বুদ্ধদেবের সঙ্গে আমার একটা মধুর মতবিরোধ ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ গল্পটা নিয়ে। বুদ্ধদেবের মতে, এটি অসাধারণ প্রেমের গল্প। কিন্তু তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের জীবন এবং নতুন বউঠানকে তিনি কোনওভাবেই টানতেন না। আর আমি বুদ্ধদেবকে ক্রমাগত বোঝাবার চেষ্টা করতাম এবং প্রতিবার তিনি আমার সমস্ত যুক্তি-তর্কের মুখের উপর সপাটে জানলা-দরজা বন্ধ করে দিতেন। মানতেন না, ‘নষ্টনীড়’-এর মতো গল্প হাওয়া থেকে আসে না, এ-গল্পের জন্যে ব্যক্তিগত তাড়না, বেদনা, বিধুরতার প্রয়োজন আছেই।
আমরা দু’জনেই উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের। শ্যামপুকুর লেনের (স্ট্রিটের নয়) আমি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রামধন মিত্র লেনের। আমাদের বারান্দা থেকে ওঁর বাড়ি দেখা যায়। আমরা একেবারে সম-সময়ের মানুষ। যাকে বলে কনটেম্পোরারি। তবে সমবয়সি নই। বুদ্ধদেব আমার থেকে তিন বছরের ছোট। কিন্তু চিরকাল আমার থেকে বেশি প্রজ্ঞাবান। বুদ্ধদেবের সঙ্গে কথা বললেই শেক্সপিয়রের একটি বিপুলবার্তা আমার স্মৃতিতে কপাট খুলে দাঁড়ায়: রাইপনেস্ ইজ অল্। সুপরিপক্কতাই সব।
সেই অর্থে শেক্সপিয়রের কোনও নায়কই সবদিক থেকে পরিণত মানুষ নয়। তাই তাদের পতনও অবশ্যম্ভাবী। বুদ্ধদেবের মধ্যে ছেলেবেলা থেকেই একটি নিটোল পরিপক্কতা দেখে অবাক হয়েছি। এটা বোধহয় এসেছিল দু’টি বিপরীত স্রোতের মিলন থেকে। একদিকে কার্ল মার্কস এবং ‘জন্মে শুনেছি একটি নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম।’ অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথ। সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ দুটি ধারা, বুদ্ধদেবের পরিণত মনে কলহহীন মিশ্রণের আরামে থিতু হতে পেরেছে।
রবীন্দ্রনাথ বলতে, বুদ্ধদেব প্রসঙ্গে দু’টি কথা মনে পড়ছে। বুদ্ধদেবের মনের মধ্যে একটি আস্ত গীতবিতান সব সময়ে সংরক্ষিত ছিল অব্যর্থ উদ্ধৃতির রঙের তাস নিয়ে। সে এক চমকপ্রদ ব্যাপার। একেবারে ঠিক লাইনটি ঠিক সময় ও জায়গায়, অপূর্ব অর্জুনদক্ষতায়। নারী মহলে বুদ্ধদেবের চিরদিনের প্রিয়তা, অন্তত আমার মনে হয়েছে, তাঁর স্মৃতির তূণে রবীন্দ্রসংগীতের পংক্তি। যে-কোনও সময়ে ভেদ করত চাঁদমারি। আমি যে কতবার হতবাক মুগ্ধতায় তাকিয়ে থেকেছি বুদ্ধদেবের দিকে।
রবীন্দ্রনাথ বলতে, আরও একটি-দু’টি কথা মনে পড়ছে, যা না বললে এই লেখারই কোনও মানে হয় না। অত ঢাকঢাক গুড়গুড় নিয়ে লিখে কী লাভ! বুদ্ধদেবের সঙ্গে আমার একটা মধুর মতবিরোধ ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ গল্পটা নিয়ে। বুদ্ধদেবের মতে, এটি অসাধারণ প্রেমের গল্প। কিন্তু তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের জীবন এবং নতুন বউঠানকে তিনি কোনওভাবেই টানতেন না। আর আমি বুদ্ধদেবকে ক্রমাগত বোঝাবার চেষ্টা করতাম এবং প্রতিবার তিনি আমার সমস্ত যুক্তি-তর্কের মুখের উপর সপাটে জানলা-দরজা বন্ধ করে দিতেন। মানতেন না, ‘নষ্টনীড়’-এর মতো গল্প হাওয়া থেকে আসে না, এ-গল্পের জন্যে ব্যক্তিগত তাড়না, বেদনা, বিধুরতার প্রয়োজন আছেই।
……………………………………………………………….
