পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হল ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ১০ শ্রাবণ, শনিবার। ইংরেজি হিসেবে সালটা ছিল ১৯২৪। ৩২ পাতার সাপ্তাহিক চটি পত্রিকা, দাম সংখ্যা-প্রতি এক আনা। ছাপা হয়েছিল ৯১ আপার সার্কুলার রোডের ‘প্রবাসী প্রেস’ থেকে। উদ্দেশ্যহীনতার কথা সগৌরবে বলা হল আর কেন উদ্দেশ্যহীন তাও স্পষ্ট উচ্চারণ করা হল, ‘নিজেদের স্বভাব, জীবন ও আগ্রহের ক্রমবিকাশের পথ ধ’রে চলতে চলতে আমাদের যা ভাল মনে হবে আমরা তারই অনুসরণ করব– কোন নির্দিষ্ট ‘পলিসি’র অনুসরণ করতে গিয়ে জীবন, স্বভাব ও চির পরিবর্তনশীল হৃদয়াকাঙ্ক্ষাগুলিকে আড়ষ্ট এ প্রাণহীন করে ফেলব না।’ শেষ বাক্যে পাঞ্জা লড়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘অনেক রকম গোলমালই আমরা বাধাব, কিন্তু অলমতিবিস্তরেণ।’
শনিবারের চিঠি-র মূল পরিকল্পনা ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে অশোক চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৯৮-১৯৮২)। উচ্চশিক্ষা সিটি কলেজ , স্কটিশ চার্চ কলেজ আর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজ জীবনে মুষ্টিযুদ্ধে বেশ দক্ষ ছিলেন আর সে বিষয়ে উৎসাহ তাঁর শেষ জীবন পর্যন্ত ছিল। ২৭ নম্বর বাদুড় বাগান স্ট্রিটের মেস থেকে সজনীকান্ত দাসকে (১৯০০-১৯৬২) ‘কবি ও কবিরাজ’ জীবনময় রায় প্রথম অশোক চট্টোপাধ্যায়ের কাছে নিয়ে যান। ১৫ আমহার্স্ট স্ট্রিটের রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে হাজির হয়ে জীবনময় দারোয়ানকে ক্ষুদুবাবুকে খবর দিতে বললেন আর একজন ‘সুশ্রী সবলকায় যুবকের দর্শন’ মিলল। জীবনময় তাঁকে একান্তে সজনীকান্ত সম্বন্ধে কিছু বললেন, বোধহয় কামস্কাটকীয় ছন্দে কবিতা লেখার কথা। সজনীকান্ত অন্যদিকে মুখ করে একপাশে দাঁড়িয়ে ঘাম ছিলেন। দিনটা ছিল তাঁর জন্মদিন, ৯ ভাদ্র। হঠাৎ কাঁধের ডান হাতের গোড়ায় বাঘের থাবার মতো একটা ভারী ঘা পড়ল। চমকে উঠে দেখলেন ‘চিত্রবিচিত্র’ পোশাক পরা ‘ব্যাঘ্র মহারাজ’ দাঁড়িয়ে আছেন। এতক্ষণে সজনীকান্ত বুঝলেন এই ‘ক্ষুদুবাবু’ হচ্ছেন অশোক চট্টোপাধ্যায়, শনিবারের চিঠি-র ব্রহ্মা!
অশোক চট্টোপাধ্যায় প্রথম পরিচয়ে বললেন, ‘শরীরটা তো ভালো, শুনলাম, কবিতা লেখেন, পাঞ্জা লড়তে পারেন কি?’
