যেকোনও বিষয়েরই ভালো-মন্দ দু’দিক থাকে, অলিম্পিকই বা ব্যতিক্রম হবে কেন? গৌরবের কাহিনি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে হিংসার রাজনীতি, জঙ্গি আক্রমণ, ডোপিংয়ের মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। যা ‘পবিত্র’ খেলার ইতিহাসকে বারবার কলুষিত করেছে। সেরকম অসংখ্য ঘটনা তুলে ধরেছেন চিরঞ্জীব। তার মানে এই নয় যে, অলিম্পিকের সার্বিক সততা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। লেখক বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক। অলিম্পিকের মঞ্চে একাধিকবার উপস্থিত ছিলেন। এই গ্রন্থে তিনি অসংখ্য ঘটনা সংকলন করেছেন শুধুমাত্র সেই কলঙ্কমুক্তির স্বপ্ন থেকে।
গত কয়েকটা মাস দেশের খেলা পাগল জনতার কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। আইপিএল, আইএসএল– এসব তো প্রতি বছরই থাকে। তার পরই দু’হাত ভরে এল ক্রিকেট বিশ্বকাপ, ইউরো, কোপা আমেরিকা। তার মধ্যে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর টি-টোয়েন্টি ফর্ম্যাটে বিশ্বকাপ ট্রফি ফিরেছে ভারতে। নানা দেশ, নানা মতের ইউরো-কোপায় যদিও সবার স্বপ্নপূরণ হয়নি। তবুও টানটান উত্তেজনায় কখন যে দু’টো মাস কেটে গিয়েছে, তার হিসেব কষা হয়নি। আর সে-সব মিটে যাওয়ার পর এবার পালা প্যারিস অলিম্পিকের।
অলিম্পিক– ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। প্রাচীন গ্রিস থেকে যার ঐতিহ্য আজও বয়ে চলেছে প্রতিটা দেশের ক্রীড়াসংস্কৃতির মধ্যে। যদিও আধুনিক অলিম্পিকের সূচনা ১৮৯৬ সালে, ফ্রান্সের শিক্ষাবিদ-দার্শনিক ব্যারন পিয়ের দি কুবার্টিনের হাত ধরে। ঘটনাচক্রে এবারের অলিম্পিক ফিরে এসেছে তাঁর শহর প্যারিসে। সেই ১২৮ বছরের পদযাত্রায় জড়িয়ে রয়েছে কত অজানা গল্প। সাফল্যের পরশপাথর থেকে ব্যর্থতার গিরিখাত ছুঁয়ে যা নিজের মতো উদ্বুদ্ধ করে যায় ক্রীড়াবিদদের। কিন্তু শুধুই কি ‘গ্রেটেস্ট’ মঞ্চের ‘গ্রেটেস্ট’ কাহিনি? নাকি তার রঙিন দুনিয়ায় রয়েছে অসংখ্য সাদা-কালো অঞ্চল! অলিম্পিকের মশালের তলার অন্ধকার কতটা গাঢ় হয়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে?
চিরঞ্জীবের লেখা ‘কলঙ্কের অলিম্পিক্স’ গ্রন্থ সেই ছাই চাপা ইতিহাসের ধারাভাষ্য। যেকোনও বিষয়েরই ভালো-মন্দ দু’দিক থাকে, অলিম্পিকই বা ব্যতিক্রম হবে কেন? গৌরবের কাহিনি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে হিংসার রাজনীতি, জঙ্গি আক্রমণ, ডোপিংয়ের মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। যা ‘পবিত্র’ খেলার ইতিহাসকে বারবার কলুষিত করেছে। সেরকম অসংখ্য ঘটনা তুলে ধরেছেন চিরঞ্জীব। তার মানে এই নয় যে, অলিম্পিকের সার্বিক সততা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। লেখক বর্ষীয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক। অলিম্পিকের মঞ্চে একাধিকবার উপস্থিত ছিলেন। এই গ্রন্থে তিনি অসংখ্য ঘটনা সংকলন করেছেন শুধুমাত্র সেই কলঙ্কমুক্তির স্বপ্ন থেকে।
