ক্রমাগত কোমর দুলিয়ে ছুটছে আমাদের লোকাল, লোকাল ট্রেন। ছাপোষা ডেলি প্যাসেঞ্জার ক’জন যাত্রী। তন্বী বৃষ্টি বারবার ছুটে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ভিতরের মানুষগুলোকে, কিংবা মানুষগুলোর ভিতরকে! যেমন বৃষ্টিতে কান্নাও ধুয়ে যায়। তাই জানলার শাটার নামানো, দরজার অর্ধেকের বেশি টানা। আবছা অন্ধকারে কোথায় চলেছে এই ট্রেন? এসেছিল কোথা থেকে? কেউ জানে না! তবে কি এই এক কামরাই আস্ত পৃথিবী! অনন্তশূন্যে ভাসমান মহাকাশযান! জগতে কেহ যেন নাহি আর! একেই বলে ম্যাজিক।
একেই বলে ম্যাজিক! যেই ‘বাদল-মেঘে মাদল বাজে গুরুগুরু গগন-মাঝে’ টাইপ অবস্থা আকাশের, সেই মুখর বৃষ্টিদিনে খোদ বনগাঁ লোকালের চরিত্র নিয়ে টানাটানি পড়ে গেল মাইরি! ব্যাপারটা কী?
এমনিতে লোকাল সিলেবাসে ক’দিন বাদে প্রশ্ন আসবে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভিড় ট্রেনের নাম কী? বাঙালির সন্তান গর্বের সঙ্গে বলবে, ‘বনগাঁ লোকাল স্যর’। যে ট্রেনে ওঠা আপনার হাতে, নামা পাবলিকের ইচ্ছায়। দুই অন্তিম স্টেশনের বদলে গন্তব্য যদি মধ্যবর্তী হয়, তবে আপনার কপাল পুড়বেই। জান হাতে করে বারো বগির এই যানে উঠতে হয়। মাঝে মাঝে নিজের কনুই, হাঁটু হারিয়ে ফেলেন যাত্রী! হয়তো ভিড়ের চাপে অন্যের কনুই বা হাঁটু নিয়েই নেমে পড়লেন প্ল্যাটফর্মে! আমরা যারা বড়লোক দেবতার অভিশাপে শহরতলির নিম্নবিত্ত, কম ও বেশি গরিব জনগণ, তাঁরা তো দেখেছি, সকাল-সন্ধের অফিস টাইমে সারিবদ্ধ দরজায় ঝুলন্ত ঝগড়া, খিস্তি, প্রায় মারামারি নিয়ে ছুটছে লোকাল ট্রেন। তবে কি না ডেলি প্যাসেঞ্জারদের দাবি, শুধু বনগাঁ বলে নয়, অফিস টাইমের যে কোনও লোকাল ট্রেন হল পারফিউমের পরীক্ষাশালা। ট্রেনে ওঠার আগে ঘাড়ে-জামায়-হাতে-বগলে সুগন্ধী ফুস ফুস মেরে তো উঠলেন, নামার পরে যদি তার পয়েন্ট এক শতাংশও অবশিষ্ট থাকে, তবে আপনি জিতে গিয়েছেন। কিন্তু ডেলি প্যাসেঞ্জার মাত্র জানেন, গোটা শরীরে এক বাগান রজনীগন্ধা ঘষে এলেও কাজ হবে না, নামার সময় গা থেকে ঝাঁঝাল নর্দমার গন্ধই বেরুবে। এবং মেনে নিতে হবে মুখ বুজে। নচেৎ আওয়াজ খাবেন, দাদার গ্যারাজে চারচাকা ডিম পাড়ছে। নেহাত সখে লোকালে চেপেছেন! খিক-খিক-খিক। সেই ট্রেন কিনা বদলে গিয়েছে ‘বৃষ্টি এক্সপ্রেসে’! হাসি মুখে তুলনায় হালকা ভিড় নিয়ে ছুটছে লোকাল। দুলছে যাত্রীদের হাতে ঝোলানো ছাতা, হৃদয়ে ঝোলানো মন! কেন জানেন?