দুটো হাত নেই, অথচ অমরিশকে ঠেঙিয়ে শেষ করে দেবে, এমনটা বেশ অস্বাভাবিক। অমিতাভই হও বা জিতেন্দর, অমরিশের সঙ্গে লড়তে হলে পুরোদস্তুর অবতারের মতো নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে– শঙ্খচক্র না থাক, আট-দশ তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে নিজেদের অবিনশ্বর গুণাবলির প্রমাণ দর্শকদের হিসেব মিলিয়ে বুঝিয়ে না দিলে লড়াই জমবে না, বক্স অফিস হিট করানো বহুত দূর কি বাত।
দুন এক্সপ্রেসে ভোর হতেই দেখি চারপাশটা রাতারাতি কেমন বদলে গেছে– অবলোকনের তরিকাটি আলী সাহেবের ‘দেশে বিদেশে’ থেকে বেশরম রপ্ত করেছি, দ্রষ্টব্য বস্তু-অবস্তু বক্তব্যের লেজুড় হিসেবে জুতনোর বেবাক গোস্তাখি অধমের। আটপৌরে বিহার অথবা চাষি, চামার, কুলিন, কাহার, ধুলো, মসজিদ, কাবাব, কায়দার মুঘলসরাই, লখনউ, ইলাহাবাদের ভাষাজগৎ দশ-বিশগজি শেরওয়ানি, বিরিয়ানি, পাগড়ি, সুরমার প্রাচুর্য্যে বেশুমার পাল্টে না গেলেও, সহযাত্রী ছোকরা দেখলাম প্রভাতি সূর্যের নির্মল আলোক ইত্যাদি ইগনোরপূর্বক হুইলারের ঠেলা থেকে খানকয়েক ইবনে সফি কিনে আনলে। হুগলির নাদুস-নুদুস গোলগাল বেঁটেখাটো এদেশিদের মতো শশা খিরার বদলে ট্যারাবাঁকা লম্বাটে রিজড্ রামপুরি কাঁকড়ি উঠতে লাগল ভেজা শালু জড়ানো– যেন বা ও মাল সর্বসমক্ষে দেখাতে নেই। বেতের ঝুড়ির ঢকনা সরাতে রুটি-আলুভাজার বদলে বেরল পরাঠা, আচার– সঙ্গে নানাবিধ মশলাদার খুশ্ক মাংস, কাবাব– খোবানি, মিঠা ইত্তরে চোবানো পোলাও।
আটের দশকের শেষদিক। সকাল থেকেই হাজার টাকা ভরি জর্দার প্রাণকাড়া খোসবাইয়ে কামরা আমোদিত। সামনের সিটে ভদ্রলোক ভেস্টিবিউলের সামনে থেকে তামাক টেনে চোখ রাঙিয়ে ফিরলেন– ঠোঁটের হাসিতেই মালুম হচ্ছিল এ খোদ দিলজানের অধরসুধা পানের আফটার এফেক্ট! অতএব কোন দোকানের তামাক, দোকানদারের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক ক’জম্মের, লাইসেন্স আছে না নেই– ইত্যাদি ফালতু প্রশ্নের ধারও মারালাম না।
একই সঙ্গে এটাও বুঝলাম, এরপর বাঙালির পরিচিত ছবিতসবির সাজিয়ে রেলযাত্রার বর্ণনার উপায়টি ক্রমশ সীমিত হয়ে কয়লার ধোঁয়ার লগে মিলিয়ে যাবে। রাতের মেল ট্রেনে সুচিত্রা সেন ফট করে উত্তমের কাঁধে মাথা দিয়ে ফেলবে, বা দূরপাল্লায় সুপ্রিয়া তুলসী চক্রবর্তীকে লুচি-তরকারি, মণ্ডা-মেঠাই বেড়ে খাওয়াবে, তেমন দৃশ্যের সম্ভবনা বেনারসের অনেক আগেই মিটেছে। এ জগতে ভিলেনের নাম ডং, জাদুকরের নাম গোগা, রেপিস্ট সাধুরা শাকাল, অসাধু পণ্ডিত পুরোহিতরা পোঙ্গা, এবং ঝিকিমিকি এলইডি ফিট করা গুহায় সাড়ে তিনশোর কাছাকাছি একই রকম হলদে কাঁচুলি ম্যাজেন্টা মিনি স্কার্ট পরা অর্ধোলঙ্গ নর্তকিদের মাঝে বসবাসকারী হাপ-নটরাজ হাপ-দুর্গা টাইপের জাগ্রত ঈশ্বরটির নাম মহাকাল। পুরোহিতরা টাক পেইন্ট করে জানতেন?
