সন্তানকে কোলে নিলে বঙ্গজ পিতাদের যে আত্মতৃপ্তি মুখমণ্ডলে প্রস্ফুটিত হয়, সেটাই নিজের শিবের কোলে গণেশ প্রতিমা নির্মাণে তুলে ধরেন রঞ্জন পাল। শিবের হাতে ত্রিশূল-ডমরু নেই। জটায় অর্ধচন্দ্র নেই। রঞ্জন পালের তৈরি শিব জগতের ঈশ্বর হতে চাননি। বাঙালি পিতার মতো তিনি বরাবরই অবসরে চেয়েছেন সন্তানের সঙ্গ। গণেশকে যদি সাপে কামড়ায় তাই নিজের গলায় সাপ রাখেননি। এখানে যত্নশীল বাঙালি পিতার মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। চোখের দৃষ্টি আক্রমণাত্মক নয়। তাঁর শরীরী ভাষায় নটরাজের মতো প্রলয় নৃত্যের চঞ্চলতা নেই। রয়েছে পিতৃত্বের আত্মতৃপ্তি।
বাঙালি নিজের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শিবের প্রতিমা নির্মাণ করে চলেছে। বাঙালির কাছে শিব একান্ত আপনজন মনের মানুষ। বাঙালির শিব নীলবর্ণ নয়। তাঁর শরীর পেশিবহুল নয়। মেদহীন চোয়াল তাঁর নেই। কৈলাসের ধ্যানমগ্ন রুক্ষতা তাঁর অভিব্যক্তিতে নেই। বাঙালি শিব ফরসা। জীবন যুদ্ধের প্রখর অভিজ্ঞতায় ভরা তাঁর মুখের অভিব্যক্তি। পিতৃত্বের বাৎসল্য রসে তাঁর হৃদয় ভরপুর। কর্তব্যপরায়ণ স্বামী রূপও পাই বাঙালি শিবের মধ্যে। কৃত্রিম মেধার এই যুগেও বাংলার শিল্পীরা বঙ্গজ শিবের সেই ভাবকে এখনও রক্ষা করে চলেছেন।
সন্তানকে কোলে নিলে বঙ্গজ পিতাদের যে আত্মতৃপ্তি মুখমণ্ডলে প্রস্ফুটিত হয়, সেটাই নিজের শিবের কোলে গণেশ প্রতিমা নির্মাণে তুলে ধরেন রঞ্জন পাল। শিবের হাতে ত্রিশূল-ডমরু নেই। জটায় অর্ধচন্দ্র নেই। রঞ্জন পালের তৈরি শিব জগতের ঈশ্বর হতে চাননি। বাঙালি পিতার মতো তিনি বরাবরই অবসরে চেয়েছেন সন্তানের সঙ্গ। গণেশকে যদি সাপে কামড়ায় তাই নিজের গলায় সাপ রাখেননি। এখানে যত্নশীল বাঙালি পিতার মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। চোখের দৃষ্টি আক্রমণাত্মক নয়। তাঁর শরীরী ভাষায় নটরাজের মতো প্রলয় নৃত্যের চঞ্চলতা নেই। রয়েছে পিতৃত্বের আত্মতৃপ্তি। স্নেহমাখা আবেশে ডান হাতে জড়িয়ে ধরেছেন নিজের সন্তানকে। চিরটাকাল জীবন সংগ্রামের তীব্রতম পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়েও বাঙালি পিতারা যেভাবে নিজের সন্তানের প্রতি স্নেহশীল থেকে যান জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, তারই প্রকাশ ঘটেছে রঞ্জন পালের তৈরি শিবের কোলে গণেশের প্রতিমায়। এখানে গণেশ বাধ্য শিশুর মতো পিতার কাঁধে মাথা রেখেছে। কিন্তু এই প্রতিমা গড়ে আর সংসার চলে না পূর্ব বর্ধমানের