কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভালের বেশ কিছু কাজ করেছিলাম। পোস্টার, ব্রোশিওর। প্রথম যখন উৎসব শুরু হয়, তার পোস্টারের জন্য আর্থিক অনুদান দেয় ‘এন্ড্রি ইউল’। পরের দিকে, সরকারই সব খরচ বহন করত, তখন যদিও এত জাঁকজমক ছিল না, এত ফ্লেক্স, ব্যানার ছিল না। বেশ ছিমছাম সাজানো হত। বুদ্ধবাবু বেশ রুচিশীল ছিলেন এ ব্যাপারে। সবকিছুই খুঁটিয়ে দেখতেন। অনেক সময় কাটাতেন। উৎসবের শুরুর আগে থেকেই ছবি বাছাইতেও অংশ নিতেন।
এ লেখা, লিখতে, আমার প্রচণ্ড অনীহা। খুবই স্বাভাবিক। একজন প্রয়াত নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে, আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা লিখতে দ্বিধা হওয়ার কথা। খুবই সাধারণ একটা সম্পর্ক, তা নিয়ে তেমন কিছুই বলার থাকে না। কেন, কার পরামর্শে তিনি আমাকে নির্বাচন করেছিলেন, তা একটা রহস্য। আমাকে পছন্দ করার তেমন কোনও কারণই থাকতে পারে না। আমার পারিবারিক পরিচয়, আমার অতীত, এখানে কোনও ভূমিকা নেয়নি, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। তবুও ডাক আসে।
যারা পরবর্তীকালে, ওঁর মুখে, রক্ত মাখায়, ছবি আঁকে, দেওয়ালে টাঙায়, তারাই একসময়, ওঁর কোঁচার পিছন পিছন ঘুরেছে, সামান্য অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য, পেয়েছেও। আমি সে দলে কখনও নাম লেখাইনি। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতে পারে, মতবিরোধও হতে পারে, কিন্তু, আমরা কখনও সীমানা ছাড়াইনি। দীর্ঘ সময়, নানারকম কাজে একসঙ্গে যুক্ত থেকেছি। মূলত, আমাদের দেখা হত নন্দনে, উনি তখন দোতলায়, অংশু সুরের ঘরেই বসতেন। আমাদের কাজ চলত। কখনও কখনও বড় ঘরটায় গোল টেবিলে, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়– এঁদের উপস্থিতিতে। কোনও দিন, উঠে দাঁড়াতে হয়নি, উনি সেটা পছন্দ করতেন না। একবার বিশেষ একটা কাজে, ওঁরই কাজ, নন্দন চত্বরে ঢুকছি। তখনই ওঁর সাদা গাড়ি ঢুকল, চত্বরে, উনি নেমেই আমাকে দেখতে পেয়ে, কাছে ডাকলেন। আমি এগিয়ে যেতেই একসঙ্গে, কথা বলতে বলতে, লিফ্টের দিকে এগোলেন, একসঙ্গে উঠতে, ইশারা করলেন। আমরা তখন মাত্র দু’জন। শুনেছি মন্ত্রীদের কিছু প্রোটোকল থাকে। উনি সেটা ভাঙলেন কি না, জানি না। কোনও দিন সরকারি চাকরি করিনি। কাউকে কোনও দিন ‘স্যর’ বলিনি। তাই এই প্রোটোকলও জানি না। স্বভাবতই, লিফট খুলল, দোতলায়। দেখলাম, ওঁর সরকারি কর্মচারীরা দু’দিকে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। অভিবাদন জানানোর জন্য। আমি বেশ অপ্রস্তুত হলাম। তারও বেশি বিব্রত ও বিরক্ত। যাই হোক, আমরা কাজের ঘরে ঢুকে গেলাম।
এই সময়, নব্বই সালের মাঝামাঝি বা একটু আগে, তখনও উনি তথ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর, একটা অদৃশ্যবলয় ওঁকে হয়তো, ঘিরে রাখতে। তেমন যোগাযোগ ছিল না। আমিও দূরত্ব বজায় রেখেছিলাম। আগ বাড়িয়ে সখ্য সয় না, আমার স্বভাববিরুদ্ধ। তখন, নন্দনের দশম বার্ষিকী প্রতিষ্ঠা দিবস করার আয়োজন হয়। উনি, আমাকে বলেন, আপনি এখানে, এই দোতলায় হলে ঢোকার মুখে একটা প্রদর্শনী করুন। যা ছিল, ফিল্ম গ্রাফিক্সের বিশাল প্রদর্শনী, একমাস স্থায়ী হয়। স্বাভাবিকভাবেই সরকারি কর্মচারীরা নানা অশান্তি করতে থাকে। বিশেষ করে, আলো লাগানো নিয়ে। এই চত্বরে কোনও দিন কোনও প্রদর্শনী হয়নি, তখনও, আমি বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলাম। আমার পোস্টার, ইত্যাদি, বড় বড় ব্লো-আপ করে, দেখানো হয়েছিল। ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়ের পোস্টারের বিশাল প্রিন্ট রাখা হয়। মৃণাল সেন আক্ষেপ করেন। তাঁর কোনও মুখ রাখা হয়নি বলে। স্ত্রী গীতা সেন বলে ওঠেন, ‘হ্যাঁ, তোমারও রাখা উচিত ছিল, কারণ তুমি তো কবেই অস্ত গেছ।’ আমি মৃণালবাবুকে বলেছিলাম, আমরা গত হয়ে যাওয়া শিল্পীদের, পরিচালকদের রেখেছি। তখনই গীতা সেন ওই উক্তি করেন।
সেই সময়, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ত্রুফো দেখানো হয়। ওঁর মুখও ছিল। বুদ্ধবাবু প্রথমে মানতে চাননি, বলেন, ‘ত্রুফো তো বেঁচে আছেন। কী করে হবে?’ আমরা বোঝাই, না, ত্রুফো কিছুদিন আগেই গত হয়েছেন। সেবার ত্রুফোর পাশে, তারকভস্কিরও ছবিও ছিল। এই ফিল্ম গ্রাফিক্সের বিশাল প্রদর্শনী, যা বুদ্ধবাবুর অনুরোধে করি, তাঁর প্রতিক্রিয়া খুবই ভালো হয়। নানারকম ফিল্মের পোস্টার, ব্রোশিওর, টাইটেল কার্ড, প্রচ্ছদ, বেশ বড় সমারোহ। সব কাজই সরকার নষ্ট করে ফেলে। খরচ অবশ্য ওরা দিয়েছিল। কিন্তু খুবই মূল্যবান সংগ্রহ ছিল সেগুলো।
প্রথম যখন বুদ্ধবাবুর সঙ্গে আমার কাজ শুরু হয়, তা ছিল ওঁর সাহিত্যচর্চার নানা প্রকাশ। কবিতা নিয়ে কাজ করছেন, মায়াকভ্স্কি অনুবাদ করছেন। জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে দীর্ঘ লেখা বই হয়। ‘পত্র ভারতী’র ত্রিদিব প্রকাশ করে, ‘শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর’। দুটো প্রচ্ছদ বানাই। একটা উনি পছন্দ করেন, তারপর হয় ‘চিলিতে গোপনে’। একটা অনুবাদকর্ম। চিলির চলচ্চিত্র পরিচালক, যিনি পলাতক, আত্মগোপন করেছিলেন, তাঁর অভিজ্ঞতা। নামটা মনে পড়ছে না। বেশ বিখ্যাত লোক, এরপর কিছু নাটক লেখেন, ‘‘দে’জ’’ প্রকাশ করে। ‘দুটি নাটক’– এই নামে বই বেরয়। উনি সই করে আমাকে উপহার দেন। এখানে একটা মজার বিষয় আছে। বইটি পাওয়ার পর পড়তে গিয়ে দেখি একই ফর্মা দু’বার বাঁধাই করে, বইটি পুরো করা হয়েছে। এটা আর কাউকে জানায়নি। আজ লিখলাম।
কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভালের বেশ কিছু কাজ করেছিলাম। পোস্টার, ব্রোশিওর। প্রথম যখন উৎসব শুরু হয়, তার পোস্টারের জন্য আর্থিক অনুদান দেয় ‘এন্ড্রি ইউল’। পরের দিকে, সরকারই সব খরচ বহন করত, তখন যদিও এত জাঁকজমক ছিল না, এত ফ্লেক্স, ব্যানার ছিল না। বেশ ছিমছাম সাজানো হত। বুদ্ধবাবু বেশ রুচিশীল ছিলেন এ ব্যাপারে। সবকিছুই খুঁটিয়ে দেখতেন। অনেক সময় কাটাতেন। উৎসবের শুরুর আগে থেকেই ছবি বাছাইতেও অংশ নিতেন।
একবার সারারাত সমাপ্তি অনুষ্ঠান হয়, নন্দনে। জ্যোতিবাবু আসেন। মঞ্চে উঠে বলেন, এসব বুদ্ধ বোঝে, জানে। আমি এর কিছুই বুঝি না। উৎসবের সমাপ্তি ঘোষণা করে দিলাম, ব্যস।
এমনই ছিল সেই দিনকাল। পরে আমার সঙ্গে আর নন্দনের কোনও যোগাযোগ ছিল না। কোনও কাজই আমি আর করতে যাইনি। বিষয়টা অন্যদের হাতে চলে যায়।