বিশ শতকে স্বাধীনতা আন্দোলন যখন তীব্র হয়ে উঠছে, সাহিত্যের ভাব ও ভঙ্গি ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। ‘ভারতীয়দের লেখা ইংরেজি সাহিত্য’ হয়ে উঠছে ‘ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্য’। ইংরেজ ভারত ছাড়ার পর ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের পিছুটান আর থাকে না। নতুন একটা ধারা হয়। তার নতুনতর এক রূপ প্রকাশ পেল সাতের দশকের শুরুতে জয়ন্ত মহাপাত্রের কলমে। তিনি ওড়িশার অতীত ও বর্তমান, মন্দির ও মাটি, মিথ ও ইতিহাস তাঁর কবিতার মুখ্য বিষয় করে তুললেন।
জয়ন্ত মহাপাত্র (১৯২৮-২০২৩) চলে গেলেন। কী বলে তাঁকে উল্লেখ করব? ভারতীয় ইংরেজি ভাষার কবি? না, এই পরিচিতি তাঁর একেবারেই পছন্দ ছিল না। নিজেকে ‘ওড়িয়া কবি’ বলে মনে করতেন আর বলতেন তাঁর লেখার মাধ্যম হল ইংরেজি। অন্যেরা তাঁকে যে পরিচয় দেন আর তিনি নিজেকে যা ভাবেন, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক।
সংস্কৃত, বাংলা, তামিল, মরাঠি, হিন্দি ইত্যাদি ভাষার সাহিত্যের ইতিহাসের সঙ্গে ভারতীয়দের লেখা ইংরেজি সাহিত্যের যোগ নেই। লক্ষ্যও ছিল আলাদা। যেখানে প্রায় হাজার খানেক বছর আগে সাধক-কবিরা বাংলা ভাষায় চর্যাগীতি রচনা করছেন, সেখানে ২০৭ বছর আগে রামমোহন রায়ের হাতে ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের জন্ম হচ্ছে। ১৮১৭ সালে কলকাতায় বসে রামমোহন লিখছেন ‘আ ডিফেন্স অফ হিন্দু থিয়িজিম’ নামে একটি দীর্ঘ লেখা। বোঝা যাচ্ছে, দেশীয় ও ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। তারপর হেনরি ডিরোজিও, তরু দত্ত, অরু দত্ত, মনোমোহন ঘোষ থেকে উনিশ শতকের অনেক লেখকই ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রভাবে পড়েছেন। বিশ শতকে স্বাধীনতা আন্দোলন যখন তীব্র হয়ে উঠছে, সাহিত্যের ভাব ও ভঙ্গি ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। ‘ভারতীয়দের লেখা ইংরেজি সাহিত্য’ হয়ে উঠছে ‘ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্য’। ইংরেজ ভারত ছাড়ার পর ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের পিছুটান আর থাকে না। নতুন একটা ধারা হয়। তার নতুনতর এক রূপ প্রকাশ পেল সাতের দশকের শুরুতে জয়ন্ত মহাপাত্রের কলমে। তিনি ওড়িশার অতীত ও বর্তমান, মন্দির ও মাটি, মিথ ও ইতিহাস তাঁর কবিতার মুখ্য বিষয় করে তুললেন। জয়ন্ত মহাপাত্রের জয়যাত্রা শুরু হল। ৪৩ বছর বয়সে প্রকাশিত হল তাঁর দু’টি কবিতার বই– ‘ক্লোজ দ্য স্কাই: টেন বাই টেন’ এবং ‘স্বয়ম্বর অ্যান্ড আদার পোয়েমস্’। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। বিগত পাঁচ দশকে ইংরেজিতে লেখা ভারতীয় কবিতায় তাঁরই স্বর সবচেয়ে ঘন, পরিশীলিত এবং গভীর।
জয়ন্ত মহাপাত্রের কবিতায় ঠিক কী আছে? কোন বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ? এর উত্তরে বলা যায় তাঁর কবিতায় তিনি আছেন। ব্যক্তিস্মৃতি তাঁর কবিতায় ছড়িয়ে আছে। কিন্তু সে স্মৃতি একেবারেই মেদুর নয়। মেদুরতার মধ্যে স্নিগ্ধতা থাকে। স্মৃতির সে আরাম তাঁর মেলেনি। তাঁর স্মৃতির অনেকটাই জুড়ে বেদনা। ‘ওয়েটিং’ নামের কবিতা সংকলনের ‘ওয়ে অফ দ্য রিভার’ কবিতার শেষ স্তবকে লেখেন–
সরলতা ও অভিজ্ঞতার মাঝে
যখন অতীতের কথা ভাবি, মাথায় ভিতর একটা যন্ত্রণা ঝলসে ওঠে
যেন নদীর উপর ভেসে চলা কোনো অদেখা মাঝির গান,
যেন আলোর কমা-বাড়ার সঙ্গে এক দিক থেকে অন্য দিকে
টেনেহিঁচড়ে চলা এক ক্লান্ত ছায়া ।
আমি আমার বাবার চোখের জল।
আমি ধীর ধারায় আস্তে আস্তে নীচের দিকে এগিয়ে চলেছি।
নদীর অতল অন্ধকার কি আমাকে এর মধ্যেই শিখিয়ে দিয়েছে
নিজেকে গোপন করার বিদ্যা, তার অজ্ঞাত প্রয়োজনীয়তা?