এই জগতে অমরিশ পুরি ছাড়া অন্য কোনও ভিলেনের পক্ষে মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি অসম্ভব। প্রেম চোপড়াকে দেখে গা ঘিন ঘিন করেছে, মদন পুরিকে অভিশাপ দিয়েছি ‘তুই ট্রাকের তলায় পিষে মর’, ড্যানিকে বলেছি ‘তোর পাহাড়ি গ্রামের ভাইদের দেখ, গরিব অথচ কেমন কম দামে মাঙ্কিক্যাপ বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে’, কুলভূষণ খরবান্দাকে এখনও অনেকেই ‘আরে, ওই টেকোটা, কী যেন নাম– মন্থন, না, না, শানের ভিলেনটা’ ইত্যাদি নামেই গোলায়। প্রাণকে তো কেউ ভিলেন বলে স্বীকারই করে না– ‘অমন সুন্দর দিলদার মানুষ আর হয় না।’ এদিকে গব্বরের গোটা ইমেজটাকে শোলের শেষে ঠাকুর একদম মিট্টি মে মিলায় দিয়া। গব্বর খারাপ লোক, তবে মানুষ। ওর সঙ্গে নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে একদল মানুষই লড়াই করেছে, জিতেছেও মানুষ। অমরিশ পুরি মানুষ নয়, ও রাবণ– ওর সঙ্গে একমাত্র ভগবান ছাড়া কারও লড়ার ক্ষমতা নেই। লড়াই শেষ হলে মানুষ অমিতাভ ঈশ্বরের অস্তিত্ব, সৎ-অসতের দ্বন্দ্ব স্বীকার করে নেয়, মন্দিরে মায়ের কোলে শুয়ে মরে, বলে, ‘আমি ফিরে এসেছি।’ আর্কেঞ্জেলকে খতম করতে অ্যান্টি হিরোকেও ভগবানের স্তরে তুলতে হল– পরে দুটোকেই মেরে কাহিনিতে সততা এবং স্থিতাবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ, দুটো হাত নেই, অথচ অমরিশকে ঠেঙিয়ে শেষ করে দেবে, এমনটা বেশ অস্বাভাবিক। অমিতাভই হও বা জিতেন্দর, অমরিশের সঙ্গে লড়তে হলে পুরোদস্তুর অবতারের মতো নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে– শঙ্খচক্র না থাক, আট-দশ তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে নিজেদের অবিনশ্বর গুণাবলির প্রমাণ দর্শকদের হিসেব মিলিয়ে বুঝিয়ে না দিলে লড়াই জমবে না, বক্স অফিস হিট করানো বহুত দূর কি বাত! তাই, প্রতিটি সিনেমায় আলাদা আলাদা খলনায়কের চরিত্রকে নিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি অমরিশ দর্শকের আদতে রোজকার ভয়গুলিকেই রংচং মাখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যেগুলো থেকে বাঁচতে তারা ঈশ্বরের স্মরণাপন্ন হয়ে থাকে। রাগী, জাতপাতে বিশ্বাসী, দহেজ ছাড়া একচুল জমি ছাড়তে নারাজ বাপ হিসেবে সে যখন সন্তানকে বলে অমুককে বিয়ে করার প্রশ্নই নেই, তখন তার মগজে ‘গরিব বামুনের পোশাকে বিধর্মী মহিলার সামনে হাত পেতে দাঁড়ানোর’ বিকল্প ব্যবস্থা স্থান পায় না, ওটা কখনওই তার