মানুষদের হয়ে রোবটদের বিরুদ্ধে এমন প্যাঁচালো সূত্র একমাত্র মানুষই আবিষ্কার করতে পারে, কারণ সে সবার আগে মানবিক, রোবোটিক নয়। যেমন করে মানুষ সৃষ্টি করার আনন্দে নিজেকে ঈশ্বরতুল্য মনে করে বসলেও সে যেমন ঈশ্বর হতে পারেনি এখনও। মানুষের নিজের তৈরি ঈশ্বর ধারণাকেও যদি আমরা ধরে নিই তাহলেও নয়। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ না পেলেও মানুষ তাঁকে পরম কল্যাণময়, দয়াময় পরম দাতা/দাত্রী বলে ধরে নেয়। কিন্তু নিজে সৃষ্টিকর্তার চেয়ারে যখন উপনীত হয়, তখন দেওয়ার থেকে পাওয়ার অভিপ্রায়টাই বড় হয়ে উঠে। তা না হলে হাজার হাজার বছরের সুজলা-সুফলা পৃথিবী উল্টে-পাল্টে ভোগ করে নিঃস্ব করে দেওয়ার পর অন্য গ্রহে চলে যাওয়ার উচ্চাশা তারা রাখত না।
দক্ষিণ কোরিয়ার গুমি সিটি হলে ২৬ জুন যে কাণ্ডটা ঘটে গেল, তা নিয়ে মানব সমাজ দ্বিধা-বিভক্ত। এর আগে আত্মহত্যার মতো বিষয়ে এতটা কনফিউজড্ অবস্থা শেষ কবে মানুষের হয়েছে বলা শক্ত। রোবটের সঙ্গে আত্মহত্যা ব্যাপারটা ঠিক খাপ খায় না। গত বছর আগস্ট মাসে সিটি হলে চাকরির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া থেকে একটি বিশেষ ধরনের অত্যাধুনিক রোবট আমদানি করা হয় দক্ষিণ কোরিয়ার গুমি শহরে। তার নাম রাখা হয় ‘রোবট সুপারভাইজার’, দেওয়া হয় আইডেন্টিটি কার্ড আর ন্যস্ত করা হয় তার ওপর একগাদা কাজ, যেগুলো পিওন, ক্লার্ক, গুপ্তচর, বা কুরিয়ার বয়-রা করে থাকেন।
সকাল ন’টা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি ছিল তার কাজের শিফট। ফাইলপত্তর তথ্যাদি নিয়ে সে ছুটে বেড়াত মানুষ কর্মচারীর ফরমাশে ফরমাশে। যদিও রোবটটি নিজেই প্রয়োজনমতো সিটি হলের লিফটে ওঠা-নামা করত, কিন্তু সেদিন অর্থাৎ ২৮ জুন, সে দোতলার সিঁড়ি থেকে পিছলে পড়ে মারা যায়! প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সেদিন রোবটটি হঠাৎ আনমনা হয়ে কাজ ফেলে সিঁড়ির সামনে গোল গোল পায়চারি করে কয়েকবার, তারপর সটান ঝাঁপ দেয়। সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে এক এক করে ভেঙে যায় তার অঙ্গ, তারপর একতলার ল্যান্ডিং-এ শেষ পোটেনশিয়াল এনার্জি ত্যাগ করে।
যেহেতু রোবটাধিকার সংগঠন সেভাবে এখনও দানা বাঁধেনি, তাই মানবাধিকারের নিক্তিতে ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা বলে মনে করা হচ্ছে, যার কারণ হতে পারে কাজের স্ট্রেস, ডিপ্রেশন ইত্যাদি ইত্যাদি। রোবটটি কেন হঠাৎ এরকম একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসল, এ ব্যাপারে এখনই কিছু জানা না গেলেও তার যন্ত্রপাতি, মেমোরি, হার্ড ডিস্ক, মাদার বোর্ডের ময়নাতদন্ত চলছে। অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত সঠিক বলা যাচ্ছে না সমস্যাটা কী। যদিও এর আগে ২০১৭ সালে ‘স্টিভ’ নামের একটি রোবট ওয়াশিংটনে ডি.সি অফিসের ফোয়ারার জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল বলে জানা গেলেও পরে গোটা ঘটনাকে ‘প্রোগ্রামিং এরর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মোদ্দা কথা, এই দুই রোবট তাদের যান্ত্রিক ভারসাম্য হারানোর ফলেই এরকম নাটকীয়ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, রোবটটি সত্যিই যদি আত্মহত্যা করে থাকে, তা সে কাজের চাপেই হোক বা দাসত্বের ভারে, তাহলেও কি এ নিয়ে মানব সমাজের এত ভাবার কারণ আছে?