বেদনা তাঁকে ছুঁয়ে থাকে। কোথাও দুঃখ বাসা বেঁধে থাকে বুকের ভিতর। আলোর পিছনে পিছনে ছায়া চলে আসে। পরস্পরে কাটাকুটি করে। এর ভিতর থেকে গভীর অনুভূতি ও চেতনা জন্ম নেয়। কখনও কোনও বাক্যে, কখনও বাকপ্রতিমায়, তার ছায়ারূপ ফুটে ওঠে। ১৯৮০ সালে ‘রিলেশনশিপ’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল। সে বইয়ের এক জায়গায় লিখছেন–
আজ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম
আমার মায়ের কবরের দিকে
চোখে পড়ল ছেলেবেলার পুরোনো আবেগ
সারি সারি সাদা সিঁড়ির উপর
খড়ি দিয়ে লাল-হলুদ দাগে কাটা আছে।
ব্যক্তিজীবনের স্মৃতির মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার বোধ কাজ করে, বিচ্ছিন্নতার বিষাদ ফুটে ওঠে। ব্যক্তি ও পরিবার থেকে তা কখনও পৌঁছে যায় জাতিগত স্মৃতিতে, কখনও পুরাকথার কৌম বিষাদে। কোনারক মন্দিরের সঙ্গে একটা পুরনো কাহিনি যুক্ত হয়ে আছে। কোনারকের সূর্য মন্দির তৈরির জন্যে রাজা ১২০০ দক্ষ কর্মী নিযুক্ত করেন কিন্তু বারো বছর পরেও দেখা হয় মন্দিরের মাথার কলস কেউ বসাতে পারেনি। তখন রাজা বলেন যে, পরের দিন সকালের মধ্যে কাজ শেষ না হলে ১২০০ রাজমিস্ত্রিকে মৃত্যুদণ্ড দেবেন। সেদিন রাতে ওই নির্মাণ কাজের প্রধান স্থপতি বিষ্ণু মহারানার ছেলে ধর্মপদ মন্দিরে আসে এবং কলসটি মন্দিরের মাথায় স্থাপন করে। শোনা যায়, তারপরেই সে মন্দিরের মাথা থেকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে, কারণ তার কথা জানলে ১২০০ কর্মীর প্রাণ যাবে। এই কাহিনিটিকে কেন্দ্র করে লেখা ‘কোণার্ক’ কবিতায় জয়ন্ত মহাপাত্র লিখছেন–
যখন
পাথরের ভিতরে থাকা ছায়া
আলোকে ছিটকে দিচ্ছে
তার শিকড় থেকে,
আমার ভিতরে
আমি সেই বালকটিকে দেখতে পাই,
পাথরের আড়ালে,
উদ্ঘাটন শেষ হয়,
তার ক্ষীণ কালো কান্না
আমার জীবনের দিকে আঙুল তোলে।
জয়ন্ত মহাপাত্র এমনই এক কবি, যাঁর কবিতায় মিথ ও ইতিহাস মিশে যায়, দূর অতীতের এক কিশোরের কান্না বর্তমানের এক কবির মনে বিষাদ বিছিয়ে দেয়। মনে হয় ওই কিশোরের মৃত্যুর বিপরীতে নিজের বাঁচাটা যেন এক বিড়ম্বনা। সূর্য মন্দিরের আকাশচুম্বী উচ্চতা, রথের চাকার বিপুল আকার, স্থাপত্যের অসামান্য নান্দনিকতা, মন্দিরের গায়ে যৌনতার প্রবল প্রকাশ ইত্যাদি গৌরবকে গৌণ করে দিয়ে একটি ছোট বালককে তাঁর কবিতায় সামনে এনে হাজির করেন জয়ন্ত।