দাঁইহাটের পাতাইহাট পালপাড়ার শিল্পী রঞ্জন পালের। লক্ষ্মী, সরস্বতী, মনসার প্রতিমা, মাটির চায়ের ভাঁড়, মাটির হাড়ি নির্মাণ করে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন হয়, তার ওপর নির্ভর করেই সংসার চলে। পূর্বপুরুষের শিল্পধারাকে বজায় রাখতে চড়ক এবং উল্টোরথের মেলার জন্য পোড়ামাটির শিবের কোলে গণেশ নির্মাণ করেন তিনি। টালির আচ্ছাদন ও তিনদিকে মলিন বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি তার শিল্প সৃষ্টির সাধন কক্ষ। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়েও নিজের তুলির টানে মরমি শিবের অভিব্যক্তি সৃষ্টি করেন। তার এই প্রতিমার মধ্যে পূর্ব বঙ্গীয় শিল্পরীতির ভাব স্পষ্ট বলে মনে করেন লোকসংস্কৃতি গবেষক স্বপন ঠাকুর।
পদ্মাসনে বসে সাধনার নেশায় আত্মমগ্ন শিব। চোখের দৃষ্টি উন্মুক্ত থাকলেও মনোজগতে চলতে থাকা একাগ্র সাধনার চিন্তন বেরিয়ে আসছে চোখের মধ্যে দিয়ে। সাধনা করলেও শিব এখানে খর্বকায় নয়। গোঁফ থাকলেও বহু দিনের না কামানো অগোছালো দাড়ি নেই। তিনি বঙ্গজ পুরুষের মতোই মাঝবয়সি স্থূল। ত্রিশূল ও ডমরু নেই। সবুজ রঙের সাপ জড়িয়ে ধরেছে কণ্ঠ। জটায় অর্ধচন্দ্র নেই। মুখ গম্ভীর। এভাবেই নিজের শিবকে রচনা করেছেন কাটোয়ার মৃৎশিল্পী বেষ্ট পাল। অনেকটা একই ধরনের শৈলী লক্ষ করা যায় হুগলির জীবন পাল এবং শান্তিপুর মহাপ্রভু পাড়ার সুভাষ পালের তৈরি শিব প্রতিমার মধ্যে।
সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে প্রেমিকা যখন দূরে সরে যায় তখন বাংলার পুরুষের মনে বিরহ দেখা দেয়। সংসারের মধ্যে থেকেও তীব্র বিরহে তার মন অন্য দেশে পাড়ি দেয়। বিশ্ব সংসারে তৈরি করে দেওয়া যাবতীয় সাফল্যের মানদণ্ডের প্রতি তার তীব্র বিতৃষ্ণা দেখা দেয়। লক্ষ্যে পৌঁছানোর কোনো তাড়া নেই। জীবন যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধুই মনের গভীরে প্রিয় নারীর প্রতি আত্মিক টানের স্মৃতি রোমন্থন করে চলা। শিবের প্রতিমা নির্মাণে মনস্তত্ত্বের এই ভাবনাকেই অনবদ্য আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর মজিলপুরের শিল্পী শম্ভুনাথ দাস। সুদীর্ঘ আট প্রজন্ম ধরে শিবের এই অভিব্যক্তিকেই তুলে ধরে চলেছেন শম্ভুবাবুর পরিবার। শিল্পীর পূর্বপুরুষেরা যশোর জেলা থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর মজিলপুরে বসতি স্থাপন করেন। মূলত জমিদারের সন্তানদের জন্য মাটির খেলনা তৈরি দিয়ে মৃৎশিল্পের প্রতি