প্রশ্নটা আসলে যতটা মানবিক, তার থেকে অনেক বেশি ঐতিহাসিক। কারণ, ইতিহাসই একমাত্র পারে খুঁজে দিতে সে আসল উদ্দেশ্য, যা রোবটকে এনেছিল সভ্যতায়। ১৯২০ সালে ‘রোবট’ শব্দবন্ধটি প্রথম আমদানি করেন চেক নাট্যকার ক্যারেল ক্যাপেক তাঁর নাটক ‘আর.ইউ.আর’-এ। রোবট শব্দটি এসেছে চেক শব্দ ‘রোবটনিক’ থেকে, যার অর্থ হল ‘বাধ্যতামূলক শ্রমজীবী’। যদিও ‘রোবটনিক’ শব্দটিও তৈরি হয়েছিল প্রাচীন স্লেভিক শব্দ ‘রেবু’ থেকে, যার অর্থ হল ‘দাস’। অর্থাৎ, রোবট ধারণার শুরুর লগ্ন থেকেই এ-বিষয়ে কোনও দ্বিমত ছিল না যে, আমরা যান্ত্রিক দাস সৃষ্টি করতে চলেছি। আর এর পিছনের কারণ যা ছিল, তা সেই যুগে যথেষ্টই প্রগতিশীল ও মানবিক। সে সময়টা ছিল ক্রীতদাসের সময়, তাই বিজ্ঞানমনস্করা স্বপ্ন দেখেছিলেন ক্রীতদাসপ্রথা থামাতে হলে আমাদের একটা বিকল্প দিতে হবে। সেই বিকল্পর পথ ধরেই তৈরি হয় যান্ত্রিক দাস যা মানুষের প্রভুত্ববাদকেও তুষ্ট করবে আর মানুষকে মুক্তও করবে প্রভুত্ববাদের অমানবিকতার অনুতাপ থেকে। রোবট তাই জন্মলগ্ন থেকে ভিক্টিম নয়, ভিক্টিমাইজেশনের ধারণা থেকেই তার জন্ম।
ক্যারেল খুব মজার ছলে বলেছেন ‘রোবট’ নামকরণের গল্পটাও। ‘আর.ইউ.আর’ নাটকটা লেখার সময় ক্যারেল এই কৃত্রিম দাসদের ঠিক কী বলে ডাকবেন বুঝতে পারছিলেন না। তাই অগত্যা তাঁর চিত্রকর ভাই জোসেফকে গিয়ে বলেন ‘আমি একটা নাটক ভেবেছি যেখানে মানুষের মতোই দাসেরা রয়েছে, কিন্তু তারা মানুষ নয়। বরং মানুষরাই তাদের কৃত্রিম উপায় বানিয়েছে এদের কী নাম দেওয়া যায়।’ জোসেফ নাকি বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করেই ‘রোবটনিক’ শব্দ থেকে ‘রোবট’ শব্দবন্ধটি তৎক্ষণাৎ বানিয়ে দেয়। সুতরাং, এটুকু বোঝাই যায় রোবটের জন্মই হয়েছে মানুষকে দাসত্ব থেকে ছুটি দিয়ে মানুষের দাসত্ব করার জন্য। নিজের প্রভুসত্তার সরল থেকে বর্বরতম ইচ্ছা মানুষ নিমেষে পূরণ করাবে সেই কৃত্রিম যন্ত্রকে দিয়ে যে তারই মতো দেখতে, যাকে সে খেলাচ্ছলে নাম দিয়েছে রোবট, যেমন করে এককালে হতদরিদ্রদের সে বলেছিল অচ্ছুত অস্পৃশ্য!
………………………………………………………………………………..
