হিন্দি কমেডি ছবিতে দেখেছি, ঠিক কীভাবে শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধকতাকে মোটাদাগের হাসি অথবা অযথা করুণার আড়ালে অনবরত ছোট করা হয়। অপমান করা হয়। এই সমাজ এখান থেকে শেখে, অথবা শেখায়। কোথাও ভিস্যুয়ালি চ্যালেঞ্জড মেয়েকে বিয়ে করে হিরো হয়ে যাওয়া। কোথাও বা কোনও দৃষ্টিশক্তি হারানো মানুষকে ঘিরে চক্ষুষ্মানদের কানামাছি।
৮ জুলাই ২০২৪-এ প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের অধীনস্থ সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ থেকে একটি রায় বের হয়। রায়টি হল, ফিল্ম এবং ভিস্যুয়াল মিডিয়ায় ভিন্নভাবে বা বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের স্টিরিওটাইপ ছাঁচে না ফেলে, ইয়ার্কি-ঠাট্টার পাত্র না ভেবে, অথবা অহেতুক তাদের ওপর ‘ঐশ্বরিক মাহাত্ম্য’ না চাপিয়ে নির্মাতারা যেন তাদের সঠিকভাবে উপস্থাপন করেন। স্বাভাবিকভাবে অনেকেই খুশি। বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা এই রায়কে ‘যুগান্তকারী’ বলেছেন, যেখানে পঙ্গু, স্প্যাস্টিক– এইসব শব্দ ব্যবহারের নিন্দা করা হয়েছে। কারণ, এই শব্দগুলি প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য গড়ে তোলে এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম্পর্কে সামাজিক ধারণার অবমূল্যায়ন ঘটায়।
এবারে কথা হল, কীসের পরিপ্রেক্ষিতে এই রায়? জানা গেছে, ডিজএবিলিটি রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট নিপুণ মালহোত্রার দায়ের করা একটি আপিলের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দিয়েছে। কেন আপিল? ৩ নভেম্বর ২০২৩-এ সোনি পিকচার্স-এর প্রযোজনায় ‘আঁখ-মিচোলি’ নামে একটি ছবি মুক্তি পায়। নিপুণ মালহোত্রার অকাট্য যুক্তিতে যে-ছবি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার (পিডাব্লিউডি) লঙ্ঘন করে এবং প্রতিবন্ধী চরিত্রগুলিকে অত্যন্ত অবমাননাকর ও অসংবেদনশীলভাবে চিত্রায়িত করে।
বসে বসে এসবই পড়ছিলাম। ‘আঁখ-মিচোলি’ আমি দেখিনি। তবে অনুমান করতে পারি, হিন্দি কমেডি ছবি কিছু দেখেছি যেহেতু, ঠিক কীভাবে শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধকতাকে মোটাদাগের হাসি অথবা অযথা করুণার আড়ালে অনবরত ছোট করা হয়। অপমান করা হয়। এই সমাজ এখান থেকে শেখে, অথবা শেখায়। কোথাও ভিস্যুয়ালি চ্যালেঞ্জড মেয়েকে বিয়ে করে হিরো হয়ে যাওয়া। কোথাও বা কোনও দৃষ্টিশক্তি হারানো মানুষকে ঘিরে চক্ষুষ্মানদের কানামাছি। কথায় কথায় বলি, একটা নতুন শব্দ কিন্তু আমরা জেনেছি ইতিমধ্যে, ‘বিশেষভাবে সক্ষম’। যদিও এই শব্দটি নিয়ে কিছু মতান্তর আছে।