বুদ্ধদেবের বৈদগ্ধ্য এবং লেখাপড়ার বিস্তৃতি আমাকে বিস্মিত করেছে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের তিনি ছিলেন অপ্রতিম ভক্ত। ‘আনটিল অগাস্ট’– মার্কেসের শেষ বই, তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পরে প্রকাশিত, পড়বার পরে আমার প্রথম যে-মানুষটির কথা মনে এসেছে, তিনি অসুস্থ এবং প্রায় নির্বাসিত বুদ্ধদেব। যেতে ইচ্ছে হয়েছে তাঁর কাছে। কিন্তু যাইনি কোনওদিন। বুদ্ধদেবের সঙ্গে আমার ভাবনার পার্থক্য ওই ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড’-এ সাত বছরের বৃষ্টিটা নিয়েও। ওঁর এই বিষয়টা নিয়ে কোথাও একটা আপত্তি ছিল। ওটা মার্কেজের বাড়াবাড়ি– এমনই বোধহয় মনে করতেন বুদ্ধদেব।
……………………………………………………………….
এবার একদিন দুপুরবেলার কথা বলি। বুদ্ধদেব আর আমার জন্ম সিনেমা-থিয়েটার পাড়ায়– অর্থাৎ হাতিবাগানের মোড়ে। সেই সময়ে মুক্তি পেয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ গল্প থেকে তৈরি ছবি। যে-ছবিতে সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’র– জায়গায় অসীম দুঃসাহসে একটি পরিবর্তন এনেছিলেন: বিদেশিনীর জায়গায় ‘বউঠাকুরানি’! ম্যাটিনি শো-তে আমরা দু’জনেই একসঙ্গে ঢুকছি। বুদ্ধদেব-আমি মুখোমুখি। প্রশ্ন করলাম, কতবার দেখা হল? বুদ্ধদেবের উত্তর, তা ছ’-সাতবার। আমারও, বললাম আমি। বুদ্ধদেব অমল হেসে, ‘বউঠাকুরানির মায়ার টান।’ আমি বললাম, “গানে বিদেশিনীর জায়গায় ‘বউঠাকুরানি’। এ তো বিপ্লব!” বুদ্ধদেবের সেই সুভদ্র, বিদগ্ধ লাজুকতা আর পিঠে আলতো হাতরাখা– ভুলতে পারিনি আজও।
বহু বছর পরে আমি লিখলাম– ‘কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট।’ পাঠিয়েও দিলাম এক কপি। অসম্ভব ভদ্র মানুষ। তখন মুখ্যমন্ত্রী। প্রাপ্তি স্বীকার করলেন। উদ্বোধনে ডাকলাম। তার আগে কুকুর এসেও ঘুরে গেল। মুখ্যমন্ত্রী আসবার আগে পুলিশের কুকুর শুঁকে যায় সব ঠিক আছে কি না। সব নিশ্চয় ঠিক ছিল না। আমার অন্য বইয়ের উদ্বোধনে বুদ্ধদেব একাধিকবার এসেছেন। কিন্তু ‘কাদম্বরী’র উদ্বোধনে তাঁর বাঙ্ময় অনুপস্থিতি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে, এই বিষয়টি থেকে তিনি সচেতন দূরত্বে থাকতেই আরাম বোধ করছেন।
………………………………………..
আরও পড়ুন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-কে লেখা: শক্তির ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’ কবিতাটা প্রথম তাঁর পত্রিকায় ছাপিয়েছিলেন বুদ্ধদেবই
………………………………………..
আরও একটি বিষয়ে বুদ্ধদেবের সঙ্গে আমার ভাবনার তুমুল ফারাক। বুদ্ধদেবের বৈদগ্ধ্য এবং লেখাপড়ার বিস্তৃতি আমাকে বিস্মিত করেছে। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের তিনি ছিলেন অপ্রতিম ভক্ত। ‘আনটিল অগাস্ট’– মার্কেসের শেষ বই, তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পরে প্রকাশিত, পড়বার পরে আমার প্রথম যে-মানুষটির কথা মনে এসেছে, তিনি অসুস্থ এবং প্রায় নির্বাসিত বুদ্ধদেব। যেতে ইচ্ছে হয়েছে তাঁর কাছে। কিন্তু যাইনি কোনওদিন।
বুদ্ধদেবের সঙ্গে আমার ভাবনার পার্থক্য ওই ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড’-এ পাঁচ বছরের বৃষ্টিটা নিয়েও। ওঁর এই বিষয়টা নিয়ে কোথাও একটা আপত্তি ছিল। ওটা মার্কেজের বাড়াবাড়ি– এমনই বোধহয় মনে করতেন বুদ্ধদেব। আমার মতে, শৌভিক বাস্তবের মূল কথাই তো বাড়াবাড়ি। বুদ্ধদেব ক্রমাগত সিগারেট খাচ্ছেন নীরবে– এই একটি প্রশ্নের উৎকণ্ঠায়!
এমন বাঙালি আর দেখব না আমরা। অন্তত বাংলার রাজনীতিতে। শেষ মহিকান!
…………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………..