বিমূর্ততা পৃথিবীকে সুন্দর করে, বাঁচিয়ে রাখে– বিশ্বাস করেন গণেশ হালুই। কীভাবে প্রথম তাঁর মধ্যে ঢুকে পড়েছিল বিমূর্তর ধারণা, জানিয়েছেন তিনি। জানিয়েছেন অজন্তা নিয়ে বহু শিল্পীর কাজে বহু ভুল থেকে গিয়েছে। সামান্য রাগ কি উপচে পড়েছে শিল্প-সমালোচকের প্রতি? তিনি ইদানীং স্ট্র দিয়ে চা খাচ্ছেন, এই ঘটনাটিও কি বিমূর্ত নয়? সমীর মণ্ডল, তাঁর ছাত্র ও শিল্পী– কথা বললেন গণেশ হালুইয়ের সঙ্গে। রোববার.ইন-এর জন্মদিনে, তাঁদের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনাও রইল।
কেমন আছেন গণেশদা?
ভালো নেই। শরীর খুব খারাপ। বেশ কিছুদিন হল পিঠের, কোমরের ব্যথা নিয়ে এমন কষ্টে আছি, শুয়ে শুয়ে দিন কাটছে। জানো, আমি শুয়ে শুয়ে খাবার খাচ্ছি, এমনকী, স্ট্র দিয়ে চা-ও খাচ্ছি।
শুয়ে শুয়ে কথা বলতে পারবেন ফোনে? আপনার শিল্পকর্ম বিষয়ে একটু কথা বলতে চাই, কথা বলবেন ?
ও বাবা, সে কী গো তোমার সঙ্গে কথা বলব না কেন? তোমার সঙ্গে কথা বলতে তো আমার ভালোই লাগে। শিল্প বিষয়ে গল্প করতেও আমার ভালো লাগে। বলব, যেটুকু পারি। শুয়ে শুয়ে কথা বলতে একটু হাঁপিয়ে যাই আজকাল। বার্ধক্য।
চিত্রকলায় মূর্ততা আর বিমূর্ততার আলোচনা-সমালোচনার অবসরে দেখি আপনার ছবিতে সবসময় শৈশবের স্মৃতি আর গ্রাম্য জীবনের প্রকৃতির রূপ। আপনি কী বলবেন?
দ্যাখো, এই মূর্ত থেকে বিমূর্ততায় যে আসা, সেটা তো একদিনে হয়নি, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফলেই এখানে এসেছি। ছেলেবেলায়, আমি ভীষণ একা একা ঘুরে বেড়াতাম আর আমাদের গ্রামে পূর্ব বাংলায়, ছিল একটা হাওড়। ‘হাওড়’ জানো তুমি?
হ্যাঁ জানি। আমি তো গ্রামের ছেলে। হাওড় মানে বিশাল জলাভূমি, না?
জলাভূমি, যেখানে প্রায় বারোমাসই জল থাকে। লম্বা লম্বা ঘাস গজায়। এরকম জায়গাতে আমি একা একা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতাম। একদিন এরকম ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। একটা জায়গায় এসে না, হঠাৎ একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। কী যেন সড়সড় করে সরে গেল। খসখস, কীসের যেন একটা আওয়াজ হল। চুপ করে নানা রকমের আওয়াজ শুনছি। কখনও ঝুপ্ আবার কখনও ধাম্। আমার না একটা ভীষণ ভয় ধরে গেল। পরবর্তী কালে ভেবেছি, এই পরিবেশটা যেমন দেখছি, সন্ধের আধো-অন্ধকারে যা কিছু আশপাশে দেখতে পাচ্ছি, সেটা যদি হুবহু আঁকি, আমি কি আমার ছবিতে এই ভয়টাকে ধরতে পারব? মনের মধ্যে ঠিক যে ঘটনা ঘটছে, সেটা আসলে কি ঠিক জিনিস? সেইটা জানার আগ্রহ বেড়ে গেল, মাথায় ঢুকে গেল। তখন থেকেই ভাবনাটা, বিমূর্ততার ধারণাটা শুরু হয়ে যায়।
সেটাই তো আমরা দেখলাম। আপনার পাখির চোখে দেখা নিসর্গ দৃশ্যের মধ্যে হঠাৎ বেড়ে ওঠা জলাভূমির ঘাস আর তার প্রতিবিম্ব, নির্দিষ্ট রেখায়। ঠিক বলছি?
