বুদ্ধর উদার ও মুক্তবুদ্ধির পরিচয় আমরা সব সময়েই পেয়েছি। আমি বা আমরা বাংলা আকাদেমির নানা পুরস্কারে ও কাজে অনেক সময় এমন মানুষকে যুক্ত করতে চেয়েছি, যাঁরা বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচনা করেছেন, আদর্শগতভাবে ভিন্ন মত পোষণ করতেন। যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমরা রবীন্দ্র পুরস্কার দিয়েছিলাম, তা অনেক কট্টর বুদ্ধিজীবীর পছন্দ হয়নি, কারণ সুনীল একটি বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অম্লান দত্তকে বিদ্যাসাগর পুরস্কার দানও অনেকের অপছন্দ ছিল। কিন্তু বুদ্ধ আমাদের সবক্ষেত্রেই সমর্থন করেছিলেন।
মৃত্যু বয়স মানে না, সময়ও মানে না। আমার তুলনায় মৃত্যুর বয়স হয়নি তার। তবু বুদ্ধ এক যন্ত্রণাময় অসুস্থতাকে স্বীকার করে নিয়েছিল, তা থেকে, নিষ্ঠুর শোনালেও বলি, মৃত্যু এসে তাকে হয়তো মুক্তিই দিল। পশ্চিমবাংলার বৃহৎ জনক্ষেত্রে আমার এই অনাত্মীয় অনুজটি নানাভাবে বহু মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে, এগিয়ে দিয়েছে; আমার জীবনও তার কাছে বহুভাবে ঋণী। এই লেখা মূলত সেই ঋণস্বীকারের একটা খতিয়ান হিসেবে পাঠকদের কাছে রাখতে চাই। তাতে বুদ্ধদেবের মহত্ব বাড়বে কি না জানি না, কিন্তু আমার দিক থেকে কর্তব্য পালন ঘটবে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (১ মার্চ, ১৯৪৪-৮ আগস্ট, ২০২৪) পশ্চিমবাংলার রাজনীতি ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ও স্মরণীয় নাম, তার সাফল্য ও ব্যর্থতার ইতিবৃত্ত যাই হোক না কেন। এসব নিয়ে ইতিহাস তার চূড়ান্ত বিচার করবে। আমি শুধু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করব, তাতে নিশ্চয়ই বুদ্ধদেব মানুষটি ভিতরে-বাইরে কেমন ছিল, তাও কিছুটা প্রকাশিত হবে।
তাকে প্রথম দেখি সেই ১৯৬০ সালে, মেদিনীপুর শহরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের রাজ্য সম্মেলনে। স্কুলের শেষ দিককার ছাত্র, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা উজ্জ্বল চোখ। তার সঙ্গে এসেছিল একঝাঁক উজ্জ্বল তরুণ ছাত্র বিমান বসু, শ্যামল চক্রবর্তী প্রভৃতি। আমরা তখন ছাত্র ফেডারেশনের মাঝারি মাপের নেতা, আমরা সহজেই ওদের দাদা হয়ে যাই।
তার পরে পশ্চিমবাংলার রাজনীতি নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে যায়, তা সকলেরই জানা। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রাধান্য ভিতরে বাইরে দুর্বল হয়ে পড়ে, খাদ্য আন্দোলন ও অন্যান্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংক্ষিপ্ত যুক্তফ্রন্ট সরকার আসে এ রাজ্যে, তার পর সারা দেশে জরুরি অবস্থা ইত্যাদি কাটিয়ে ১৯৭৭ সালে দেশের রাজনীতিতে কংগ্রেসের সাময়িক বিলয় ঘটে, এবং পশ্চিম বাংলায় ৩৪ বছরের জন্য বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠা ঘটে। আমিও পরীক্ষা পাশ, অধ্যাপনার চাকরি, সংসার, বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও অধ্যাপনা ইত্যাদি সেরে ততদিনে দেশে ফিরেছি। ১৯৫৮ নাগাদ আমার অখণ্ড কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যতা অর্জিত হয়েছিল, কিন্তু পরে বিভাজিত কোনও পার্টিতে আমার যোগ দেওয়ার অবকাশ হয়নি। কিন্তু ১৯৭৮ নাগাদ বুদ্ধদেব আমাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নানা কাজে ও প্রকল্পে ডেকে নেয়। আমি যেহেতু ফুলব্রাইট পেয়ে আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী ছিলাম কিছুদিন, সেহেতু এ কাজে তাকে কোনও কোনও বঙ্গীয় প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সমালোচনাও করেন সে একজন সিআইএর লোককে প্রশ্রয় দিচ্ছে বলে। বুদ্ধদেব তা গ্রাহ্য করেননি। পরেও অন্যদের ক্ষেত্রে এমন ঘটবে।
ফলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অজস্র কমিটি ও কমিশনে আমি অধ্যক্ষ বা সদস্য হয়ে যাই, তার তালিকা দেওয়ার দরকার আছে বলে মনে করি না। তবু পশ্চিমবঙ্গে লোকসংস্কৃতির বিস্তার ও সমর্থনে নানা উদ্যোগ, প্রাথমিকের নানা পাঠ্যবই তৈরিতে, প্রাথমিকেই ইংরেজি কখন শুরু হবে তাই নিয়ে নানা বিতর্কে, স্কুলে ইংরেজি পাঠ্যবই তৈরিতে, সদ্য প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির নানা কাজে, অশোক মিত্রের শিক্ষা কমিশনে, প্রাথমিক শিক্ষায় ইংরেজি কখন শুরু হবে সেই কমিটির অধ্যক্ষতায়, অল্চিকি লিপিতে সাঁওতালি পড়ানোর কমিশনের অধ্যক্ষতায়, উচ্চশিক্ষায় ওবিসিদের স্থান নির্ধারণ কমিটিতে, এমনকী, রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের উপজাতি ভাষা কমিশনের অধ্যক্ষতায় আমার কাজ ছড়িয়ে পড়ে, তার পিছনে বুদ্ধদেবের প্রস্তাব আর প্রশ্রয় ছিল। এ-ও আমি জানি যে, ১৯৯০ সালে রবীন্দ্র ভারতীর উপাচার্য হিসেবে আমাকে স্থাপন করার প্রস্তাবও মূলত বুদ্ধদেবের কাছ থেকেই এসেছিল। আর ২০০৪-’০৫ সালে যখন আমার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেটের তকমা নিয়ে এখানকার একদল বুদ্ধিজীবী শোরগোল তোলেন, তখন বুদ্ধ চিনের প্রাচীরের মতো আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
কারণ আমি দেখেছি, যখন জ্যোতিবাবু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তখনও, বিশেষত শিক্ষা-সংস্কৃতির নানা বিষয়ে তিনি মূলত বুদ্ধদেবের ওপরেই নির্ভর করতেন। বলতেন, ‘ওসব বুদ্ধর ব্যাপার, ওর কাছে যান।’ আর এসব ব্যাপারে বুদ্ধর উদার ও মুক্তবুদ্ধির পরিচয় আমরা সব সময়েই পেয়েছি। আমি বা আমরা বাংলা আকাদেমির নানা পুরস্কারে ও কাজে অনেক সময় এমন মানুষকে যুক্ত করতে চেয়েছি, যাঁরা বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচনা করেছেন, আদর্শগতভাবে ভিন্ন মত পোষণ করতেন। যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমরা রবীন্দ্র পুরস্কার দিয়েছিলাম, তা অনেক কট্টর বুদ্ধিজীবীর পছন্দ হয়নি, কারণ সুনীল একটি বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অম্লান দত্তকে বিদ্যাসাগর পুরস্কার দানও অনেকের অপছন্দ ছিল। কিন্তু বুদ্ধ আমাদের সবক্ষেত্রেই সমর্থন করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির প্রথম সভাপতি অন্নদাশঙ্কর রায়ের মৃত্যুর (২০০২) আমরা আমাদের মাস্টারমশাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে সভাপতি করার প্রস্তাব নিয়ে বুদ্ধর কাছে যাই, বুদ্ধ আমাদের সংকল্পে সানন্দে সম্মতি জানায়। অসিতবাবু বামফ্রন্ট সরকারের ইংরেজি-নীতির কড়া সমালোচক ছিলেন। বুদ্ধর সমর্থনেই আমরা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে অসিতবাবুর পরে বাংলা আকাদেমির সভাপতি হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। তিনি আগে আমাদের নানা কমিটির সদস্য ছিলেন, বিশেষত বানান ও পরিভাষা কমিটির। তাঁর নামেও সুনীলের নামের মতোই কারও কারও আপত্তি ছিল।
বুদ্ধর মধ্যে একটি স্বপ্নদর্শী কবি ও লেখকসত্তা ছিল। সে দেশ ও বিদেশের কবিতার ব্যাপক পাঠক ছিল, নেরুদা, ব্রেশ্ট, মায়াকোভ্স্কি প্রভৃতির কবিতা অনুবাদ করেছে। জীবনান্দের কবিতার একটি তন্নিষ্ঠ সমালোচনা লিখেছে। নাট্যসংস্কৃতির প্রতি তার ছিল গভীর অনুরাগ, তার মৌলিক নাটক ‘দুঃসময়’, এক দুর্গত সময়ের প্রতি সার্থক সম্ভাষণ। আমেরিকার একাঙ্ক ‘ওয়েটিং ফর লেফ্টি’র সে একটি সার্থক অনুবাদ করেছিল। নানা বিখ্যাত দল ও পরিচালককে সে বাংলা নাটকের সার্থক প্রযোজনার জন্য সহায়তা দিয়েছে, সল্টলেকে জমিও দিয়েছে কোনও কোনও দলকে। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি তার আর এক কীর্তি। চলচ্চিত্রেও তার অনুরাগ ছিল খুব, ‘নন্দন’ তো তারই স্বপ্নের প্রতিরূপ। কবিতা ছিল তার প্রাণ, রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ ছিলেন তার দুই প্রিয় কবি। কাকা সুকান্তর কবিতা তাঁর কণ্ঠে মূর্ত হয়ে উঠত। সে কবিতা লিখেছে, নেরুদা, ব্রেশ্ট, মায়াকোভ্স্কির অনুবাদ করেছে, জীবনানন্দের ওপর চমৎকার একটি আলোচনাগ্রন্থ লিখেছে। মার্কেজের ভক্ত ছিল সে, তাই তাঁর উপন্যাস ‘চিলিতে গোপনে’, আর ‘বিপন্ন জাহাজে এক নাবিকের গল্প’ অনুবাদ করেছিল। তার ইতিহাস পর্যালোচনা ‘নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু’ আর চিনের মহাবিপ্লব নিয়ে ‘স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা’ শুধু পার্টিকর্মীদের নয়, সাধারণ পাঠককেও আকর্ষণ করবে। তেমনই তাঁর বামফ্রন্ট সরকারের নিজস্ব ইতিহাস ‘ফিরে দেখা’ দু’টি খণ্ড এক মহামূল্যবান সময়ের দলিল।
এমন মার্জিত, শিক্ষিত ও সজ্জন মুখ্যমন্ত্রী শুধু নয়, মানবিক মানুষও আমি কম দেখেছি।