দ্বিধা কাটিয়ে মুহূর্তের মধ্যে সজনীকান্ত বললেন, ‘পারি।’
বারান্দার মধ্যে দাঁড়িয়েই সকালবেলা পাঞ্জা শুরু হয়ে গেল। ডান হাতের পাঞ্জাতে জিতলেন ক্ষুদুবাবু আর বাঁ হাতের পাঞ্জাতে সজনীকান্ত। প্রথমজনের বয়স তখন ২৬, দ্বিতীয়জনের ২৪। সজনীকান্তের ক্ষমতায় খুশি ক্ষুদুবাবু বলেছিলেন যে, পাঞ্জাবলের মতো কবিতাও ভালো হলে ‘প্রবাসী’তে ছবি সমেত ছেপে দেবেন। ছবি মানে রং-পালিশ দেওয়া মুখের ছবি নয়, সুঠাম শরীরের আলোকচিত্র। বলেছিলেন, ‘স্বাস্থ্যের সঙ্গে কবিতা এ দেশে বেমানান। দেখা যাক।’ তারপর সজনীকান্তকে লেখা নিয়ে সেদিন সন্ধেয় হাজির হতে বলেছিলেন ‘প্রবাসী’ অফিসের দোতলায় ‘শনিবারের চিঠি’-র দপ্তরে।
গিয়েছিলেন সজনীকান্ত ৯১ আপার সার্কুলার রোডের সে বাড়ির দোতলায় গিয়েছিলেন। দেখেছিলেন, একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের মধ্যমণি হয়ে অশোক চট্টোপাধ্যায় বসে আছেন আর তাঁকে ঘিরে কেউ চেয়ারে কেউ স্টুলে কেউ জানলার কার্নিশে বসে আছেন। আড্ডা চলছে, সে সঙ্গে সবচেয়ে কম সময়ে খামের মধ্যে কে ক’টা ‘শনিবারের চিঠি’ ভরতে পারে তার প্রতিযোগিতা। খাওয়া হচ্ছে পরোটার সঙ্গে কাবাব। জাত মোগলাই খাবার। সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে। খাওয়া শেষ করে, ‘ভাবকুমার প্রধান’ ছদ্মনামে লেখা তিনটি কবিতা একটি খামে ভরে সজনীকান্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন অশোক চট্টোপাধ্যায়ের হাতে। তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে সেটি ডানদিকের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলেন। পরের দিন ‘শনিবারের চিঠি’র দপ্তরে গেলে অশোক চট্টোপাধ্যায় আবহাওয়ার খবর দেওয়ার মতো গলায় বলেছিলেন যে, লেখা মনোনীত হয়েছে। তারপর জিজ্ঞেস করেছিলেন সজনীকান্ত প্রুফ দেখতে পারেন কি না। ‘হ্যাঁ’ বলায় ‘খাঁটি’ নামের একটি প্রবন্ধ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সজনীকান্ত লেখকের নামের জায়গায় দেখলেন লেখা আছে ‘বেনামা’। তিনি লেখার ভাষা ও বানান দেখে বুঝলেন লেখাটি যোগেশচন্দ্র রায়ের কারণ তাঁর অনেক প্রবন্ধই আগে ‘প্রবাসী’তে পড়েছিলেন। প্রুফ দেখে বসেছিলেন, অশোক চট্টোপাধ্যায় আবার ঢুকলেন। সে সঙ্গে ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক যোগানন্দ দাস আর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ভাইপো হেমন্ত চট্টোপাধ্যায়। হেমন্ত ‘প্রবাসী’ অফিসের একটি অংশে থাকতেন আর খালি গায়েই এসেছিলেন। সজনীকান্ত ‘খাঁটি’ প্রবন্ধটি বিষয়ে ‘এ যে দেখছি যোগেশচন্দ্র রায়ের লেখা’ বলাতে অশোক চট্টোপাধ্যায় অন্য দু’জনের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতে বুদ্ধির তারিফ করলেন। সে দিনই তিনি মাসিক ২৫ টাকা মাইনেতে সজনীকান্তকে নিজের সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করলেন। তাঁর ওপর প্রথম কাজের ভার পড়ল পুলিনবিহারী দাসের (১৮৭৭-১৯৪৯) ‘লাঠিখেলা ও অসিশিক্ষা’ পাণ্ডুলিপির ভাষা সংশোধন, প্রুফ দেখা আর প্রেস-ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে বই হিসেবে তাড়াতাড়ি প্রকাশ করা।