আমার ছবি ‘বাটন হোল’-এর প্রথম স্ক্রিনিং আর ডিসকাশন সেশন ছিল ২৬ জুন। সেখানে কয়েকজন বলেন, স্পেশালি এবেলড বা বিশেষভাবে সক্ষম বলতে তাদের অসুবিধে আছে। সেক্ষেত্রে আশা করা হয়, এই বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের এমন কোনও বিশেষ গুণ আছে যা সাধারণের নেই, অর্থাৎ সেই ঘুরে-ফিরে একটা দেবত্ব টাইপ কিছু আরোপের চেষ্টা। লার্জার দ্যান লাইফ। অটিজিম সোসাইটি ওয়েস্ট বেঙ্গলের কর্ণধার ইন্দ্রাণী বসু সেদিন বলছিলেন, মনে করা হয় যেন একটা ম্যাজিক অথবা একটা ভূত বা এলিয়েন এসে সমস্ত অক্ষমতা, প্রতিবন্ধকতাকে ঠিক করে দেবে। কোনও চেষ্টা, কোনও ট্রেনিং, লেগে থাকা– এসবের দরকারই নেই। আর এদের যৌনতা, যৌন ইচ্ছে নিয়ে তো কেউ কথাই বলতে চায় না। যেন এই স্পেশাল মানুষদের কোনও যৌন ইচ্ছা, আনন্দ বা অবসাদ থাকতেই পারে না। আর স্বীকার করতে লজ্জা নেই, মূলত অটিস্টিক কিশোরদের সেই যৌন আনন্দের দিশাই দিতে চেয়েছে আমাদের এই ছোট্ট প্রচেষ্টা– ‘বাটন হোল’। যে গল্প একাকী মায়ের, তার চ্যালেঞ্জড ছেলেকে ঘিরে। যে গল্প বন্ধুত্বের। হাত বাড়ানোর। চেষ্টা এবং অবিমিশ্র চেষ্টার।
আমার বোন যখন গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায়, তখনও জানি না ভবিষ্যৎ আমাকে কী উপহার দিতে চলেছে। শুধু এটুকু জানি, উপহার পেলে তা যত্নে রাখতে হয়। আমি আগুপিছু ভাবিনি তাই। বোনের অটিস্টিক ছেলে, আমার ঘুঁটিকে আমি প্রথমেই সুজাতার অনলাইন ক্লাসে ভর্তি করেছি। সুজাতা স্পেশাল এডুকেটর। বাটন হোল-এ এক স্পেশাল এডুকেটরের ভূমিকায় আছে আর এক স্পেশাল বাচ্চা রুকুর মা, এষা। এই বাচ্চারা আমাদের বড় আদরের। এরা মিথ্যে জানে না, শত্রু জানে না, ভালোবাসলে মেঘের মতো ঘনিয়ে ওঠে। তাদের পাশে মাকে দরকার। আর বাবাকেও, খুব বেশি করে। দুর্ভাগ্য যে, এদের বাবা প্রায়শই পালিয়ে যায়। যেমন আমার ছবিতে।
…………………………………………………………………….
বুকুনের পাশে সর্বক্ষণ সেঁটে থাকা, ট্রোলের জবাবে বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া করা, টিফিনের স্যান্ডউইচ ভাগ করে খাওয়া, বোতাম আঁটার কলাকৌশলের সঙ্গে প্রথম যৌন ফ্যান্টাসির আলাপ করানো মেয়েটা আমাদের সমস্ত বাচ্চার জীবনে জরুরি। ঘুঁটির যেমন ছিল, অঞ্জলি। টিফিন খাইয়ে দিত। হাত ধরে পৌঁছে দিত স্কুলের গেট অব্দি। তখন পাঁচ-ছ’বছরের অঞ্জলির কথা বলতে গিয়ে ফুটফুটে গাল দুটো লাল হয়ে যেত। এমন একটি অঞ্জলি, টিনাকে আমাদের ঘরের মেয়েরাই বুকে নিয়ে ঘোরে। জ্যোৎস্নার মায়ার মতো নেমে আসুক তারা আমাদের বাচ্চাদের জীবনে।
…………………………………………………………………….