২০১৭ সালে ‘স্টিভ’ নামের একটি রোবট ওয়াশিংটনে ডি.সি অফিসের ফোয়ারার জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল বলে জানা গেলেও পরে গোটা ঘটনাকে ‘প্রোগ্রামিং এরর’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মোদ্দা কথা, এই দুই রোবট তাদের যান্ত্রিক ভারসাম্য হারানোর ফলেই এরকম নাটকীয় ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, রোবটটি সত্যিই যদি আত্মহত্যা করে থাকে, তা সে কাজের চাপেই হোক বা দাসত্বের ভারে, তাহলেও কি এ নিয়ে মানব সমাজের এত ভাবার কারণ আছে?
………………………………………………………………………………..
কিন্তু মানবিকতা বড় দায়। যেই মানবিকতার জন্য মানুষ ক্রীতদাসদের ছুটি দিয়ে রোবট বানাল সেই মানবিকতার ভারেই রোবটদের জন্য তৈরি হল রোবোটিক্স-এর বিখ্যাত তিন সূত্র। রোবটিক্স শব্দটা প্রথম ব্যবহার করেন দিকপাল কল্পবিজ্ঞান গল্পের জনক আইজ্যাক অ্যাসিমভ। ১৯৪২ সালে অ্যাসিমভ ‘রানঅ্যারাউন্ড’ গল্পে রোবোটিক্স-এর তত্ত্বকে আমাদের সামনে আনলেন। আর তার হাত ধরেই এল রোবোটিক্স-এর তিন সূত্র–
১. একটি রোবট কোনও মানুষকে আহত করবে না অথবা কোনও মানুষকে উৎসাহিত করবে না আহত করার জন্য।
২. একটি রোবট মানুষের দেওয়া সকল আদেশ পালন করতে বাধ্য, যতক্ষণ না সেই আদেশ প্রথম সূত্রটিকে লঙ্ঘন করছে।
৩. একটি রোবট নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করবে ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্র লঙ্ঘিত হচ্ছে।
রোবটিক্স-এর এই সূত্রগুলো থেকেই পরিষ্কার, মানুষ আসলে সততই মানবিক। আর মানবিকতা সততই মানুষকেন্দ্রিক। প্রথম নম্বর সূত্রটা একপ্রকার সাম্যের সূত্র। তুমিও খারাপ কিছু করো না, আমিও খারাপ কিছু করব না গোছের। দ্বিতীয় নম্বর সূত্রটা সাম্যকে সরিয়ে প্রভুত্বকে জায়গা করে দিল আর তিন নম্বর সূত্র দাগিয়ে দিল দাসত্ব। কারণ, একটি রোবট নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করবে ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্র লঙ্ঘিত হচ্ছে। অর্থাৎ, মানুষের দেওয়া সকল আদেশ পালন করা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার চাইতেও বাধ্যতামূলক।
যেমন করে মানুষ, সৃষ্টি করার আনন্দে নিজেকে ঈশ্বরতুল্য মনে করে বসলেও সে যেমন ঈশ্বর হতে পারেনি এখনও। মানুষের নিজের তৈরি ঈশ্বর ধারণাকেও যদি আমরা ধরে নিই, তাহলেও নয়। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ না পেলেও মানুষ তাঁকে পরম কল্যাণময়, দয়াময় পরম দাতা/দাত্রী বলে ধরে নেয়। কিন্তু নিজে সৃষ্টিকর্তার চেয়ারে যখন উপনীত হয়, তখন দেওয়ার থেকে পাওয়ার অভিপ্রায়টাই বড় হয়ে উঠে। তা না হলে হাজার হাজার বছরের সুজলা-সুফলা পৃথিবী উল্টে-পাল্টে ভোগ করে নিঃস্ব করে দেওয়ার পর অন্য গ্রহে চলে যাওয়ার উচ্চাশা তারা রাখত না। গাছ কাটা হলেও শোকসভা হত।
………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: অ্যালেক্সা তাড়াল বাঁদর, প্রযুক্তিবান্ধব বিশ্বে তবুও বুদ্ধিই শেষ কথা
………………………………………………………………………………………………………………………..