বা দর্শকের সংস্কৃতির অংশ ছিল না, এখনও নয়– চিত্র নির্মাতাদের মগজেও না, কারণ সেইটি গোবলয়ে প্রতিষ্ঠিত পিতৃতান্ত্রিকতার ধাঁচাটিকেই সম্মুখ সমরে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানায়, এবং অমরিশের অভিনয় নৈপুণ্যকে খাটো না করেই বলতে পারি, সে যুদ্ধে তার পরাজয় আটকানোর ক্ষমতা কারও ছিল না। অতএব সেরকমটা হলে অমরিশকে ঘিরে তৈরি ক্রূরতার এবং তজ্জনিত কারণে সৃষ্ট আতঙ্কের অট্টালিকাটি ভেঙে পড়ত। ছবি বিশ্বাসের প্রতি দর্শকের ঘৃণার পাশাপাশি তেমনি আতঙ্ক দানা বাঁধে না। কমল মিত্র বাঙালিকে ফ্রাস্ট্রেশনে ভোগায়– ‘আহারে, অমন হীরের টুগরো ছেলেকে বের করে দিলি? কী হত ঘরের খেয়ে চাড্ডি গান গাইতে দিলে? একেবারে চামার!’ না, কমলবাবু যতই পাইপ চিবোন, খুন করতে পারেন, তাকে দেখে তেমনটা বাঙালি দশকের কখনওই মনে হয়নি। লন্ডনের মুদিখানার মালিকটি নিজের গ্রামে, অর্থাৎ পিতৃতান্ত্রিকতার শিকড়ে পৌঁছে, সজ্ঞানে ঐতিহ্যের স্মৃতি বহনপূর্বক গোটা পরিবারের মুখিয়া হিসেবে যখন দিলওয়ালে এবং দুলহনিয়াদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের রাশ তুলে নেয়, তখন সব সময়ই মনে হয়েছে এ শাহরুখকে তো বটেই, সিমরনকেও যে কোনও সময় আত্মমর্যাদা বা পারিবারিক সম্মানরক্ষার দোহাই দিয়ে বা না দিয়েই খুন করতে পারে– দর্শকের একাংশ কেঁদে ভাসালেও তারা যে তেমনটাই চেয়েছিল, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এই ভয়টা উত্তর ভারতের জাতিভিত্তিক বিভাজনের রাজনীতি মেনে নেওয়া, পুরুষের কথার ওপর টুঁ শব্দ করতে না পারার প্রাত্যহিকতা, পরিবারের বেছে দেওয়া বিয়ের পাত্রপাত্রীকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করা, না করলে গর্দান যাওয়ার স্বাভাবিকতা থেকে তৈরি হয়েছে। আর প্রতিবারই, অর্থাৎ পাঁচশোর ওপর ছবিতে নতুন রকমের অসাধুতা, ক্রূরতার, জান্তব হিংস্রতার সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্ম একটি মুখ হিসেবে দর্শক অমরিশকে চেয়েছে, পাকাপাকি স্থান দিয়েছে দুঃস্বপ্নের ইজারাদার হিসেবে। রামনবমীর মেলায় রাবণের মুখ তৈরি হতে দেখেছি মোগাম্বোর আদলে। তবে যে ছবি থেকে এই লেখার আইডিয়া মাথায় খেলেছিল, সেটি দেরাদুনে ঘণ্টাঘরের কাছে একটি দেওয়ালে সাবানের বিজ্ঞাপনে অপটু হাতে আঁকা অমরিশের মুখ– পাশে লেখা ‘দরিন্দোঁ কি দিল ভি সাফ কর দে।’ অমরিশ জেনেটিক আইডেন্টিটি। বিরিয়ানি, গঙ্গা, অথবা ঈশ্বরের মতোই। রাবণ বলেছি এমনি এমনি নয়।