৫ সেপ্টেম্বর, ‘লিপিঘর’ ৫ বছর পেরিয়ে ৬-এ পা দিল। এই ৫ বছরে আমরা সম্পূর্ণ নতুন ও দৃষ্টিনন্দন ২৫৬টি ফন্ট প্রকাশ করেছি, যা অদ্যাবধি বাংলা ফন্টের ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত। ডিজিটাল মাধ্যমে তৈরি বাংলা ফন্টের সর্ববৃহৎ প্রাপ্তিস্থান হিসাবে লিপিঘরের স্থানকে যা সুদৃঢ় করেছে। ৬ সেপ্টেম্বর, ১৭৭৮ সালে হুগলিতে ছাপাখানা জন্ম নিয়েছিল। ছাপাখানার জন্মদিনে হরফের ভবিষ্যৎ দর্শন।
শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। তা বেশ, ঢাকুক মুখ। কিন্তু যদি ঢাকে, তা ঢাকুক বাংলা ভাষার, বাংলা লিপির নান্দনিক বিজ্ঞাপনেই। ঠিক এই চিন্তাবিন্দুটি থেকেই লিপিঘরের (lipighor.com) যাত্রা শুরু। আমরা চাই, বাংলা ভাষা দিয়েই যাতে ঢেকে যায় বাঙালির মন ও মনন।
ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলা ভাষা নিয়ে যখন আমরা কাজ করতে এগলাম, বুঝতে পারলাম, সুন্দর ও রুচিশীল বাংলা ফন্টের বড়ই অভাব। অথচ বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালি প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছে। শিল্পে-সাহিত্যে বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের অবদান এবং বিশ্ব মানচিত্রে সেই অবদানের স্বীকৃতি রীতিমতো ঈর্ষণীয়। তা সত্ত্বেও এই অভাব কেন?
এই ডিজিটাল যুগে যে কোনও জিনিসের ‘ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট’ না থাকলে তা আস্তে আস্তে অবলুপ্ত হতে বাধ্য। এই আশঙ্কাতেই আমাদের বাংলা ফন্ট নিয়ে কাজ শুরু। এ কাজে পথ চলার বন্ধু হিসেবে পেয়েছি পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রায় ১০০ জনকে। যাঁরা ক্যালিগ্রাফার, টাইপোগ্রাফার, লেটারিং ও ফন্ট ডেভলপার। এই বিশালাকায় টিমকে ধন্যবাদ– যাঁরা প্রতিনিয়ত কাঁটাতার ও ভৌগোলিক দূরত্বের ব্যবধান ভুলে বাংলা লিপির সৌন্দর্য্যায়নে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন।
ভাষার লিখিত রূপ লিপি। লিপির ডিজিটাইজড রূপ বাংলা ফন্ট। বাঙালিরা বাংলাতে কাজ করতে গিয়ে হাতের কাছে বাংলা ফন্ট পাচ্ছেন না– এই সমস্যার সমাধান কী? ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘Necessity is the mother of invention.’ জাতিগতভাবে একটা অভাববোধ আমাদের শুরু থেকেই প্রেরণা জুগিয়ে এসেছে। বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন ও শিলচর ভাষা আন্দোলনে ভাষা শহিদদের আমরা বিশেষ দিন ছাড়া মনে করার প্রয়োজন বোধ করি না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমরা ভাষার জন্য সেভাবে কিছুই কি করতে পারি না? বাঙালি নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা এবং বিতর্কে যতটা সক্রিয়– আসল সমস্যার সমাধানে সম্ভবত ততটা নয়। তাই আমরা নিজেরাই ঝাঁপিয়ে পড়ি এই সমস্যার মূল খুঁজে বের করে সমাধানের পথে।
আপাত সহজ ফন্ট তৈরির এই পদ্ধতির নেপথ্যে দু’টি স্বতন্ত্র টিম কাজ করে। একদল মানুষ– যাঁরা ক্যালিগ্রাফি করেন, বিভিন্ন ধরনের হরফ ডিজাইন করেন। অন্য টিম সেই হরফগুলিকে ডিজিটাল ও প্রিন্ট মাধ্যমে ব্যবহারের উপযোগী করে ফন্ট হিসাবে ডেভেলপ করেন। খুব বেশি টেকনিক্যাল আলোচনার মধ্যে না গিয়েও যেটা বলা যায়, তা হল একটি পূর্ণাঙ্গ ফন্ট সব মাধ্যমে ব্যবহার করার মতো উপযোগী করে তুলতে কম-বেশি ৫৫০টির মতো হরফ একটি একটি করে আলাদাভাবে ডিজাইন ও ডেভেলপ করতে হয়।
