ওই সাগরটিলার ওপরের ঘরগুলোর মধ্যে রহস্য কিছু আছে। তিন চারজন তো এর-ওর আত্মীয় বলে ইদানীং ওখানে থাকছিল। রাহুল তল্লাশির সময় দুই মহিলা, একজন পুরুষের দেখা পায়নি। তারা নাকি জঙ্গলে পাতা কুড়োতে গিয়েছে। রাহুল বলে এসেছে, ফিরলেই যেন থানায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু কই, কেউ তো এল না। তাহলে কি ওদের মধ্যেই আছে সুনেত্রা আর বিষ্ণু? রাহুলের স্নায়ুতন্ত্রে বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে গেল হালকা করে। টিম পাঠাতে হবে সাগরটিলায়, আবার চাই তল্লাশি।
১৩.
খানিকটা অপ্রত্যাশিত হামলা। নিশ্চিন্তেই আসছিল কনভয়। বাঁশরীলাল, বিদ্যুৎ, এবং বেশ বড়সড় পুলিশবাহিনী।
খবর ছিল, কুসুমডিহা ঢোকার মুখে কিছু ক্ষোভ-বিক্ষোভ হতে পারে। তাও আবার আগের দিনের পুলিশি অভিযানের পর ভেস্তে যাওয়ার অনুমানই ছিল পাক্কা। ফলে হালকা মেজাজেই ছিলেন সবাই।
কুসুমডিহা থেকে ১০-১২ কিলোমিটার আগে তেলাপোতার জঙ্গল দিয়ে আসার সময় আচমকা রাস্তায় গাছ ফেলে অবরোধ। এমনিতেই রাস্তাটা একটু ফাঁকা। একেবারেই ঘন শালবন। দিনের বেলাতেও অন্ধকার। প্রবল শব্দে বোমা, এলোপাথাড়ি গুলি! পুলিশ প্রথমে খেই হারিয়ে ফেলেছিল। তারা পাল্টা গুলি চালাতে শুরু করার আগেই আক্রমণকারীদের অপারেশন শেষ এবং তারা পলাতক। যুদ্ধক্ষেত্রের ধ্বংসাবশেষের মতো চেহারা জায়গাটার, সঙ্গে আর্তনাদ।
বাঁশরীলাল নিহত। বিদ্যুত গুলিবিদ্ধ, তবে প্রাণ আছে। তিনজন পুলিশ নিহত। দু’জন জখম। এবং একগোছা লিফলেট পড়ে: ‘জনগণের শত্রুদের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।– কমরেড ব্রহ্মা।’
আরেকটি লিফলেটে লেখা: ‘শীতলা সোরেনের খুনিদের গ্রামে ঢুকতে দিচ্ছি না, দেব না।– কমরেড ব্রহ্মা।’
মুহূর্তের মধ্যে খবর ছড়াল। জখমদের নিয়ে পুলিশের একটা গাড়ি কোনওরকমে ঘুরিয়ে আবার ফিরে গিয়েছে। বিরাট ফোর্স ঘটনাস্থলে। জঙ্গলে চিরুনিতল্লাশি। ততক্ষণে সব ফাঁকা।
পর্ব ১২: থমথমে কুসুমডিহাতে টহল দিচ্ছে পুলিশ
কুসুমডিহা এ খবরে আবার থমথমে, কিন্তু খুশির হাওয়া। পুলিশি টহল শুরু। তল্লাশিও বাছাই বাড়িতে। মাধাই আর বিশেষ কয়েকজনকে নিয়ে বসছে রাহুল নিজে। কিন্তু মাধাইরাও তো অপারেশন সম্পর্কে অন্ধকারে।
কমরেড ব্রহ্মা যিনিই হোন, কুসুমডিহা সেলাম জানাচ্ছে তাঁকে। যখন সবাই ধরেই নিয়েছিল বাঁশরী আর বিদ্যুৎ আবার গ্রামে ফিরছে, তখন মাঝরাস্তায় এত বড় পাল্টা মার, কুসুমডিহা ভাবতে পারেনি! কমরেড ব্রহ্মা তাহলে যেখানেই থাকুন, কুসুমডিহার ওপর নজর রেখেছেন, এখানেও তাঁর প্রবল সোর্স।
বেশ কয়েকদফা জেরার পর রাহুল নিশ্চিত হয়েছে, মাধাইরা যত লম্ফঝম্ফই করুক না কেন, কমরেড ব্রহ্মাকে চেনে না, অপারেশনটাও জানত না। মাওবাদীদের সঙ্গে কিছু যোগাযোগ তাদের আছে। বিক্ষোভ দেখানোর নির্দেশ ছিল। তার মানে, কোর কমিটি মাধাইদের কাছেও সবটা বলে না। এদিকে, এত বড় ঘটনা, কিছু ধর-পাকড়ের চাপ আসছে। মিডিয়া প্রশ্ন তুলছে, পুলিশ করছেটা কী?