আর না চাইলেও সেই ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা যোগসূত্র টেনে নেওয়া যায়। যেমন ধরা যাক, ১৯৩৬-র বার্লিং অলিম্পিক। হিটলার তখন জার্মানির একচ্ছত্র ক্ষমতায়। অলিম্পিকে আর্যত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবে, ফ্যুয়েরারের আদেশ। গোটা শহর সেজে উঠেছে স্বস্তিক পতাকায়। কিন্তু সেই সব আয়োজনের মধ্যে ছিল তীব্র ইহুদিবিদ্বেষ আর বর্ণবিদ্বেষ। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদ জেসি ওয়েন্স রেস জেতার পর স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন হিটলার। আবার সেই অলিম্পিকেই জার্মানির ‘আভিজাত্য’ গুঁড়িয়ে হকি ফাইনাল ৮-১ গোলে জিতে নিয়েছিল ধ্যানচাঁদ সিংয়ের ভারত।
মজার বিষয়, এবার ইউরোর আসর বসেছিল জার্মানিতে। যার ফাইনাল হয়েছিল হিটলার নির্মিত অলিম্পিয়াস্তাদিও স্টেডিয়ামে। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে খেতাব জেতা সেই ম্যাচে জনপ্রিয় হয়েছিল একটা ছবি। নিকো উইলিয়ামস, লামিনে ইয়ামাল আর দানি ওলমো, তিনজন উৎসবে ব্যস্ত। প্রথম দুজন কৃষ্ণাঙ্গ, উদ্বাস্তু। তৃতীয়জন শ্বেতাঙ্গ স্প্যানিশ। পরপারে থাকা হিটলারকে আবার একটা বিরাশি সিক্কার চড় মেরে গেল সদ্যসমাপ্ত ইউরো আসর।
এ তো গেল কলঙ্কমোচনের গল্প। কিন্তু ইতিহাসের থেকে শিক্ষা না নেওয়া কাহিনিও তো প্রচুর। কে ভুলতে পারে, ১৯৭২-র মিউনিখ ম্যাসাকারের কথা? চিরঞ্জীবের কলমে তা ফের শিউরে দিয়ে যায় পাঠককে। সেদিন সন্ত্রাসবাদী দল ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর গ্রুপ আক্রমণ চালায় ইজরায়েলি শিবিরে। সেই প্রথম অলিম্পিকে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ছায়া। মারা যান ইজরায়েলের কোচ-খেলোয়াড় সহ ১১ জন। মৃত্যু হয় ৫ জঙ্গিরও। অবশ্যই এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্যালেস্তাইনের নামও। আর তার অর্ধশতাব্দী পরে যখন প্যারিসে অলিম্পিকের আসর বসছে, তখনও বিশ্বরাজনীতিতে ভয়াবহ অস্থিরতার নাম প্যালেস্তাইন সংকট। শুধু ইতিহাসের পাতাটা বদলে যায়, শিক্ষা কেউ না নেয় না।
যুদ্ধের কথা উঠলে তো আমেরিকা দূরে থাকতে পারে না। পিছু পিছু আসবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নও। দু’দেশের ঠান্ডা যুদ্ধের অসংখ্য কাহিনি ‘কলঙ্কের অলিম্পিক্স’-এ তুলে ধরেছেন চিরঞ্জীব। সেখানে আছে দু’দেশে আয়োজিত অলিম্পিক বয়কট-পাল্টা বয়কটের ইতিহাস। বিবাদে জড়িয়ে পড়ে তাঁবেদার দেশগুলিও। ঘটনাচক্রে, তার মধ্যে একাধিক অলিম্পিকে লেখক স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। ফলে কখনও সোভিয়েত শিবির, কখনও আমেরিকা শিবির, এমনকী অলিম্পিক কমিটির তৎকালীন প্রধান সামারাঞ্চের দৃষ্টিভঙ্গিও জানা যায় তাঁর বয়ানে।
……………………………………………………………………………….
এবার ইউরোর আসর বসেছিল জার্মানিতে। যার ফাইনাল হয়েছিল হিটলার নির্মিত অলিম্পিয়াস্তাদিও স্টেডিয়ামে। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে খেতাব জেতা সেই ম্যাচে জনপ্রিয় হয়েছিল একটা ছবি। নিকো উইলিয়ামস, লামিনে ইয়ামাল আর দানি ওলমো, তিনজন উৎসবে ব্যস্ত। প্রথম দুজন কৃষ্ণাঙ্গ, উদ্বাস্তু। তৃতীয়জন শ্বেতাঙ্গ স্প্যানিশ। পরপারে থাকা হিটলারকে আবার একটা বিরাশি সিক্কার চড় মেরে গেল সদ্যসমাপ্ত ইউরো কাপ।
……………………………………………………………………………….
