আমি এখনও বিশ্বাস করতে চাই, এটা সকল মানুষের বাংলাদেশ। এমন একটা সমাজের স্বপ্ন দেখি যে সমাজে কেবলমাত্র ধর্মের জন্য বিলুপ্তির আশঙ্কায় থাকবেন না কেউ। ধর্মপ্রাণতাকে কেউ এখানে বর্বরতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, সাম্যের বাংলাদেশ এখনও সম্ভব। গ্রাফিতিতে বলা হচ্ছিল বারবার, সুবোধ তুই পালিয়ে যা। না, সে পালাবে না। বরং, আক্রান্ত হওয়ার নিরবচ্ছিন্ন ভয়ের মৌলবাদী পরিবেশ না থাকে যাতে, সেজন্য তার সকল ধর্মের বন্ধুদের নিয়ে কাজ করবে। এবং, বাংলার আদিবাসীদের সঙ্গে একই লড়াই করবে। কেউই বন্ধুর পাশ ছাড়বে না।
১.
শ্রুতিতে, প্রচারে যে কোনও ঘটনার বিবর্ধিত চেহারা আমাদের সামনে আসতে পারে। আসা স্বাভাবিক। কোনও ঘটনা একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে কে, কেন, কীভাবে বিশ্লেষণ করছে– এই বিবেচনা অত্যন্ত জরুরি। এই লেখাটা লেখার সময় সামাজিক মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা, অনুবাদক, নাট্যকার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণ সংবাদ পেলাম। আমার অসীম রায়ের গল্প ‘আরম্ভের রাত’ মনে পড়ল। নন্দীগ্রাম সত্ত্বেও তাঁর জন্য মন খারাপ হল।
আজ বৃহস্পতিবার রাত আটটায় (বাংলাদেশ সময়) বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। এই লেখার পাঠকেরা জেনে গিয়েছেন এতক্ষণে, গত ৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়েছেন। তিনি প্রবল স্বৈরাচারের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বিরুদ্ধ মতের মানুষদের খুন করা, গুম করা আওয়ামি সরকারের নিত্যকর্ম ছিল। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া এই দলটি এইসব কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলন মাত্র ৩৫ দিনের মাথায় এক দফার হাসিনা বিদায় কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছিল। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সারাদেশ থেকে ঢাকা অভিমুখী লং মার্চের ডাক দিয়েছিলেন। ৫ আগস্ট আগের দিন সরকারি বাহিনীর হাতে এই আন্দোলন চলাকালে সর্বাধিক প্রাণহানি ঘটে। বিদ্রোহ দমনের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও ছাত্র-জনতার স্রোত রুখে দেওয়া যায়নি। এমনকী সেনাবাহিনী গণভবন ত্যাগের জন্য মাত্র ৪৫ মিনিট সময় বেঁধে দেয়। জাতির উদ্দেশ্যে সর্বশেষ ভাষণ দেওয়ার সুযোগ তিনি পেলেন না। মানুষের ক্রোধ থেকে বাঁচতে তিনি তাঁর কর্মী বাহিনীকে হতস্তব্ধ দশায় রেখে পালিয়ে গেলেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রাক্তন স্বৈরাচারী এরশাদ পতনের পরে দেশে থেকে পরিস্থিতি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিলেন, পালিয়ে যাননি, নিজের লোকদের ফেলে রেখে। তাঁর পলায়নের আগের দিন শেখ হাসিনার সুযোগ্য পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। তার মর্ম কথা হল– হিন্দু মাইনোরিটির ওপর বিএনপি (বাংলাদেশের ন্যাশনালিস্ট পার্টি), জামায়াতে ইসলামী (যুদ্ধাপরাধ করেছিল একাত্তরে, এখন নিষিদ্ধ) প্রবল নির্যাতন চালাচ্ছে। আমার পর্যবেক্ষণ, সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক নির্যাতন এই পোস্ট পরবর্তী ঘটনা।
বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রকৃত পরিস্থিতি কী– এই রচনায় আদিবাসীদের কথা তুলছি না। কেন-না, মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’ স্লোগানে তাদের অস্তিত্ব মুছে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে সেনা শাসন অব্যাহত। সে কথা আজ থাক।
২.
তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক। শুধুমাত্র লেখার জন্য বাংলাদেশের একাধিক মুক্তচিন্তকের মতো তিনি দেশের বাইরে নির্বাসনে। ‘লজ্জা’ উপন্যাসকে কেন্দ্র করে হয়েছেন অভিনন্দিত। সুদূরপ্রসারী পরিচিতি পেয়েছেন। আজ বলতে নেই ‘লজ্জা’ উপন্যাসের অধিকাংশ হিন্দু নির্যাতনের বিবরণ, অভিব্যক্তি অতিশয়োক্তিতে ভরা। আমার বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে, বাংলাদেশে সম্প্রদায়গত কারণে নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে না অথবা স্বাধীন হওয়ার পরে কোনও সরকারের আমলে বাংলাদেশের সংখ্যায় কম মানুষরা নিরাপদ ছিলেন। তিক্ত হলেও সত্য, বাংলাদেশে কখনওই সামগ্রিক অর্থে সনাতন-সহ অমুসলিম সম্প্রদায়ের সার্বিক নিরাপত্তা ছিল না। আমার আপত্তি অতিশয়োক্তি ও আতঙ্ক ছড়ানোয়।
আমি চাইছি না এটিও বলতে, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় নিয়মিত দেশ ত্যাগ করছেন না। করছেন, প্রতিনিয়তই করছেন। নিজেদের বসতভিটে ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছেন সীমান্তের অন্য পারে। অবস্থাপন্নরা চলে যাচ্ছেন সাগর পেরিয়ে আরও দূরে। এই নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি হিন্দু সম্প্রদায়ের অনন্তকাল। বেদনার হলেও সত্য, স্বাধীনতা লাভের ৫৩ বছর পরেও অমুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপদ স্বদেশ আমরা নির্মাণ করতে পারিনি।
তবে মানুষকে আতঙ্কিত করে যাদের লাভ, তাদের পক্ষ থেকে ছড়ানো গুজবের প্রসারও সত্য। বিশেষ করে, গ্রামে এবং মফস্সল শহরগুলোতে, সন্ধ্যা আর রাতের অন্ধকারে এই গুজবের ডালপালা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে বেশি সময় নেয় না। অনেকেই পুরনো সময়ের নির্যাতনের ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ভাগ করে নিয়ে মানুষের মধ্যে ভয় তৈরি করার কাজে লিপ্ত। একটা অতিসাম্প্রতিক ঘটনা কথা জানাই।
ফেসবুকে ছড়ানো এক ছোট ডিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু মানুষ একটা নদী পার হয়ে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন। মিনিট পঁচিশের ধারণকৃত দৃশ্যের অন্তর্গত বক্তব্য শুনলে পরিস্কার হয় যে, তাঁরা বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের একটি গ্রামের অধিবাসী। বিগত দিন দুয়েক দেশের বিভিন্ন জায়গায় মূলত আওয়ামি লিগের আর কোনও কোনও ক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়েই এই অসহয়ায় মানুষেরা দেশত্যাগী হতে যাত্রা করেছেন। বাকি কথা, এজেন্সি অফ ফ্রান্স প্রেস (এএফপি) বাংলাদেশের ফ্যাক্ট চেক এডিটর কদরুদ্দীন শিশিরের ফেসবুক পোস্টের সূত্রে জানা যাক– ‘মূল ঘটনাটি কী তা যাচাই করার জন্য আমি রাণীশংকৈলের ইউএনও রকিবুল হাসান, উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাধন বসাক, একটি পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধির সাথে কথা বলেছি। সাধন বসাক জানিয়েছেন, গ্রামটির নাম জগদল। সেখানে ৫ আগস্ট রাতে স্থানীয় ইউপি আওয়ামি লীগের সেক্রেটারি তাপসের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার ঘরের দেয়াল ছাড়া বাকি সব কিছু ভেঙে দিয়েছেন স্থানীয় বিএনপি-জামাতের কিছু কর্মী। পাশের আরেকটি বাড়িতেও আক্রমণ করে বেশ ক্ষয়ক্ষতি করেছে একই হামলাকারীরা। এতে এই পাড়ায় থাকা হিন্দু পরিবারগুলো আতঙ্কে ছিলেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আজ বুধবার সকাল ১১টার দিকে পাড়ার দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ শিশু নদী পাড়ি দিয়ে অদূরে ভারত সীমান্তে গিয়ে হাজির হোন। আমরা স্থানীয় কয়েকজন ইউএনওকে সাথে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে তিন দিনের মধ্যে হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ি নিয়ে আসি। ইউএনও রকিবুল হাসান বলেছেন, দুইটি বাড়িতে হামলার পর নিরাপত্তাহীনতায় উনারা ভারতে চলে যেতে চেয়েছেন। সীমান্তে বিজিবি আটকে দিলে আমরা গিয়ে নিয়ে আসি এবং বলেছি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে দোষীদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্থানীয় সাংবাদিক জানান, তাপস আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় কিছু ব্যক্তির ক্ষোভের শিকার হয়েছেন তিনি। হামলার সময় পাশের আরেকটি বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়। ফেসবুকে কিছু পোস্টে এই ঘটনায় ১৭ হাজার মানুষের ভারত সীমান্তে জড়ো হওয়ার কথা বলা হলেও তা সত্য নয়।’ উদ্ধৃতি দীর্ঘ হয়ে গেল কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি যে ১৫০ বা ২০০ মানুষ কেমন করে সতেরো হাজার হয়ে যাচ্ছেন। একেই আমি বলছি গুজবের ডালপালার প্রসার৷
৩.