তাদের বিজয়যাত্রা শুরু হয়। শিবের একাধিক অভিব্যক্তি সম্পন্ন প্রতিমা শম্ভুবাবুর পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নির্মাণ করে চলেছেন। কিন্তু তার মধ্যে শিবের এই নির্দিষ্ট অভিব্যক্তিসম্পন্ন প্রতিমাটি বাংলার ব্যর্থ প্রেমিকদের কথা বলে চলে। দেবতাদেরও দেবতা হওয়ার কোনও বাসনা এই শিবের নেই। ত্রিশূল, ডমরু, শিঙা ছেড়ে শিব নেশাতুর হয়ে সতীর কথা ভেবে চলেছেন। ধ্যানগম্ভীর সাধনায় তার মনোযোগ নেই। তাই বাঁ-হাতে মাটিতে ওপর ভর দিয়ে বসে উদাসী ভাবনায় বিভোর এই শিব। জয়নগর মজিলপুরের শিব ও অন্যান্য পুতুল নির্মাণের নির্দিষ্ট গঠন শৈলী রয়েছে। এই ঘরানার শিল্পকে বাংলার বুকে বাঁচিয়ে রেখেছেন শম্ভুনাথ দাস। তার তৈরি অপর একটি শিব মূর্তিতে দেখা যায় যে শিবের বাঁ-হাতে শিঙা এবং ডান হাতে লম্বা ও সরু ত্রিশূল। মুখে অনাবিল শান্তির হাসি। শম্ভুবাবু তৈরি এই শিবে অস্ত্রের থেকেও ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তাই ত্রিশূল সরু ও লম্বা।
শিব বসে আছেন নন্দীর ওপর। ডমরু ও শিঙা নেই। বাঁ হাতে রয়েছে কুমণ্ডল। অন্য হাতে রয়েছে ছোট একটি ত্রিশূল। শিবের গলায় হলুদ-রাঙা সাপ। জটায় অর্ধচন্দ্র নেই। মুখের শান্ত ভাব। বাঙালির গোয়ালঘরে থাকা গরুর মতই গোবেচারা নন্দীকে ফুটিয়ে তুলেছেন হুগলি জেলার চন্দননগরের মৃৎশিল্পী সুকুমার পাল। ছাঁচের কাঁচা মাটির রঙিন এই স্থল শিব প্রতিমাটি চড়কের সময় তৈরি করে থাকেন শিল্পী। নগরকেন্দ্রিক চন্দননগরে লোকজ এই শিল্পধারাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন মরমি শিল্পী সুকুমার পাল।
…………………………………………………………….
সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে প্রেমিকা যখন দূরে সরে যায় তখন বাংলার পুরুষের মনে বিরহ দেখা দেয়। সংসারের মধ্যে থেকেও তীব্র বিরহে তার মন অন্য দেশে পাড়ি দেয়। বিশ্ব সংসারে তৈরি করে দেওয়া যাবতীয় সাফল্যের মানদণ্ডের প্রতি তার তীব্র বিতৃষ্ণা দেখা দেয়। লক্ষ্যে পৌঁছানোর কোনো তাড়া নেই। জীবন যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। শুধুই মনের গভীরে প্রিয় নারীর প্রতি আত্মিক টানের স্মৃতি রোমন্থন করে চলা। শিবের প্রতিমা নির্মাণে মনস্তত্ত্বের এই ভাবনাকেই অনবদ্য আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর মজিলপুরের শিল্পী শম্ভুনাথ দাস। সুদীর্ঘ আট প্রজন্ম ধরে শিবের এই অভিব্যক্তিকেই তুলে ধরে চলেছেন শম্ভুবাবুর পরিবার।
…………………………………………………………….