পর্ব ১১: ছদ্মপরিচয়ে কুসুমডিহাতে প্রবেশ পুলিশ ফোর্সের
রাহুলের আরেকটা সন্দেহ তীব্র হচ্ছে, সঙ্গে কিছুটা আফশোসও। ওই সাগরটিলার ওপরের ঘরগুলোর মধ্যে রহস্য কিছু আছে। তিন চারজন তো এর-ওর আত্মীয় বলে ইদানীং ওখানে থাকছিল। রাহুল তল্লাশির সময় দুই মহিলা, একজন পুরুষের দেখা পায়নি। তারা নাকি জঙ্গলে পাতা কুড়োতে গিয়েছে। রাহুল বলে এসেছে, ফিরলেই যেন থানায় গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু কই, কেউ তো এল না। তাহলে কি ওদের মধ্যেই আছে সুনেত্রা আর বিষ্ণু? রাহুলের স্নায়ুতন্ত্রে বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে গেল হালকা করে। টিম পাঠাতে হবে সাগরটিলায়, আবার চাই তল্লাশি। রাহুল ঠিক করল পল্টু রানারকে ডেকে আরেকবার ওপরের প্রতিটা ঘর সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। যাদের বাড়িতে আত্মীয় বলে ছিল ওরা, তাদের এখনই গ্রেপ্তার করা যায়, কিন্তু এরা দোষী কি না, নিশ্চিত না হয়ে গরিব মানুষগুলোকে ধরতে রাহুল চায় না। কারণ, সুনেত্রারা এত চতুর, নিজেদের আত্মীয় পরিজনদের এরা ব্যবহার করে, তাদেরও বুঝতে দেয় না আসল কাজকর্ম। শেল্টার হিসেবে ব্যবহার করে যায় নানা জায়গায়। বিপদে পড়ে পরিচিতরা। আরেকজনকে চা খেতে ডাকবে রাহুল। পোস্টমাস্টার সুমিত। শুনেছে ভিতু টাইপের লোক। কিন্তু দিব্য জনসংযোগ আছে। পড়িয়ে বেড়ায়, স্বাস্থ্যশিবির করে, এর ওর বাড়িতে ঘোরে, এমনকী, সাগরটিলাতেও যায়। ওর কাছ থেকে জানতে হবে চোখে লাগার মতো কিছু নজরে পড়েছে কি না। যদি কোনও কাজে লেগে যায়।
এদিকে বাঁশরীলালের মৃত্যু আর বিদ্যুৎ জখম হওয়ায় তাদের বাড়ির ওপর বড়সড় প্রভাব পড়ল। বিদ্যুৎকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হাসপাতালে। বাড়ির বাকিরাও কলকাতায়। এমতাবস্থায় দমদম সেন্ট্রাল জেলের বন্দিদের সঙ্গে বাড়ির লোকের সাক্ষাতের দিন দেখা গেল এক ব্যক্তিকে। ফর্ম ফিল আপ করে অপেক্ষায়।
( চলবে)
ততদিনে কলকাতা শহর থেকে ডি-গামা সাহেবের কেকের দোকান উঠে গিয়েছে। চিরতরে। ততদিনে কোকা-কোলা। জেমস বন্ড। সোভিয়েত ভেঙে রমরমে বিশ্বায়নের বাজার। ততদিনে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটাই বাজার এবং রাষ্ট্রের ঠেলায় আরও ভুলে যেতে যেতে, মার্জিনালাইজড হতে হতে, মিম অথবা ৩০ সেকেন্ডের কন্টেন্ট।