বাবা দূর থেকে স্বমেহনের টিপস দেয় ছেলেকে। আর মা তাকে বেঁধে দেয় সময়, রুটিন। এই রুটিন জিনিসটা অবিচ্ছেদ্য, আমাদের চ্যালেঞ্জড বাচ্চাদের জীবনে। ছেলেকে দেখি, রোজ সে বেলা দেড়টায় অ্যালেক্সায় অরিজিৎ সিং চালিয়ে স্নানে ঢোকে। এখন সে নিজেই সাবান শ্যাম্পু মাখতে পারে। গামছা দিয়ে মাথা মুছতে পারে। ভাতটা শুধু মেখে দিতে হয়। আর আমার ছবির কিশোর বুকুন, মাছের ঝোলমাখা ভাতের একটা দানায় হাত বোলাতে বোলাতে শোনে বাবা-মার ঝগড়া। বারবার তার স্খলন আটকে যায়। স্কুলের বন্ধুরা হেনস্তা করে তাকে। নগ্ন মেয়ের ছবি আঁকা কাগজের প্লেন ছোড়ে তার দিকে। ঘুঁটির স্কুলে একটাই বন্ধু ছিল ওর। সপ্তর্ষি। ঘুঁটিরই মতো অনেকটা। রোজ মার খেত ক্লাসের ছেলেদের কাছে। বই-খাতা-পেনসিল ছুড়ে ফেলত ওরা জানালার বাইরে। একবার প্লাস্টিকের প্যাকেটে চেপে ধরেছিল মুখ। রোগা, ভারি মায়ামাখা মুখের ছেলেটা মাঝেমাঝে আসত আমাদের বাড়ি। ঘরে ঢুকে দেখতাম দুই বন্ধু বসে আছে পাশাপাশি। কারও মুখে কোনও কথা নেই। অথচ আমার সঙ্গে কত কথা বলত, চোখ ছলছল করে উঠত যখন জিজ্ঞেস করতাম, স্যরদের কাছে নালিশ করিস না কেন? বলতো নালিশ করলে যে আরও মারে! তো এই হল আমাদের ভদ্রসন্তানেরা! এদের আমি দোষও দিই না, কারণ এরা একটা এমন হিংস্র সমাজের প্রতিভূ, যারা ‘আঁখ-মিচোলি’র মতো ছবি দেখতে পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে হলে যায়। যারা শুধুমাত্র শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতাই নয়, যে কোনওরকম অসংগতি দেখলেই, হয় করুণা, আর নয়তো খিল্লি করে। এই করুণা আর খিল্লির সক্ষম সাম্রাজ্য থেকে আমরা, বুকুন-রুকু-ঘুঁটির মায়েরা বাঁচিয়ে রাখতে চাই আমাদের সন্তানকে।
………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধকতার শিকার, তবু বিমানকর্মীর দাবি: দু’মিনিট হেঁটে দেখান!
………………………………………………………………………………………………………..
তবে হ্যাঁ, এরপরেও কিছু কথা থাকে। কিছু মানুষ। বন্ধুত্ব। যেমন ‘বাটন হোল’-এ টিনা। বুকুনের পাশে সর্বক্ষণ সেঁটে থাকা, ট্রোলের জবাবে বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া করা, টিফিনের স্যান্ডউইচ ভাগ করে খাওয়া, বোতাম আঁটার কলাকৌশলের সঙ্গে প্রথম যৌন ফ্যান্টাসির আলাপ করানো মেয়েটা আমাদের সমস্ত বাচ্চার জীবনে জরুরি। ঘুঁটির যেমন ছিল, অঞ্জলি। টিফিন খাইয়ে দিত। হাত ধরে পৌঁছে দিত স্কুলের গেট অব্দি। তখন পাঁচ-ছ’বছরের অঞ্জলির কথা বলতে গিয়ে ফুটফুটে গাল দুটো লাল হয়ে যেত। এমন একটি অঞ্জলি, টিনাকে আমাদের ঘরের মেয়েরাই বুকে নিয়ে ঘোরে। জ্যোৎস্নার মায়ার মতো নেমে আসুক তারা আমাদের বাচ্চাদের জীবনে। আর কিছু তো নয়, যা আমরা ভুলে যেতে বসেছি, সেই স্বাভাবিক ভালোবাসার বোধ, মায়ামমতা, পাশে থাকার গল্পই আমরা বলতে চাই। শুনতে চাই আমাদের সময়ের ছবি-করিয়েদের কাছে। একটা শব্দ সেদিন বলেছিলেন একজন– সমমর্মিতা। আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে তুমি আমাকে বুঝে নাও। এটুকুই তো।
………………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………………….