হ্যাঁ, ওগুলো আঁকতাম, কিন্তু লোকের ভালো লাগত না। তখন খুব রিয়ালিস্টিক কাজ করার সময়। আসলে আমাদের এখানে একটু একটু করে ভাঙা, মানে যাকে বলে রিয়ালিস্টিক কাজ থেকে সরে গিয়ে কাজ করা শুরু হচ্ছে। সত্তরের গোড়া বা আরও একটু আগে। বেঙ্গল স্কুল থেকে সরে গিয়ে তখন একটা ইউরোপিয়ান আধুনিকতার শুরু বলতে পারো।
আচ্ছা গণেশদা, ওইটা আর একবার শুনি। কয়েকটা শব্দ আর একটা ভয়। একটা সাউন্ড ফর্ম। অন্যটা মানসিক প্রক্রিয়া– এই দুটো জিনিসকে আপনি ইমেজে মানে অবয়বে ধরতে চাইছেন। মূর্ততায়। কীভাবে সম্ভব?
আমি এগুলো লিখেছি অনেক, আগেও বলেছি। দেখো বলছি, এরকম…
মূর্ত বলে বিমূর্তকে ধ্যুৎ, তোকে দেখি না,
বিমূর্ত বলে মূর্ত ছাড়া আমি তো বাঁচি না।
মূর্ত বলছে বিমূর্তকে, তোকে তো চোখে দেখতে পাই না।
আর বিমূর্ত মূর্তকে বলছে যে, তোকে ছাড়া আমি কে? আমরা তো দু’জন দু’জনেরই অংশ।
সবই দরকার, বলছেন?
সবই দরকার। যেমন উপস্থিত আছে, অনুপস্থিত আছে। কাছে আছে দূরে আছে, দৃশ্য আছে অদৃশ্য আছে। ধরো, তুমি যখন একটা ফুল দেখছ তখন তার একটা রূপ আছে, রং আছে, গঠনের মধ্যে একটা ছন্দ আছে। যখন আলো আছে তখন বাইরের রূপ-রং যেমন দেখছ তেমনই ফুলের ভেতরে আবার অন্ধকার। এই ফুলটা দেখে আমার মনে যে অনুভূতি, আমি যা ভাবছি সেটা কিন্তু ভিসুয়াল নয়। ভাবছি, এই ফুলটা যদি আমি আমার প্রেমিকার খোঁপায় দিতাম, কিংবা এই ফুলটাকে আমি যদি ঠাকুরের পায়ে দিতাম। এই যে উপস্থিত, তাকে দেখছি এবং অনুপস্থিত তাকে তো দেখা যায় না, সে তো ভাবনার। কিন্তু তাকে তো বাধাও দেয়া যায় না। সেটাই হল কাব্য, সেটাই হল কবিতা। সেইটা হল রূপ আর অরূপ। ‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি, অরূপ রতন আশা করি’।
ফুলের সৌন্দর্য, ফুলের রূপ একদিকে, আবার ফুলটাকে বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করে তার একটা মানসিক অনুভূতি তৈরি হচ্ছে, এইটা পটে ধরব কীভাবে?
ধরা যায়, ধরা যায়। ধরার চেষ্টা করতে হয় আর সেইখানেই ডিসটর্শন আসে। তোমাকে আমি বলছি– এইসব ব্যাপারে আমার লেখাটেখা অনেক আগেই হয়ে গেছে। এখন আমি শুধু লজিক খুঁজছি। কেন এমনটা হয়? বলছি। আমার ছোটবেলায় আব্বাসউদ্দীন বলে একজন গায়ক ছিলেন। তোমার মনে আছে কি না জানি না, আব্বাসউদ্দীন ।
‘ফাঁদে পড়িয়া বগা কান্দে রে‘, ওঁর কথা বলছেন?
হ্যাঁ। পল্লিসংগীত গাইতেন, পল্লিসংগীত। একটা গান আছে যেখানে দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টিতে মাটিগুলো ফেটে ফেটে গেছে। ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। বৃষ্টির জন্য চারিদিকে হাহাকার। ‘আল্লাহ মেঘ দে’ বলে গানটা। কথাগুলো লক্ষ করো ভালো করে।
আসমান হইলো টুডা টুডা
জমিন হইলো ফাডা
মেঘ রাজা ঘুমাইয়া রইছে
মেঘ দিব তোর কেডা
আল্লাহ মেঘ দে…
উনি বলছেন, জমিন হইলো ফাডা ফাডা। ফাটাফাটা নয়, আর আকাশ টুডা টুডা । জমিটা ফাটে কিন্তু আকাশ টুকরো টুকরো হয় কখনও? মানে এতই খরা, অনাবৃষ্টির এতই হাহাকার যে আকাশটাও জমির মতো টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, এমন অনুভূতি। এইখানে অ্যাবস্ট্রাকশন। আমি তোমাকে একটা কথা বলি– আমরা, বাই অ্যাবস্ট্রাকশন, পৃথিবীকে আরও সুন্দর করি। যদি অ্যাবস্ট্রাকশন না থাকত তাহলে আমরা শুধু রিয়ালিটির জন্য দমবন্ধ হয়ে মরে যেতাম।
এই যে এতটা পথ চলে এসেছেন। পরিণত বয়সে দীর্ঘদিন পথ চলার পরেও আপনার শৈশবের, আপনার কৈশোর-যৌবনের সমস্ত স্মৃতি ছবিতে এখনও আসে কেন?