একই রকম ভাবে ‘দ্য ফেথ’ (বিশ্বাস) নামের একটি কবিতায় পুরীর মন্দিরের বাইরের ও ভিতরের একটি ছবি তুলে ধরেন। সেখানে দেবতা নিয়ে কোনও কথাই নেই। যা আছে তা হল দিনের শুরুতে, হাসপাতালের বিবর্ণ হলুদ চাদরের মতো আলোয়, এক খোঁড়া ভিখিরির নড়বড়ে ভঙ্গিতে মন্দিরের পথে চলা। তার হাতের তালুতে কোনও ফুল-বেলপাতা নেই। যা রয়েছে, তা হল গুড়ি মেরে ঢুকে পড়া ভোরের আলো। দ্বিতীয় স্তবকে আছে এক পণ্ডার কথা, যে তার কড়া ধাতের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যের ওপর রঙ্গেই আছে। শেষ অনুচ্ছেদে রয়েছে সিঁড়ি দিয়ে নেমে কবির গর্ভগৃহে ঢোকার কথা। সেখানে মশার আওয়াজের মতো মন্ত্রধ্বনি শুনে তাঁর রক্তে ঘুমঘুম ভাব আসে। তাঁর হাতের সাদা খুচরো ফুলটি একই সঙ্গে পাপের নিরাময় ও দেবতা দেখার দর্শনি। জয়ন্ত মহাপাত্রের আর একটি অসামান্য কবিতা আছে বালেশ্বরের পরিত্যক্ত ব্রিটিশ ব্রিটিশ কবরখানা নিয়ে। সেখানের দু’টি স্মৃতিফলকে লেখা আছে দু’টি কিশোরীর কলেরায় মৃত্যুর সংবাদ। জনৈক ক্যাপটেনের স্ত্রী ফ্লোরেন্স মারা গেছে উনিশ বছর বয়সে আর এক দম্পতির মেয়ে হেলেন মারা গেছে সতেরো বছর বয়সে। কবরে শুয়ে থাকা তাদেরই এক প্রতিবেশী বলছে–
রাজশক্তির মহিমা বিলুপ্ত হওয়াতে আমার কী এসে যায়?
অথবা আমাদের পূর্ব পুরুষদের ক্লান্তিকর বিজয় অভিযানে?
কেবলমাত্র ওই অকালে চলে যাওয়া কিশোরীরা দেখাতে পারে
হৃদয় কী লুকিয়ে রাখবে, ঘাস এর বেশি কিছু জানে না।
জয়ন্ত মহাপাত্রের কবিতায় বিষাদের মধ্যে কোথায় আশার ছোঁয়া আছে, সে সন্ধান নিতান্তই বাহ্যিক। বরং মৃত্যুর মধ্যে কোথায় তিনি জীবন খুঁজে পান আর কোথায় জীবনের মধ্যে মৃত্যু দেখেন, সেটাই তাঁর কবিতার উপর ঝুঁকে পড়ে খোঁজা দরকার।
কলকাতার সঙ্গে জয়ন্ত মহাপাত্রের নিবিড় যোগ ছিল। কলকাতার উপর কবিতা লিখেছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। কলকাতায় ‘কবিসন্ধি’ অনুষ্ঠানে এসে একটা সন্ধেজুড়ে নিজের লেখালিখির কথা শুনিয়েছেন। পড়েছেন বেশ কিছু কবিতা। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন কবি পুরুষোত্তম লালের কথা, যিনি রাইটার্স ওয়ার্কশপ থেকে তাঁর দু’টি বই প্রকাশ করেছিলেন। বছর কুড়ি আগে সাহিত্য অকাদেমির উদ্যোগে ভারতীয় ইংরেজি ভাষার কবিদের নিয়ে একটা বড় সম্মেলন হয়েছিল গুয়াহাটিতে। উদ্বোধন করেছিলেন জয়ন্ত মহাপাত্র আর সভাপতিত্ব করেছিলেন সাতের দশকের আর এক ইংরেজি ভাষার কবি কেকি এন. দারুওয়ালা। দু’জনে কবিতাও পড়েছিলেন। যতদূর মনে পড়ে তেমসুলা আও, এন. রবিন সিং, সংযুক্তা দাশগুপ্ত প্রমুখ কবিরাও অংশ নিয়েছিলেন সে অনুষ্ঠানে।
জয়ন্ত মহাপাত্রের ডালপালা ছড়িয়েছিল প্রায় বিশ্বজুড়ে। নানা দেশ তাঁকে নানা সম্মানে ভূষিত করেছে। কিন্তু তাঁর শেকড় ছিল এদেশে, বিশেষ করে ওড়িশার মাটিতে।