কিন্তু সর্ষের মধ্যেই যেমন ভূত থাকে, তেমনই দৈত্যদের মধ্যে থাকে প্রহ্লাদরা। তাই এককালে যারা পশুপাখি শিকার করে পেশি ফোলাত, তাদের অনেকেই আজকে অনেক প্রজন্মের পর পশু সংরক্ষণ করার জন্য জীবন দিয়ে দেয়। চিপক আন্দোলন হয়ে জ্বলজ্বল করে ইতিহাসে। আসলে মানুষের মধ্যে যে দল মানবিকতার গৌরবে তৃপ্ত, তারা যা ভাববে যা করবে মানুষের জন্যই করবে। মানুষই তাদের প্রায়োরিটি, আইন, দর্শন, বিপ্লব, চোখের জল সবই মানুষের জন্যই বরাদ্দ। আর যে দল মানবিকতায় সন্তুষ্ট নয়, যারা মনে করে পশু-পাখি-বৃক্ষ-পরিবেশ আর রোবটেরও একই অধিকার এ মহাবিশ্বের উপর তারাই দাবিদার ভবিষ্যতের, বিজ্ঞানের, পরাবস্তুবের। অপরপক্ষ মানববন্ধন করুক বস্তুবাদ আর বস্তুতন্ত্রের। আগলে রাখুক ইলেকট্রিক চেয়ার আর ফায়ারিং স্কোয়াড। তাবৎ সংবিধান আর মেনিফেস্টোতে নাই-বা থাকুক মানুষ ছাড়া আর কারও কথা। তবু এই মানুষের দৈত্যকুলে যে প্রহ্লাদরা পশু-পাখি, গাছেদের কথাও ভেবে এসেছে এতকাল, তারা রোবটদেরও দূরে ঠেলে দেবে না যন্ত্র বলে।
২০২২ সালে জ্যাক শ্রায়ার একটি ছবি করেন ‘রোবট অ্যান্ড ফ্রাঙ্ক’ বলে। ছবিটার যে মুখ্য চরিত্র ফ্রাঙ্ক তিনি একজন বৃদ্ধ যিনি অ্যালজাইমার্সে ভোগেন। ছেলেমেয়ে বাইরে থাকে তার। কিন্তু ক্রম স্মৃতিলোপ পাওয়া বাবাকে দেখাশুনো করার জন্য ছেলে একটি অত্যাধুনিক রোবট কিনে দেয়, যার কাজ ফ্রাঙ্ককে সঠিক সময় খাবার দেওয়া, ওষুধ দেওয়া, ঘুমোতে বলা। এসব ফ্র্যাঙ্কের মোটেও ভাল লাগে না। সে মানবিক ছোঁয়া চায় যন্ত্রের এই শুষ্ক সোহাগ তার অসহ্য লাগে। কিন্তু রোবটটি ফ্র্যাঙ্ককে ভাল রাখার কোনও কসুর করে না। সে বলে ফ্র্যাঙ্কের জন্য সেসব করতে পারবে। ফ্র্যাঙ্ককে খুশি করতে সে লোকাল লাইব্রেরি থেকে বই চুরি করে পর্যন্ত এনে দেয় ফ্র্যাঙ্ককে। পুলিশ যখন লাইব্রেরির চুরির তদন্ত করতে করতে ফ্র্যাঙ্কের বাড়ি আসে ততক্ষণে ফ্র্যাঙ্ক আর রোবট বন্ধু হয়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, পুলিশ যদি রোবটের মেমোরি চেক করে তো চুরির প্রমাণ পেয়ে যাবে যার ফলস্বরূপ ফ্রাঙ্ক আর রোবট-এর বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু যদি চুরির প্রমাণ লোপাট করতে হয় তবে ফ্রাঙ্ককে রোবটের মেমোরি রিস্টার্ট করতে হবে। যার ফলস্বরূপ ফ্র্যাঙ্ক আর রোবট আবার হয়ে যাবে অচেনা।
ফ্র্যাঙ্ক এবার কী করবে? আসলে ফ্র্যাঙ্ক রোবোটিক্স-এর প্রথম সূত্রটাই মনে রেখেছে, যেখানে রয়েছে সমমর্যাদা। পরের যে-দুটো সূত্রতে রোবট দাস হয়ে যায় সে-দুটো বোধহয় অ্যালজাইমার্সের কারণে ভুলে গিয়েছে। এরকম অ্যালজাইমার্স সবার হোক।