হ্যাঁ, আসে তবে অন্যরূপে আসে গো! কারণ সেটাই তো জগৎ। সেটাই আমার জগৎ, সমস্ত সৃষ্টিকর্তার, সৃষ্টিশীল মানুষের জগৎ। তুমি তোমার মত দেখছ, আরেকজন অন্যভাবে দেখছে। রবীন্দ্রনাথ দেখছেন তাঁর জগৎকে অন্যভাবে। নজরুল, জীবনানন্দ, সত্যজিৎ, জসীমউদ্দীন দেখছেন আর একভাবে। সবারই জগৎ আলাদা। নিজের তৈরি করা সবার নিভৃত জগৎ থাকে। তোমার জগতের সঙ্গে তোমার মায়ের, বাবার,ভাই-বোনের জগৎ মিলবে না। এটা কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সবার আলাদা আলাদা তৈরি হতে থাকে। তোমার আত্মীয়রা তোমাকে সহানুভূতি দেখাতে পারে কিন্তু তাদের মনের জগৎকে তোমার মনের জগতের সঙ্গে কোনও দিন শেয়ার করতে পারে না। সেই জগৎ তো কবিতার, সেই জগৎ দিয়েই ছবি আঁকা হয়।
গণেশদা, আমরা একটু বৃহত্তর জগতে যাই। আপনার অজন্তার কাজের সম্প্রতি প্রকাশিত বিশাল বইটা আমার টেবিলে, চোখের সামনে। আমাদের এতদিনের দেখা অজন্তার নানান কাহিনি এবং দেশি-বিদেশি ছবির বই থাকতে এই বইখানি কেন আলাদা?
কী অসম্ভব পরিশ্রম করেছি, সেটা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না সমীর। আর ওই বইটাতে যা কিছু আছে তার অধিকাংশই আসলে অজন্তায় গিয়ে কিন্তু লোকেরা দেখে না। যেগুলো কেউ দেখেনি সেই কথাই আমি বইতে এনেছি। অজন্তার ওপর অনেক বই লিখেছে লোকে ছবি দিয়ে দিয়ে। ওইসব বই লেখার কোনও মানে হয় না, সে তো অজন্তা দেখলেই হয়। আমি যেগুলোকে নিয়ে এই কাজটা করেছি সাধারণ মানুষ, দর্শক নোটিস করে না। তাছাড়া বিভিন্ন শিল্পীরা ভিন্ন সময়ে অজন্তার ছবি যে কপি করেছে, তাতে অনেক ভুলভ্রান্তি আছে। আর সেগুলোই সাধারণত বইতে ছাপা হয়। কারণ, বইতে ছবির কপি থেকেই ছাপা হয়েছে বেশি, ফোটোগ্রাফ থেকে নয়। কোথায় কোথায় ভুল সেগুলোকে ছবি সমেত আলোচনা করা হয়েছে বইটাতে।
হ্যাঁ দেখছিলাম, বিভিন্ন শিল্পীর কপিতে নানা রকম ভুল। এক জায়গায় দেখলাম রাহুলের হাতে একটি ভিক্ষাপাত্র আঙুলের মুদ্রাতে সেটা বোঝা যায় কিন্তু মাঝখানে ভিক্ষাপাত্রটাই হাওয়া। এরকমই বলতে চাইছিলেন?