আওয়ামি লিগের বয়ান ছিল, তারা যদি ক্ষমতায় না থাকে বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিচূর্ণ করবে। অমুসলিম সম্প্রদায়ের জীবনপ্রবাহ বিঘ্নিত করবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী, সমর্থকেরা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর মন্দির পাহারা দিচ্ছেন এলাকার মানুষদের সঙ্গে নিয়ে, রাতের পর রাত জেগে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আতঙ্ক যতটা প্রসারিত হচ্ছে প্রতিরোধের এই ঘটনা ততটুকু প্রচারিত হচ্ছে না। দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশে ইসলাম এবং প্রগতিশীলতা বিপরীতমুখী অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে অনেক মানুষের মনে। পরস্পরকে বিশ্বাসের বাতাবরণ বিনষ্ট। হিন্দু ও মুসলিম এই দু’টি সম্প্রদায় অবিভক্ত ভারতে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে সম্প্রীতিমূলক অবস্থানে থেকেছে। আমাদের চট্টগ্রামের একটি গল্প বলতে পারি। একবার, বহু বছর আগে, ইদ এবং দোল পূর্ণিমা একই দিনে হল। একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ইদের নামাজ পড়তে মসজিদে যাচ্ছিলেন সাদা পাঞ্জাবি পরে। যাওয়ার পথে হরিজন সম্প্রদায়ের বাচ্চারা পিচকিরিতে রং খেলছিলো। তাঁর সাদা পাঞ্জাবিতে সেই রং বিস্ফোরিত হলে তিনি বিন্দুমাত্র উত্তেজিত হননি। মৃদু হেসে, পাঞ্জাবি বদলে, উপাসনালয়ে চলে গেলেন। আমি এখনও বিশ্বাস করতে চাই, এটা সকল মানুষের বাংলাদেশ। এমন একটা সমাজের স্বপ্ন দেখি যে সমাজে কেবলমাত্র ধর্মের জন্য বিলুপ্তির আশঙ্কায় থাকবেন না কেউ। ধর্মপ্রাণতাকে কেউ এখানে বর্বরতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবেন না। পরস্পরে আস্থা ফিরে আসবে। হিন্দু ঘরবাড়ি পাহারা দিচ্ছেন ইসলাম ধর্মের মানুষেরা রাতের পর রাত। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, সাম্যের বাংলাদেশ এখনও সম্ভব। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহস নিয়ে দাঁড়াতে হবে। গ্রাফিতিতে বলা হচ্ছিল বারবার, সুবোধ তুই পালিয়ে যা। না, সে পালাবে না। বরং, আক্রান্ত হওয়ার নিরবচ্ছিন্ন ভয়ের মৌলবাদী পরিবেশ না থাকে যাতে, সেজন্য তার সকল ধর্মের বন্ধুদের নিয়ে কাজ করবে। এবং, বাংলার আদিবাসীদের সঙ্গে একই লড়াই করবে। কেউই বন্ধুর পাশ ছাড়বে না।
……………………………………………….
আরও পড়ুন বাংলাদেশ নিয়ে লেখা: নতুন বাংলাদেশ সরকারে মৌলবাদের স্থান নেই
………………………………………………..
ভারতীয় ও পশ্চিমা নানা প্রচারমাধ্যম এই মুহূর্তের (বিকেল চারটা) সরকাররহিত দেশকে অনিরাপদ বলে প্রচার করতে চায়। তাতে, অংশ নেওয়া ঠিক হবে না। কেননা, হিন্দু সম্প্রদায় বিলুপ্ত প্রজাতির সাদা গন্ডার হবে না। ফলে, পশ্চিমবঙ্গের স্বজনেরা আপনারা উদ্বিগ্ন হবেন না। সদ্য স্বৈরাচার উৎখাত করেছেন ছাত্রজনতা, আজ রাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে। আশা হারানো ঠিক হবে না। আরেকটু সময় দিন। আমি প্রবল আশাবাদী মানুষ। কেননা, উত্তরসত্যের বিস্মরণপ্রিয় পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতার আর ভয়ের সংস্কৃতির এই সময়ে আশাবাদ ছাড়া আমাদের কিছুই নেই। সর্বহারা হলে মার্কসের কাছে উদ্ধার বাসনা করা যাবে, সর্বস্বহারা হলে আমাদের সম্মিলিত অসুখের আরোগ্য থাকবে না।
জীবনের বাকি শাখা-প্রশাখা থেকে বাদুড়ের মতো ঝুলতে দেখা যায়, ‘অকৃতজ্ঞ’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘তঞ্চক’ নামের নানা কুটিল শব্দবন্ধকে। যারা উদর নয়, হৃদয়কে তাক করে। বারবার। যন্ত্রণার ক্ষেপণাস্ত্র চালিয়ে বুকের বাঁ দিকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে থাকে সুযোগ পেলে।