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আমরা যারা বড়লোক দেবতার অভিশাপে শহরতলির নিম্নবিত্ত, কম ও বেশি গরিব জনগণ, তাঁরা তো দেখেছি, সকাল-সন্ধের অফিস টাইমে সারিবদ্ধ দরজায় ঝুলন্ত ঝগড়া, খিস্তি, প্রায় মারামারি নিয়ে ছুটছে লোকাল ট্রেন। তবে কি না ডেলি প্যাসেঞ্জারদের দাবি, শুধু বনগাঁ বলে নয়, অফিস টাইমের যে কোনও লোকাল ট্রেন হল পারফিউমের পরীক্ষাশালা। ট্রেনে ওঠার আগে ঘাড়ে-জামায়-হাতে-বগলে সুগন্ধী ফুস ফুস মেরে তো উঠলেন, নামার পরে যদি তার পয়েন্ট এক শতাংশও অবশিষ্ট থাকে, তবে আপনি জিতে গিয়েছেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কারণ আবার এসেছে আষাঢ়, অনন্ত নীল আকাশে কালো মেঘের চিঠি উড়ছে। সেই মেঘলা খাম খুললেই ভিজে যাচ্ছে শহরের পথঘাট, গ্রাম বাংলার ধানখেতে বৃষ্টির কবিতা ঝরে পড়ছে! আদতে বাংলা ও বাঙালির চিরপ্রেমিক বৃষ্টির ফলেই বদলে গিয়েছে দৃষ্টি, আমাদের দেখার চোখ। অতএব, বনগাঁ বা বর্ধমান, খড়গপুর বা লক্ষ্মীকান্তপুর, কল্যাণী সীমান্ত কিংবা ডানকুনি, আজ ম্যাজিক করে বদলে গিয়েছে সমস্ত লোকালের যাত্রা। এমন দিনে যে ট্রেন এসে দাঁড়াল আধভেজা শহরতলির লাজুক স্টেশনে, তার যেন কোনও গন্তব্যই নেই, কোথা থেকে এসেছে? সে উত্তরও বুঝি হারিয়ে গিয়েছে ঝরঝর, ঝিরঝির আনন্দ জলকল্লোলে! সবচেয়ে বড় কথা বদলে গিয়েছে যাত্রীদের মন। মায়াবী বর্ষার সঙ্গদোষে ভোজবাজির মতো পাল্টে গিয়েছে মানুষগুলো, ট্রেনের কম-মাঝারি-বেশি বয়সি যাত্রীর দল।
গতকাল যে নীল আর হলুদ ওড়নার ঝগড়ায়, চুলোচুলিতে মাথায় উঠেছিল লেডিজ কম্পার্টমেন্ট, সেই তারাই আজ জল দাঁড়ানো স্টেশন থেকে ‘ছপাক ছই’ কায়দায় এক সিনেমার জোড়া নায়িকার মতো গলাগলি করে উঠে পড়ল ট্রেনে। আচমকা বৃষ্টির দুষ্টমিতে ভিজে গেছে কুর্তি, জিন্স! তো কেয়া? তাছাড়া এমন দিনে পাশের যাত্রীকে বলাই যায়, ‘দাদা, একটু সরে বসবেন!’ শীত শীত দিনে বৃষ্টি এক্সপ্রেসের সহযাত্রী হাসি মুখে জায়গা দেন। না থাকলে আবিষ্কারের চেষ্টা পর্যন্ত করেন। গোটা পৃথিবী একটা পরিবার, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’… হঠাৎ মনে পড়ে জনতার! হয়তো এইমাত্র ট্রেনে ওঠা এক যুবক ছাতা বন্ধ করতে গিয়ে পাশের মাঝবয়সি ভদ্রলোককে দিলেন ভিজিয়ে, প্রাথমিক বিরক্তির পরে আজ কিন্তু রাগ নিভে যাবে।
এমনিতে রাগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আখের গোছাই রাজনীতির মধ্যে বসবাসের রাগ, সরকারি কাজে অলিখিত দেওয়া-নেওয়ার প্রথায় রাগ, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিতে রাগ, বেতন না বাড়ায় রাগ, ছেলে কিংবা মেয়ের চাকরি হচ্ছে না বলে রাগ, টানাটানির সংসারে সঞ্চয় না করতে পারার রাগ, বাপ-ঠাকুর্দার সম্পত্তি নেই বলে রাগ, পেটরোগা হয়ে জন্মানোর রাগ, স্ত্রী ক্যাটরিনা, দীপিকা,অনুষ্কা… কমপক্ষে বাংলা সিরিয়ালের পাতি নায়িকার মতোও সেক্সি নয় বলে রাগ, অপরপক্ষে