলতে পারি না। একদিকে মনুর আইন আর একদিকে মুসলমানের পর্দা মেয়েদের অন্তঃপুরের আসবাব করে তুলেছিল, আর বাইরে পুরুষদের ছিল পরিপূর্ণ স্বাধীনতা।’
সামগ্রিক এই আবহে একই সঙ্গে তিনি এ-ও উপলব্ধি করতে পারছিলেন যে, খানিকটা হলেও ব্যতিক্রম তাঁর নিজের বাড়ি যেখানে, ‘জ্ঞানচর্চা, সাহিত্য ও সংগীতের মধ্যে মানুষ হওয়ার দরুণ নীর থেকে ক্ষীর গ্রহণ করবার রুচি তৈরি হয়েছিল।’ যেভাবে সমাজ এবং নিজের পরিবারের বিশিষ্টতাকে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন, তা থেকে সময় সম্পর্কে তাঁর স্বচ্ছ ভাবনার অভিমুখটি বেশ চেনা যায়। এবং পরবর্তীতে তাই শিল্প-সাহিত্যের তালিম-প্রশিক্ষণের যা সুযোগ পেয়েছেন, তা প্রায় শুষে নিয়েছেন প্রতিমা।
……………………………………………………………………………
ব্যক্তিজীবনের ট্র্যাজেডি থেকে ঠাকুরবাড়ির প্রথম বিধবা-বিবাহে রবীন্দ্রনাথের বউমা হয়ে ওঠার পর্ব দিয়েই শুরু এই আলোচনার। তপতী মুখোপাধ্যায়ের নিবন্ধ এখানে আমাদের জানিয়ে দেয় যে, প্রতিমার চিন্তার জগৎ গোড়া থেকেই আলাদা। সময়ের দ্বন্দ্ব থেকে প্রগতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যুগ। অন্তঃপুরের বাসিন্দা হলেও সেই পথটি কিন্তু অনুমান করতে পেরেছিলেন প্রতিমা।
……………………………………………………………………………
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেই পেয়ে গেলেন তাঁর শিক্ষক হিসাবে। একদিকে রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব-পরিবার। অন্যদিকে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর নিজের সংসার। প্রতিমার ক্ষেত্রে কোনওটিই বোঝা হয়ে ওঠেনি। সংগঠনের কুশলতা আর সৌন্দর্যবোধের যে রসায়ন তাঁর মনে ছিল, তা দিয়েই তিনি এই দু’টি ক্ষেত্রকেই গুছিয়ে নিয়েছিলেন। এবং পরবর্তীতে তার বৃহত্তর প্রয়োগ দেখা যায় শান্তিনিকেতনে। আমাদের প্রণিধানের বিষয় হল, প্রতিমার নিজেকে গড়ে নেওয়ার তাগিদ। সেই দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সুশোভন অধিকারী। ঠাকুরবাড়ির সুবাদে প্রতিমা হয়তো ব্যতিক্রমী কিছু সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে, যেভাবে তিনি নিজের মনকে তৈরি করেছিলেন তার উৎস অনেক গভীরে। রবীন্দ্রসান্নিধ্য নিশ্চয়ই একটি দিক। ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ তো বটেই। সেই সঙ্গে আছেন মাসিমা সুনয়নী দেবীও। প্রতিমা খেয়াল করেছিলেন, মস্ত পরিবারে ‘মেয়েলি’ হাসি-ঠাট্টার ভিতর থেকেও এই ‘অবান্তরে’ নিজেকে একেবারে মিশিয়ে দেননি। যত্নে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন শিল্পীমন। ভিড়ের মাঝে অপূর্ব একা তিনি। প্রতিমা সম্ভবত সেখান থেকেই পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁর জীবনসংগীতের ‘সা’। কর্মব্যস্ত জীবনে প্রতিমা যা-ই করে থাকুন না কেন, সেখান থেকে বিচ্যুত হননি।
প্রতিমার শিল্পীসত্তার প্রকাশের মাধ্যমও হয়ে উঠল চিত্রকলা। যে সময় মডেল-স্টাডি নিয়ে ঘোর আপত্তি নন্দলাল বসুর, এবং সেই সূত্রে আমরা রামকিঙ্কর-রাধারানির অধ্যায়টিকে পেয়ে যাই অন্য মাত্রায়, সেই সময়েই এই কাজটি করেছেন প্রতিমা দেবী। মনে রাখার মতো আরও একটি বিষয়, এই পর্বে প্রতিমার যে সংকোচ, তা কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে সাহস দিয়ে যান তাঁর স্বামী রথীন্দ্রনাথই। ড. শিল্পী দাস ও সুশোভন অধিকারীর প্রবন্ধ দু’টি বিস্তারে প্রতিমার এই শিল্পজীবনকে পর্যবেক্ষণ করেছে। রং-রেখার সঙ্গে সখ্যই যে পরবর্তীতে প্রতিমাকে নৃত্যের দিকে এগিয়ে দিল তাও স্পষ্ট। বাণীর ভিতর, সুরের ভিতর যে গতি এবং ছন্দ তা প্রতিমা ধরার চেষ্টা করলেন নাচের মুদ্রায়। অর্থাৎ, শরীরের ভাষা যেখানে অক্ষর হয়ে উঠছে, সেই মাধ্যমে মূর্ত-বিমূর্তের আর এক দিক তিনি স্পর্শ করতে চাইলেন। প্রতিমা প্রশিক্ষিত নৃত্যশিল্পী ছিলেন না। তবে, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে নৃত্যের সূত্রে বাঁধতে তাঁর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় চোখে পড়ার মতো। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও তিনি নতুন সৃজনে অনুপ্রাণিত করেছেন। এবং ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনৃত্যের এক ধারা। শ্রুতি বন্দ্যপাধ্যায়, অন্বেষা বাগচীর প্রবন্ধটি জানাচ্ছে, এই রীতি গড়ে তুলতে গিয়ে ভারতবর্ষের বৈচিত্রময় আত্মাটিই আত্মস্থ করেছেন প্রতিমা। আবার ভিনদেশের যা কিছু গ্রহণীয় তা বর্জন করেননি। এ যেন রবীন্দ্রনাথেরই দর্শন। বলা যেতে পারে, সেই উনিশ শতকে আধুনিকতা ও প্রগতির যে ভাবনা দুরন্ত গতিতে যাত্রা শুরু করেছিল, প্রতিমা তা আয়ত্ত করেছিলেন এবং প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর কাজে।
মুদ্রা-মঞ্চ-পোশাক-নৃত্য মিলিয়ে রাবীন্দ্রিক বিশিষ্টতার জন্ম তিনি দিতে পেরেছিলেন। এবং তা আক্ষরিক কেবল নয়, দৃশ্যত স্পষ্ট। এক অর্থে আজ আমরা রাবীন্দ্রিক বলতে যে রুচির গড় ধারণাটি বহন করি, প্রতিমা তাঁর আজীবনের সৃজন দিয়েই তা রচনা করেছিলেন। জ্যোৎস্না চট্টোপাধ্যায় চিঠির সূত্রে রবীন্দ্রনাথ ও প্রতিমার যে যোগাযোগ চিহ্নিত করেছেন, সেখানেও দেখা যায় পারিবারিকতার বাইরে, সৃষ্টি-সৃজনে উদ্ভাসিত তাঁদের সংলাপ। লেখালিখির জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর নাম ঠিক করে দিয়েছিলেন কল্পিতা দেবী। তবে, তিনি কল্পিতাও নন, দেবীও নন। তিনি স্বগুণে ভাস্বর প্রতিমা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: শান্তিনিকেতন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে-স্বপ্ন দেখেছিলেন তাতে কেবলই অনন্ত সূর্যোদয় ছিল না
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রতিমার লেখালিখিও সংকলিত হয়েছে এখানে। মুখোশ নৃত্য নিয়ে তাঁর ভাবনায় বোঝা যায়, নাচের শৈলী নিয়ে কতটা গভীর ছিল তাঁর চিন্তা। আর একটি জরুরি সংশোধনও আছে এই সংখ্যায়। ‘মন্দিরার উক্তি’ নামে গদ্যটিও এখানে তুলে ধরা হয়েছে। পাদটীকায় জানানো হয়েছে, সম্প্রতি ‘বিচিত্রপত্র গ্রন্থন বিভাগ’ থেকে প্রকাশিত প্রতিমা দেবীকে নিয়ে বইতে লেখাটিকে প্রতিমা দেবীরই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আদতে লেখাটি রবীন্দ্রনাথের। স্বয়ং প্রতিমাই সে কথা জানিয়েছেন। প্রাসঙ্গিক তথ্য হিসাবে প্রতিমার লেখা তাঁর বইয়ের ভূমিকাটিও এখানে সংকলিত হয়েছে। আশা করা যায়, এই তথ্য ভ্রান্তি দূর করতে সহায়ক হবে।
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..
পত্রিকার এই সংখ্যায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ আরও কয়েকটি লেখা আছে। সেগুলো পৃথক আলোচনার দাবি রাখে, এমনকী আলাদা সংখ্যাও হতে পারে তার কোনওটিকে নিয়ে। বিশেষত, সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের আলপনার যাত্রাপথ যেন আরও দীর্ঘ যাত্রার প্রাক্কথনটি সেরেই রাখল। কবিতার আলোচনা, গল্প, ভ্রমণ মিলিয়ে মিশিয়েই সেজে উঠেছে পত্রিকা। তবে যেহেতু পত্রিকার অভিমুখ প্রতিমা দেবীকে আবিষ্কার কিংবা পুনরাবিষ্কারে, তাই এই আলোচনাও মূলত সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকল। প্রতিমা-চর্চার ক্ষেত্রে এই সংখ্যা অনেকের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। সব থেকে বড় কথা, প্রতিমাকে নিয়ে চর্চা করাটাই জরুরি। সেই কাজটির জন্য দুই সম্পাদককেই ধন্যবাদ।
স্বর ও বর্ণ
ক্রোড়পত্র: প্রতিমা দেবী
সম্পাদক: অনির্বাণ মৈত্র, অমিত মণ্ডল
৩০০ টাকা