তবে জঙ্গিহানা, বিদ্বেষের কাহিনি, বয়কট, রাজনীতির অনুপ্রবেশ– সবগুলোকেই আপাতভাবে বিচ্ছিন্ন তকমা দেওয়া যায়। কোনওটাই সে অর্থে খেলাধুলোর সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে নেই। এর মধ্যে বর্ণবিদ্বেষ বা বয়কটের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আইওসি যথেষ্ট সক্রিয়। তবে বারবার চেষ্টা করেও যেটা রোধ করা যায়নি এবং যাচ্ছে না, সেটা হল ডোপিং। চিরঞ্জীবের মতে, অলিম্পিকের সবচেয়ে বড় কলঙ্ক এই ডোপিং। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান যত উন্নত হয়েছে, তত তার ধরন বদলেছে। সোভিয়েতের মতো রাষ্ট্র একসময় নিজের তত্ত্বাবধানে ডোপিংয়ের ব্যবস্থা করে দিত। যদিও তার নাম বদলেছে, বলতে হবে পারফরম্যান্স এনহ্যান্সিং ড্রাগ। অসংখ্য ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠছে শুধু এই অন্যায়ের ভরসায়। ডোপিংয়ের অভিযোগ তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশ হিসেবে অলিম্পিকে নিষিদ্ধ হয়েছে রাশিয়া।
১৯৬৮ থেকে ২০২১, এত বছরের ডোপিংয়ের ইতিহাসের একটা ছবি আমাদের সামনে উপস্থিত করেন চিরঞ্জীব। কীভাবে তার পদ্ধতি বদলেছে। তার মধ্যে প্রবেশ করেছে রাজনীতির আস্ফালন। ‘ক্লিন’ করতে চেয়েও কীভাবে ব্যর্থ হয়েছে আইওসি। আর তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডোপিংয়ে রাশিয়ার পরের নামটাই ভারত! ভাবলেই চমকে উঠতে হয়।
………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন অর্পণ দাস-এর লেখা: কলকাতার ২০০ বছরের থিয়েটারের পথঘাট যেভাবে হাঁটবেন
………………………………………………………………………….
সেই প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে বেন জনসনের কথা। ১৯৮৮-র সিওল অলিম্পিকে মাত্র ৯.৭৯ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়ে রেকর্ড গড়েছিলেন কানাডার অ্যাথলিট। কিন্তু তার পরই জুড়ে গেল ডোপিংয়ের কলঙ্ক। সমস্ত মেডেল কেড়ে নেওয়া হয় তাঁর থেকে। আর জনসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সরব হয়েছিলেন যে ব্যক্তি, সেই কার্ল লুইসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ডোপিংয়ের ইতিহাস। যদিও পরবর্তীতে টরোন্টো স্টারের রিপোর্টে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ডোপ টেস্টের সার্বিক ব্যবস্থা নিয়ে। পাওয়া গিয়েছে চক্রান্তের গন্ধও। সেসব বিতর্ক কোনওদিন থামবে বলে মনে হয় না।
……………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………..
কিন্তু চেষ্টা চলছে। অসংখ্য পরিবর্তন আসছে অলিম্পিকের আসরে। প্রাচীন গ্রিসে মহিলাদের অলিম্পিক দেখা নিষিদ্ধ ছিল। সেখানে এবার মহিলা-পুরুষ সমবেতন কাঠামো আনা হয়েছে। ১৯০০-র মঞ্চে ছিল পায়রা হত্যার ‘ইভেন্ট’। এখন প্যারিসের ইঁদুরদের কীভাবে বশ করা হবে, সেই নিয়ে মাথায় হাত আয়োজকদের। তাতেও কি বিতর্ক এড়ানো যাবে? পদকের সাফল্য-ব্যর্থতা একদিকে, কিন্তু মানুষের অন্তরে লোভ-ঘৃণা-হিংসার যে অন্ধকার রয়েছে, তাকে দূর করবে কোন মশালের আলো? চিরঞ্জীবের ‘কলঙ্কের অলিম্পিক্স’ গ্রন্থ সেই ভুলের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার এক সংক্ষিপ্ত সংকলন।
কলঙ্কের অলিম্পিক্স
চিরঞ্জীব
মান্দাস
২৫০্