আগের দিন সকালে পাঞ্জা লড়াই, সন্ধেয় পরোটা ও কাবাব খাওয়া আর দ্বিতীয় দিন সন্ধেয় ঢাকা অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা পুলিনবিহারীর পাণ্ডুলিপিটি হাতে পেয়ে বুঝেছিলেন যে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাহুবল ও বাক্যবলের যুক্তি ‘শনিবারের চিঠি’তে খাটবে না। এখানের পরীক্ষা শুরু হয় বাহুবল দিয়ে, তাকে বল জোগাতে স্নেহময় খাদ্য ও আমিষ পদের জোগান থাকে আর বুদ্ধিবলের প্রয়োগ ঘটে লাঠি ও অসিবিদ্যার পাণ্ডুলিপি সংস্কারের পর বই হিসেবে প্রকাশ করে। এমনকী, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সঙ্গে (প্রথম প্রকাশ বৈশাখ ১২৭৯) বিন্দুমাত্র যোগ নেই। বঙ্কিমচন্দ্র পত্র-সূচনায় ‘বঙ্গদর্শন’কে ‘সুশিক্ষিত বাঙ্গালীর পাঠোপযোগী’ করার পাশাপাশি আরও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তার বাহান্ন বছর পরে আষাঢ় মাসের এক সন্ধেবেলায় হেদুয়ার পুকুর পাড়ের আলো-আঁধারিতে বসে অশোক চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মোট পাঁচ বন্ধু ঠিক করলেন এমন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করবেন– যার কোনও উদ্দেশ্য থাকবে না। এমনকী, উদ্দেশ্যহীনতাও তাঁদের লক্ষ্য হবে না। এই পাঁচজনের একজন হলেন যোগানন্দ দাস (১৮৯৩-১৯৭৯)। তিনি পত্রিকার সম্পাদক ও মুদ্রাকরের দায়িত্ব পেলেন আর হেমন্ত চট্টোপাধ্যায় (১৮৯৭-?) কর্মাধ্যক্ষের পদ পেলেন। বাকি দু’জন– সুধীরকুমার চৌধুরী আর প্রভাকর দাস, অন্যান্য কাজ সামলাবেন বলে ঠিক হল। পত্রিকার স্বত্বাধিকারী হলেন অশোক চট্টোপাধ্যায়, যিনি সামান্য কিছুদিন আগে বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে এসে একেবারে নতুন ও অভিনব কিছু করবেন ভাবছিলেন। তার সূচনা হল ‘শনিবারের চিঠি’ নামটিতে। যে শনিকে সবাই এড়িয়ে চলেন তাকেই সঙ্গী করলেন। ‘স্যাটারডে’ শব্দটি সাপ্তাহিক পত্রের নামের ক্ষেত্রে বিদেশে আগেই ব্যবহৃত হয়েছিল কিন্তু তাতে আমাদের দেশের শনি শব্দের নাম-মাহাত্ম্য ছিল না।
পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হল ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ১০ শ্রাবণ, শনিবার। ইংরেজি হিসেবে সালটা ছিল ১৯২৪। ৩২ পাতার সাপ্তাহিক চটি পত্রিকা, দাম সংখ্যা-প্রতি এক আনা। ছাপা হয়েছিল ৯১ আপার সার্কুলার রোডের ‘প্রবাসী প্রেস’ থেকে। উদ্দেশ্যহীনতার কথা সগৌরবে বলা হল আর কেন উদ্দেশ্যহীন তাও স্পষ্ট উচ্চারণ করা হল, ‘নিজেদের স্বভাব, জীবন ও আগ্রহের ক্রমবিকাশের পথ ধ’রে চলতে চলতে আমাদের যা ভাল মনে হবে আমরা তারই অনুসরণ করব– কোন নির্দিষ্ট ‘পলিসি’র অনুসরণ করতে গিয়ে জীবন, স্বভাব ও চির পরিবর্তনশীল হৃদয়াকাঙ্ক্ষাগুলিকে আড়ষ্ট এ প্রাণহীন করে ফেলব না।’ শেষ বাক্যে পাঞ্জা লড়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘অনেক রকম গোলমালই আমরা বাধাব, কিন্তু অলমতিবিস্তরেণ।’ গোলমাল বাধানোর পূর্বাভাস মিলেছিল ‘মৌলা দোপেঁয়াজি’ ছদ্মনামে হেমন্ত চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিজ্ঞাপনী সাহিত্য’ লেখাটিতে। তিনি সেখানে প্রাচীন শাস্ত্র ও সাহিত্যের প্রকাশক বসুমতী সাহিত্য মন্দিরকে ব্যঙ্গ করে লিখলেন, ‘ঐ দেখুন, পিল্ পিল্ করিয়া আবালবৃদ্ধবনিতা বাংলার সকল নরনারী কামান-গর্জনে সচকিত হইয়া কেরামতী-সাহিত্য-মন্দিরের দিকে দৌড়াইয়া আসিতেছে! কিন্তু এ কামান মানুষ মারিবার জন্য নহে– বিলাতী হিংস্র শ্রাপনেল নহে, ইহা তাপিত হৃদয়ে শান্তিবারী বরিষণকারী জলদগোলা।’ দূর অতীত কিংবা দূর দেশ বিষয়ে কোনও টান বা মোহ নেই বলে প্রথম সম্পাদকীয়তেই লিখেছিলেন অশোক চট্টোপাধ্যায় আর তা হাতেনাতে প্রমাণ মিলল এখানেই। সে সঙ্গে ‘শনিবারের চিঠি’র শ্লেষ ও পরিহাসের বিশেষ স্বরটি প্রতিষ্ঠা পেল। তারপর একে একে ২৭টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সেগুলিতে ছদ্মনামে লেখা রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, অশোক চট্টোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, সজনীকান্ত দাস, যোগানন্দ দাস প্রমুখের ছোঁড়া রাজনৈতিক , সামাজিক, সাহিত্যিক তীর কতজনকে যে আঘাত করেছিল, তার ঠিক নেই! তারপর ১৩৩১-এর ৯ ফাল্গুন ( ১৯২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস) সাপ্তাহিক ‘শনিবারের চিঠি’ বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৩৪-এর (১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ) ভাদ্র মাসে মাসিকপত্র হিসেবে নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করে। ওই পর্বে মাঘ থেকে পরের বছর ভাদ্র পর্যন্ত নীরদচন্দ্র চৌধুরী ‘শনিবারের চিঠি’ সম্পাদনা করেন। নীরদচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ডে এ-বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আশ্বিন ১৩৩৫-এ সম্পাদনার দায়িত্ব নেন সজনীকান্ত দাস আর বাকবিতণ্ডা তৈরি করে বেশ জনপ্রিয় করে তোলেন। সজনীকান্ত ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকার সম্পাদক হন পৌষ ১৩৩৯-এ আর মাঘ ১৩৪১ পর্যন্ত সে কাজেই ছিলেন। এই ‘বঙ্গশ্রী’ দপ্তরে সজনীকান্তের সঙ্গে পরিমল গোস্বামীর আলাপ হয় আর সজনীকান্তের অনুরোধে তিনি ১৩৩৯-এর পৌষ থেকে ‘শনিবারের চিঠি’ সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। তখন কাগজের দাম ছিল রিম প্রতি দু’-টাকা চার আনা। ঘরে কম্পোজ চার টাকা ফর্মা আর বাইরে ছাপা ফর্মা পিছু দেড় টাকা। ডাবল ক্রাউন ১৬ পৃষ্ঠায় ফর্মা সম্পূর্ণ হয়। তখন ‘শনিবারের চিঠি’র অফিস ৫ সি, রাজেন্দ্র লাল স্ট্রিটে। ১৯৩৬-এর জুলাই থেকে সজনীকান্ত দাস ‘শনিবারের চিঠি’-র পূর্ণ দায়িত্ব নিলেন, আর তা চলেছিল তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। প্রায় চার দশক তিনি পাঞ্জা লড়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের অনেক রথী-মহারথীর সঙ্গেই।
