‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’-এর ভক্তকুলকে রজার ওয়াটার্স বলছেন, আমরা তোমাদের এন্টারটেন করতে আসিনি। আমরা অ্যাক্টিভিস্ট। আমরা জাগাতে এসেছি। সমস্তরকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর গান ঝলসে উঠছে। যদি দেখছেন গান পৌঁছচ্ছে না, নিজে পৌঁছে যাচ্ছেন রাস্তায়। আওয়াজ তুলছেন প্যালিস্তিনীদের পক্ষে, সিরিয়ায় শরণার্থীদের পক্ষে, ভারতে সিএএ-র বিরুদ্ধে গলা ফাটাতে গিয়ে গেয়ে উঠছেন আমির আজিজের কবিতা ‘সব ইয়াদ রাখখা জায়েগা’।
দীর্ঘ সাত বছর, ১৯৬০-’৬৬ জুড়ে, সদ্য কৈশোর না-পেরনো স্বাধীন দেশের একঝাঁক হাহাকার, বিদেশি আগ্রাসন, খাদ্য আন্দোলন, যুদ্ধ, নকশাল গণউত্থান, কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজন এবং হাংরি আন্দোলন, সর্বোপরি দেশভাগের না-শুকোনো ঘা নিয়ে লিখে চলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, যা আকার নেবে ১৯৬৭-তে ‘নিহিত পাতালছায়া’-য়। কাব্যগ্রন্থের অস্থি-মজ্জা ও অবকাশ জুড়ে কোন এক ডুবে যাওয়ার ভয়, অসহায়তার গ্লানি খেলা করে চলে, যা অদ্ভুতভাবে বাংলা ভাষায় লিখিত হলেও, কেবলই বঙ্গীয় নয়, বরং সর্বব্যাপী এক ত্রাসের আফটার-এফেক্ট হয়ে পূতবাষ্পের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে যে, অনুমান জাগে। এই অনুমান যে ভুল নয়, তা আরও স্পষ্ট হয় বইটির প্রকাশকাল ও তার সমকালীন বিশ্বের আচরণে খেয়াল রাখলে। কাছাকাছি সময়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্লান্তি, ক্ষয়ক্ষতির হয়রানি, প্রাণক্ষয়ের আত্মীয়-যন্ত্রণায় ভুগছে ব্রিটেন। স্কুলে, কলেজে হয়রান, আধপেটা, কম বয়সে সরল জীবনে আধুনিক সংগ্রামের ভার বইতে বইতে খিঁচড়ে ওঠা মেজাজ নিয়ে বাচ্চারা পড়াশোনা করছে কম, সহপাঠীকে অপদস্থ করছে বেশি। একইভাবে অপদস্থকারী বাচ্চাদের শাস্তি দেওয়ার র্যাগিংয়ে মেতে উঠছে শিক্ষকরা। হৃদ্যতা সেখানে সংখ্যালঘু। এরকমই বুলি, র্যাগিং, অপমান, অহেতুক শাস্তির ধাক্কা খেতে খেতে হয়রান হয়ে কেমব্রিজের রিজেন্ট স্ট্রিট পলিটেকনিক স্কুলে আর্কিটেকচার পড়ার জন্য মাথাটা গলিয়ে দিলেও, জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল ২০ বছরের জর্জ রজার ওয়াটার্স। নিতান্ত ছাপোষা স্কুলমাস্টার বাবাকে জোরজবরদস্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আর্মির চোগাচাপকান পরিয়ে বন্দুক ধরে নামিয়ে দেওয়া হলেও, তাঁর হাতে যে কলম চলে। যথারীতি, যুদ্ধে যাওয়ার ক’দিনের মাথায় মৃত্যু। সেই আঘাত রজার-কে পিছু ছাড়ে না। যুদ্ধ শুনলে প্রাণ ছটফটিয়ে ওঠে। তায় নতুন অ্যাটম বোমার প্রযুক্তিক আখ্যান, ঠান্ডা যুদ্ধের চাপানউতোরে হাত নিশপিশ করে তার।
কিন্তু, মাকে তার বাবা বলে দিয়ে গেছেন, ছেলেকে বোলো, রাগ যেন রক্তের দিকে ছুটে না যায়। রজারের হাত নিশপিশ করে তবু, সে ভাবে, জানে– রক্ত দিয়ে রক্ত থামানো যায় না। পড়াশোনা করে আর যাই হোক, যুদ্ধ থামানো যাবে না। যুদ্ধের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনও হাতিয়ারও নয়, বরং হৃদ্যতাই পারে সব ব্যথা মুছে দিতে। বিশ্বের দু’টি শক্তিশালী দেশ যখন মহাকাশ লুণ্ঠনের খেলায় ‘স্পেস ওয়ার’ নিয়ে ব্যস্ত, চাঁদকে ব্যতিব্যস্ত করতে তৎপর, তখন তরুণ রজার ভাবছে, স্পেস-কেই সে সুরের আকার দেবে, আর সেখানে বুনে দেবে গান, যা মাটির কাছাকাছি, যেখানে যাবতীয় সংবেদ ‘রিয়েল-ওয়ার্ল্ড’ কেন্দ্রিক, যেখানে উচ্চারিত হবে সেই ভয়ের কথা, যা মানবিক সংযোগকে রুদ্ধ করে রেখেছে। তাই, বাবার উত্তরাধিকারে কলম ধরল রজার, ধরল গান, বন্দুক ধরল না। প্রিয় বন্ধু সিড ব্যারেটের সঙ্গে, অনেকরকম গড্ডালিকা পেরিয়ে যখন তৈরি হচ্ছে ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’-এর প্রথম অ্যালবাম ‘দ্য পাইপার অ্যাট দ্য গেটস অফ ডন’ (১৯৬৭), সেখানের প্রথম গান ‘অ্যাস্ট্রনমি ডমাইন’-এ ব্যারেট ও ওয়াটার্সের কথা এমন– Lime and limpid green, a second scene/ A fight between the blue you once knew/ Floating down, the sound resounds/ Around the icy waters underground…
এই শীতল জলের ভিতরকার নৈঃশব্দ্য, এ কি ঠান্ডা যুদ্ধকে হেয়, এ কি সেই নিহিত পাতালছায়ার অবয়ব, যা বেদনাপ্রকাশের ছলে প্রতিবাদের ঝুঁটি নাড়িয়ে দেয় ‘বুড়িরা জটলা করে/ আগুনের পাড়ায়/ দু-ধারে আঁধার জল/ পাতাল নাড়ায়’?