৫ সেপ্টেম্বর, লিপিঘর ৫ বছর পেরিয়ে ৬-এ পা দিল। এই ৫ বছরে আমরা সম্পূর্ণ নতুন ও দৃষ্টিনন্দন ২৫৬টি ফন্ট প্রকাশ করেছি, যা অদ্যাবধি বাংলা ফন্টের ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত। ডিজিটাল মাধ্যমে তৈরি বাংলা ফন্টের সর্ববৃহৎ প্রাপ্তিস্থান হিসাবে লিপিঘরের স্থানকে যা সুদৃঢ় করেছে। আমাদের আগে বাংলা ফন্ট নিয়ে যাঁরা কাজ করে গেছেন, তাঁদের ফন্টগুলিকে সংগ্রহ, সংশোধন ও আধুনিকীকরণ করে লিপিঘরের পাশাপাশি ‘অক্ষর ৫২’ (okkhor52.com) নামক বাংলা ফন্টের সর্ববৃহৎ উন্মুক্ত সংগ্রহশালা আমরা তৈরি করেছি। এই পথ চলায় লিপিঘরের ফন্ট ব্যবহারকারীদের সুচিন্তিত মতামত, প্রত্যাশা-প্রতিক্রিয়া ও সহযোগিতা আমাদের কখনও নিঃসঙ্গতা অনুভব করতে দেয়নি। লিপিঘর স্থাপনের আগে পর্যন্ত যা বাংলা ফন্ট পাওয়া যেত, তার সিংহভাগই ছিল ‘নন-ইউনিকোড’। তাই সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রকাশনা সংস্থা, প্রিন্ট মিডিয়া সংস্থাগুলির প্রায় পুরোটাই সেই নন স্ট্যান্ডার্ড ও নন ইউনিকোড ফন্ট ব্যবহার করতে বাধ্য হতেন।
কিন্তু ‘লিপিঘর’ আসার পরে সেই চিত্রটি আমূল পরিবর্তিত হয়েছে। ফন্ট তৈরির পাশাপাশি আমরা ফন্ট ব্যবহারকারীদেরও সচেতন করে চলেছি, যাতে করে ইউনিকোড ব্যবহারের দিকে সকলেই আগ্রহী হন। সে কাজে আমরা অনেকটাই সফল হয়েছি। এই মুহূর্তে ভারত-বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলা লিপি ব্যবহারকারী লিডিং মিডিয়া হাউজ ও প্রকাশনা সংস্থাগুলি বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে ছাপার হরফে। ছোট-বড় সমস্ত টেলিভিশন চ্যানেল, ইউটিউব চ্যানেল, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম-সহ সমস্ত সামাজিক মাধ্যমে আমাদের বিভিন্ন ফন্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেকেই ফন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে লিপিঘরকে কৃতজ্ঞতা প্রদান করছেন, এটাও আমাদের কাছে উৎসাহব্যঞ্জক।
কম্পিউটার আসার আগেকার সময়ে বাংলা ফন্ট তৈরি করা হত কাঠের ব্লকে এবং পরবর্তী সময়ে লেটারপ্রেসে সিসার অক্ষরে। তারপরে কম্পিউটার আসার পরে ডিটিপি-র জয়জয়কার শুরু হয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক উদ্যোগে বাংলা লেখার সফটওয়্যার তৈরি হতে থাকে, যেগুলি প্রধানত তাদের মতো করে বাংলা লেখার কাজটি কোনওভাবে চালিয়ে নিত। কিন্তু পরবর্তীতে ইউনিকোড আসার পরে এই সফটওয়্যারের বিভিন্ন সমস্যার কারাগার থেকে বাংলা ফন্ট ব্যবহারকারীরা মুক্তি পান। আমাদের তাই এভাবেই ফন্টগুলি তৈরি করতে হয়, যাতে বর্তমান সময়ের হাতে হাতে প্রচলিত মোবাইল ডিভাইস থেকে শুরু করে কম্পিউটারের সমস্ত প্রচলিত সিস্টেমেই আমাদের ফন্টগুলি কাজ করে। এবং কোনও ব্যবহারকারীই যাতে সমস্যার সম্মুখীন না হন।
বাংলা ফন্ট নিয়ে কাজ করার চিন্তা-ভাবনা এবং কাজ শুরুর সবচেয়ে বৃহত্তম বাঁধা ছিল ফন্ট তৈরি শেখা। কারণ কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কোনও কম্পিউটার ট্রেনিং ইন্সটিটিউটেই ফন্ট তৈরির কোনও কোর্স নেই। যা আছে, তা মূলত গ্রাফিক ডিজাইনের অন্তর্ভুক্ত ক্যালিগ্রাফি, টাইপোগ্রাফি এবং লেটারিং-এর উপরে। এই কারণেই আমাদের ফন্টের কাজ শেখার জন্য অনেকেরই সাহায্য নিতে হয়েছে। কখনও বা ফন্ট তৈরির সফওয়্যারের খুঁটিনাটি নিয়ে জানতে রাত-দিন এক করে নিজেদেরই লেগে থাকতে হয়েছে। আবার কখনও বা কোনও সমস্যা যতক্ষণ না পর্যন্ত সমাধান হয়েছে– সেটি নিয়ে মাসের পর মাস গবেষণা করে যেতে হয়েছে। অর্থনৈতিক বাধার পাহাড়টা ডিঙানোর কাজটাও বড় সমস্যা– যেটির সম্মুখীন আমরা প্রতিনিয়ত হয়ে চলেছি।
বাংলা ভাষার সুবিশাল মনন-ভাণ্ডারের রক্ষণাবেক্ষণ লিপির সমাহার ছাড়া সম্ভব নয়। নতুন প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে, আধুনিক পৃথিবীর সমস্ত ধরনের মাধ্যমে বাঙালি জাতি যাতে তার নিজের ভাষা নিয়ে আত্মমর্যাদার সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে, সেটাই আমাদের লক্ষ্য এবং এই আদর্শেই ‘লিপিঘর’ তৈরি করে চলেছে নতুন লিপি। বাংলা ভাষার এ ঘরে আপনাকে স্বাগত।