স্বামী শাহরুখের মতো প্রেমিক, সলমানের মতো দুষ্টু, ঋত্বিকের মতো মাচো হ্যান্ডু নয় বলে ঝাড় জ্বলে যাওয়া রাগ। এবং ভরা বর্ষাকালে বৃষ্টি না হওয়ার রাগ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন কিশোর ঘোষ-এর লেখা: লেখক, প্রকাশকের জন্য ‘আত্ম-উন্নয়নমূলক’ কাজ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই সমস্ত রাগ ভেজাবে বলে আজ আকাশ কালো করে নেমেছে বৃষ্টিদেবতা, শেষতক আল্লা শুনেছেন ‘ম্যাঘ দে, পানী দে’র আকুল প্রার্থনা। নিত্যযাত্রীদের একটা অংশ ‘রেইনি ডে’র ঘোষণা দিয়েছেন বলে লোকাল ট্রেন ভিড়হীন মিষ্টি জীবন-ভেজা বৃষ্টি এক্সপ্রেস আজ। তার উপর ধরুন গে ছাতা, এক আস্ত মশকরা। যেদিন মনে করে বগলদাবা, সেদিনই মাইরি বৃষ্টি হবে না, আর না আনলে নামবে এক্কেবারে ঝাঁপিয়ে। প্রশ্ন ওঠে, বৃষ্টি কি ছাতার সতীন? তারপর ধরুন দত্তবাবুর কথা। পুলিশে কাজ করেন। বাঙালির মধ্যে অমন পাঞ্জাবি চেহারা সচরাচর দেখা যায় না। ছয় তিন। ডাকাতিয়া গোঁফ আর পেল্লায় ভুঁড়ি। পাড়ার লোকে সাহসী বলেই চেনে। তবে কিনা বউ অন্য জিনিস। ফলে সাতাশবার ছাতা হারিয়ে এক সাতশোবার মুখ ঝামটা খেয়ে রাগের মাথায় স্ত্রীর বদলে ছাতাকেই জীবন থেকে ডিভোর্স দিয়েছেন। ছুটে ট্রেন উঠে হাঁফাচ্ছেন। বাজখাই শ্বাসটানে ভেজা ভুড়ি উঠছে-নামছে। শুধু কি দত্ত একা? এমন বৃষ্টিদিনে রুমালই গামছা, কারও কারও ক্ষেত্রে পলিথিনই ছাতা। জলকাদায় জুতোর বারোটা বেজে গেছে। সাবধানী প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটুতে তুলেছে লজ্জা। ট্রেনে লোক কম, বিক্রি বাটাও, তাই বাণিজ্যে ইতি টেনে সিটে পা তুলে বসেছেন বাদাম-হকার। জানলার বাইরে উদাস চোখে চেয়ে আছেন জন্মান্ধ ভিখিরি! মুষলধারা মাতাল বর্ষা ক্রমশ অলৌকিক করে তুলছে এই ট্রেনকে। এক্কেবারে অলৌকিক?
হ্যাঁ, সে এক পাগল বৃষ্টি। ‘মন মানে না বৃষ্টি হলো এত/ সমস্ত রাত ডুবো-নদীর পারে’। আসলে দিনকেই রাত মনে হচ্ছে তখন। তার মধ্যে শোঁ-শোঁ শব্দ, মেঘের নাদ, বজ্রপাত। এবং ক্রমাগত কোমর দুলিয়ে ছুটছে আমাদের লোকাল, লোকাল ট্রেন। ছাপোষা ডেলি প্যাসেঞ্জার ক’জন যাত্রী। তন্বী বৃষ্টি বারবার ছুটে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ভিতরের মানুষগুলোকে, কিংবা মানুষগুলোর ভিতরকে! যেমন বৃষ্টিতে কান্নাও ধুয়ে যায়। তাই জানলার শাটার নামানো, দরজার অর্ধেকের বেশি টানা। আবছা অন্ধকারে কোথায় চলেছে এই ট্রেন? এসেছিল কোথা থেকে? কেউ জানে না! তবে কি এই এক কামরাই আস্ত পৃথিবী! অনন্তশূন্যে ভাসমান মহাকাশযান! জগতে কেহ যেন নাহি আর! একেই বলে ম্যাজিক।
……………………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………………..