এসব পেরিয়ে যতদিন যায়, ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’ তার ‘প্রগ্রেসিভ রক’ তকমা নিয়ে মানুষকে উন্মাদ করে ফেলছে, কিন্তু চোরাস্রোতে রজার ওয়াটার্স গানের লাইনে লাইনে, বিশ্বায়নের ভাঁওতাবাজিকে তুলে ধরছেন। তকমা দিচ্ছেন ‘মডার্ন হলোনেস’। রাস্তায় মানুষ পাশাপাশি হেঁটে যায়, তাকায়, কথা বলে না। কেউ কাউকে চেনে না। জানতেও চায় না। আর তারই ফায়দা লোটে রাষ্ট্রযন্ত্র, পুঁজিবাদ। তাঁরই লেখা ‘একোস’ গানের লাইনটি যেমন, ‘Strangers passing in the street/ By chance, two separate glances meet’. কিংবা বিখ্যাত গান ‘Money’? “Money, It’s a crime/ Share it fairly/ But don’t take a slice of my pie”. একইসঙ্গে বিরোধ এবং শ্লেষ। আবার নাগরিক হতাশাও ঝরে পড়ছে ‘Time’ গানে, “The time is gone, the song is over, thought I’d something more to say”.
কিন্তু, চুপ করে যাচ্ছেন আর কই? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আধুনিক বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিজম, জাতীয়তাবাদের বিষ, শরণার্থীর দুর্দশা, রাষ্ট্রযন্ত্রের হানাহানি, আবিশ্ব দারিদ্র, সামাজিক বৈষম্য, গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ– সমস্ত রকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর গান ঝলসে উঠছে, পিঙ্ক ফ্লয়েডের রকের মোড়কে। যদি দেখছেন গান পৌঁছচ্ছে না, নিজে পৌঁছে যাচ্ছেন রাস্তায়। আওয়াজ তুলছেন প্যালিস্তিনীদের পক্ষে, সিরিয়ায় শরণার্থীদের পক্ষে, ভারতে সিএএ-র বিরুদ্ধে গলা ফাটাতে গিয়ে গেয়ে উঠছেন আমির আজিজের কবিতা ‘সব ইয়াদ রাখখা জায়েগা’। পাশে দাঁড়াচ্ছেন রাশিয়ার, কারণ ‘নাটো’-র চুক্তি যে আদপে মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধি, তা বলতে একচুল দ্বিধা রাখছেন না তিনি। ব্রাজিলের ফ্যাসিস্ট প্রেসিডেন্ট বলসোনারো-কে উস্তুমখুস্তুমে ছাড়ছেন না। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ-কে উদ্দেশ্য করে রাস্তায় মিছিলে গাইছেন ‘উইশ ইউ ওয়্যার হিয়ার’। তালিকা অফুরান।
তাঁর ও তাঁর ব্যান্ড ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’-এর ভক্তকুলকে সরাসরি বলছেন, আমরা তোমাদের এন্টারটেন করতে আসিনি। আমরা এন্টারটেনার নই। আমরা অ্যাক্টিভিস্ট। আমরা জাগাতে এসেছি।
হয়ে গেল তো ৮০টা বছর বয়স। এত স্পর্ধা, এত সাহস আসে কোত্থেকে? একান্ত এক সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্নের বিপরীতে রজারের উত্তর– পাগল করে দেওয়া অর্থহীন এই দুনিয়ায় ভালবাসা আর হৃদ্যতা ছাড়া আছে কী মশাই! আরও বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও বাবার অকালে চলে যাওয়া, আর তারপর আমাদের সংসারের তছনছ অবস্থা আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই কোনওরকম যুদ্ধ, অসন্তোষ, হানাহানি আমাকে স্থির থাকতে দেয় না।
ক’জন আর আছে এই পৃথিবীতে, এত বেদনাকে গানের রূপ দেবে? নিহিত এই পাতালছায়ায়, জল কি আমাদের ব্যথা বোঝে না? ৮০ বছরের এই সদাজাগ্রত, চির সমকালীন তরুণ, রজার ওয়াটার্সের আজ জন্মদিন। তাঁর জলের মতো গান যেন আমাদের একটুও সঙ্গ না ছাড়ে। পৃথিবীর আয়ু হোক তাঁর।