তিনি ঠিক কী করেছিলেন? তিনি বড় মাপের কবি আর সেই প্রতিভাকে ব্যঙ্গ কবিতাতে প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলা রস সাহিত্যকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তরে উন্নীত করেছিলেন। কষ্টকল্পিত ও কৃত্রিম রচনাকে আক্রমণ করেছিলেন। আবেগতাড়িত বাংলা কাব্যকে ভাবার জন্য তাড়িত করেছিলেন। বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনিষ্ঠ রচনায় উৎসাহিত করেছিলেন। নতুন প্রতিভাকে আবিষ্কার করেছিলেন। সে কালের বিশিষ্ট কথাকার, প্রাবন্ধিক ও কবিদের লেখা প্রকাশ করেছিলেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, মোহিতলাল মজুমদার, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, যোগেশচন্দ্র রায়, গোপাল হালদারের মতো লেখকেরা যুক্ত ছিলেন ‘শনিবারের চিঠি’র সঙ্গে। কেউ ‘প্রবাসী’ থেকে ‘শনিবারের চিঠি’র লেখক হন। কেউ আবার সরাসরি।
আসলে অশোক চট্টোপাধ্যায় ‘শনিবারের চিঠি’র মাধ্যমে বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে একটি ধারাকে পুষ্ট করেছিলেন। সেটি হল রোমান্টিক ধারার বিপরীতে ক্ল্যাসিক্যাল ধারা। ইংরেজি সাহিত্যে সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের কবি, নাট্যকার এবং গদ্যকাররা অধিকাংশই এই ধারা অনুসরণ করেছিলেন। এঁরা আবেগকে অনেক সংহত রূপে প্রয়োগ করতেন আর শব্দ ব্যবহারে অত্যন্ত সচেতন থাকতেন। টি এস এলিয়টও এ পথেরই পথিক। আমাদের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও তাই। ওই ‘কল্লোল’-এর কবি ও কথাকারেরা অনেকেই রোমান্টিক ধারার অনুগামী ছিলেন বলে ‘শনিবারের চিঠি’র আঘাত অনেক সময় তাঁদের ওপর বেশি পড়েছিল। ভুল ভাবেও কোথাও কোথাও লাঠি নেমে এসেছিল, লড়াইয়ের সময়ে যেমন অবাঞ্ছিত কিছু ঘটনা ঘটে থাকে।
সজনীকান্ত দাসের মৃত্যুর পর অশোক চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘সজনীকান্ত সবল-আত্মা পুরুষ ছিলেন। তাঁহার সকল চেষ্টা সতেজ ও বলিষ্ঠ ছিল।’ সাহিত্যের আসরে যে পাঞ্জা সজনীকান্ত লড়েছিলেন, এ তার স্বীকৃতি। অশোক চট্টোপাধ্যায় ততদিনে বিশ্বভারতী ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ শেষ করেছেন কিন্তু তাঁর অন্য কিছু দায়িত্ব খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন। তিনি তখন যে দু’টি প্রধান পদ অলংকৃত করছেন তার একটি হল সর্বভারতীয় মুষ্টিযোদ্ধা ফেডারেশনের সভাপতির পদ আর অন্যটি বেঙ্গল অ্যামেচার বক্সিং ফেডারেশনের অধ্যক্ষের।
‘শনিবারের চিঠি’ ছিল দুই মুষ্টিযোদ্ধা অশোক চট্টোপাধ্যায় আর সজনীকান্ত দাসের প্রাণের আখড়া।
বীরভূমের লেখক-গবেষকেরা মনে করেন, বীরভূমের লাভপুরের কাছে দেবী ফুল্লরাতেই সেই পীঠের অধিষ্ঠান আবার বর্ধমানের গবেষকেরা দাবি করেন, ঈশানী নদীর বাঁকে বর্ধমানের দক্ষিণডিহিতেই দেবীর ওষ্ঠপাত ঘটেছিল। তবে ভক্তদের কাছে দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র এবং অলৌকিক শক্তি দুই জায়গাতেই বর্তমান।