সস্ত্রীক বঙ্গজ পুরুষের ভাব নিজের তৈরি হর-পার্বতী প্রতিমার মধ্যে তুলে ধরেছেন হাওড়া জেলা কুলগাছিয়া পটুয়াপাড়ার বর্ষীয়ান মৃৎশিল্পী গীতা চিত্রকর। পুত্র ভোলা এবং পুত্রবধূ ময়না চিত্রকরকে সঙ্গে নিয়ে রথযাত্রা সময় শিবের বিভিন্ন প্রতিমা নির্মাণ করে থাকেন গীতা চিত্রকর। এ ছাড়াও সেই সময় তিনি বিভিন্ন ধরনের মাটি পুতুলও তৈরি করে থাকেন। গীতা চিত্রকরের হর পার্বতী প্রতিমার মধ্যে শিবের হাতে ত্রিশূল, ডমরু এবং কুণ্ডল নেই। সহধর্মিনীকে নিয়ে জীবনের পথে চলার যে আনন্দ বাংলার পুরুষদের মনে থাকে সেটাই শিল্পী নিজের তুলির টানে ফুটিয়ে তুলেছেন।
সস্ত্রীক শিব ও সঙ্গে গণেশ। শিব বসে রয়েছেন স্বর্ণ সিংহাসনের ওপর। মাথার পেছনে চালি। বাঘছাল এখানে শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গের উত্তরীয় হয়ে রয়েছে। শিবের কোলে বসে রয়েছে গণেশ। শিব অন্য হাতে অভয় মুদ্রা দিচ্ছে ভক্তদের উদ্দেশে। শিবের থেকে কিছুটা নিচুতে নন্দীর ওপর বসে রয়েছেন দুর্গা। শিবের হাতে কোনও ত্রিশূল নেই। দাম্পত্য জীবনের এই ছবিকে নিজের শিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন কলকাতার মানিকতলা খালপার পটুয়াপাড়ার মৃৎশিল্পী কেষ্ট পাল। শিবরাত্রি ব্রতের সময় তিনি এই ধরনের প্রতিমা নির্মাণ করেন।
বাংলার সামাজিক পুতুলে শিবভক্তদের আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তিকে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবছর শ্রাবণ মাস এলে বাঙালি কাঁধে বাঁক নিয়ে পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল ফলক পেরিয়ে তারকেশ্বরে পৌঁছয়। তীর্থযাত্রীদের দৃঢ়চেতা অঙ্গীকারকে পুতুল নির্মাণশৈলীতে তুলে ধরেছেন বাংলার একাধিক শিল্পী। কাঁধে বাঁক নিয়ে শিবের মাথায় জল ঢালতে যাওয়ার দৃশ্যকে বাংলার যে সকল শিল্পী মাটির পুতুল নির্মাণের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন শ্রীরামপুর রাজ্যধরপুরের মনোজ পাল, বেলঘরিয়ার নিমতার আরতি পাল, কালীঘাট পটুয়াপাড়ার শেফালী চিত্রকর এবং ডলি চিত্রকর, শ্রীরামপুর মানিকতলার শম্পা চিত্রকর। আবার যে সকল নারী শিবরাত্রি ব্রত পালন করার জন্য শিবলিঙ্গের সামনে বসে পুজোর দেন তাদেরকেও পুতুল নির্মাণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন বেলঘরিয়ার নিমতার মৃৎশিল্পী আরতি পাল এবং শিশুরানি পাল। আবার বাংলার চার চালার শৈলীর ছোট শিবের মন্দির তৈরি করেন শ্রীরামপুর মানিকতলার মৃৎশিল্পী শম্পা চিত্রকর।
নবদ্বীপে বসন্তকালে বাসন্তী পুজোর বিজয়া দশমীর রাতে মা দুর্গার সঙ্গে মহাদেবের বিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় মহাদেবকে মুখোশ পরানো হয়। সেখান থেকেই শিবের মুখোশের প্রচলন শুরু। নদীয়া জেলার শুধুমাত্র নবদ্বীপেই শিবের মুখোশ তৈরির রীতি রয়েছে। নবদ্বীপের কমলা মোদকের তৈরি শিবের মুখোশের খ্যাতি রয়েছে। শিল্পী মাটির শিবলিঙ্গ তৈরি করে থাকেন। আবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার বরিয়ার চিত্রকর পাড়ার অধীর চিত্রকরও মাটির তৈরি শিবলিঙ্গ তৈরি করে থাকেন।
শিব বাঙালির আধ্যাত্মিক ও সামাজিক চেতনায় বারোমাস থাকেন। কখনও তিনি পিতা তো কখনও তিনি প্রেমিক, আবার কখনও হয়ে ওঠেন জীবনযুদ্ধে ক্রমাগত লড়ে যাওয়া মাঝ বয়সি বাঙালি পুরুষ। তার পেশিবহুল শরীর নেই। কিন্তু দৃঢ়চেতা মনোভাব তাকে অনবদ্য করে তোলে।
…………………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………………..