এরকম অনেক। তারপর ধরো, আই বল। চোখের মণির পজিশন। চোখের দৃষ্টি যেদিকে, সেদিকে তো চোখের মণি ঘুরবে, না কি? সেইটা একই ছবির কপি করতে গিয়ে বিভিন্ন শিল্পী আলাদা আলাদা করেছেন। আই বল কারও উপরের দিকে, কেউ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কেন এটা হবে? যেখানে সন্ন্যাসী মাকে বলছে, তোমার ছেলে রাজা হবে না, সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। মা যখন এটা শুনবে, তার একটা অভিব্যক্তি হবে। সেখানে যথাযথ হাতের মুদ্রা, মুখে চিন্তার চিহ্ন। ছেলে সন্ন্যাসী হয়ে যাবে শুনে মায়ের মুখের ভঙ্গিমা কী হবে, সেটা তো শিল্পীর কাজ, শিল্পী দেখাবে সেই চিন্তাটুকু। আসল ছবিতে সেই অনুভূতি, অভিব্যক্তি ছিল, কিন্তু সেইটা যখন কপি করছে অন্যরা তখন পাল্টে দিচ্ছে, আই বল পাল্টে যাচ্ছে। অভিব্যক্তি পাল্টে যাচ্ছে। গল্পকার গল্প বলে গিয়েছে, কিন্তু মায়ের মুখের, চোখের ভঙ্গি তো শিল্পীর দায়িত্বে।
হ্যাঁ, বইটাতে দেখছি আপনি চোখ সম্পর্কে যেখানে বলছেন সেখানে আলাদা আলাদা ড্রয়িং করে দেখিয়েই বলেছেন। আরেকটা ছবিতে জলে ভেজা ফুল দিয়ে রানির পায়ের পরিচর্যায়, ফুলের জায়গায় আধুনিক তোয়ালে করে দিয়েছে অনেকে। সেটা বলবেন?
এই বিশাল কাজটার মধ্যে ওইটাই তো আসল কাজ, মানে এই যে নিখুঁতভাবে দেখা, এই যে ভুল করছে লোকে বুঝতে পারছে না। সারা বছর কাজ করে যাচ্ছে। আমি কী করেছি, এই সবগুলোই শুধু খুঁটিনাটি ড্রয়িং করিনি, খুঁটিয়ে দেখেছি, ভেবেছি। তুমি যেটা বলছিলে, একটা ছবিতে রানি বিশাল গজদন্ত দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়। সেইখানে তাঁর পরিচর্যা করতে গিয়ে পরিচারিকা পা ধুয়ে দিচ্ছে ঠান্ডা জল দিয়ে। আর দিচ্ছে পাশের পাত্রের জলে ভিজিয়ে নেওয়া একটি পদ্মফুলের সাহায্যে। সেটাকে তোয়ালে করে দিয়েছে। আসলে হাতে ধরা ফুলটির বৃন্ত ছিল আঙুলে ধরা আর ফুলের মুখটা নিচের দিকে। আকারটা অনেকটা পিরামিডের মতো ছিল। অস্পষ্ট ছবিতে সেটা বুঝতে পারেনি। তাই বলে তোয়ালে? আগেকার দিনে আমাদের সমাজে অনেক সময় মেয়েরা তাদের চুল ভিজিয়ে সেই চুল দিয়ে স্বামীর পা পরিষ্কার করে দিত। তুমি জানো?
আহা! কিন্তু এই যে ভুল করেছিলেন অন্য শিল্পীরা, এটা কীসের জন্য? এটা কি কুঁড়েমি না ফাঁকিবাজি, না কি বুঝতে পারেননি?
আরে ফাঁকিবাজি ফাঁকিবাজি! বুঝতেও পারেনি, কাজ করতে হয় করত। তবে সবসময় দোষ দেওয়াও যায় না। অজন্তা গুহার মধ্যে আলো একটা ভীষণ সমস্যা। নন্দলালবাবু যখন কাজ করতেন তখন তো ওঁরা পেট্রোম্যাক্স জ্বেলে কাজ করেছেন। আমরা লাকি। আমি যখন কাজ করি তখন ইলেকট্রিকের আলো পেয়েছি। তাছাড়া ছবির অনেকাংশ অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। রং চটে যাওয়া, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়াও একটা সমস্যা।
আচ্ছা গণেশদা, এই যে অজন্তার এত গল্প এত অলংকরণ, এত দৃশ্য, আকার, আয়োজন, এত কিছুর মধ্যে থেকে আপনার বিমূর্ততা বোধ এল কী করে?
ওই কাজ দেখেই তো এসেছে। কাজের আগেই কিছু বইপত্র কিনে আমি পড়তে শুরু করেছিলাম এবং ওদের যে আখ্যান, সেই ব্যাখ্যা তো আমার কাছে ম্যাজিকের মতো লাগল। আসলে আমি তো শুধু শুধু চাকরি করিনি। আমি বুদ্ধ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে বুদ্ধিস্ট ফিলজফির মধ্যে ঢুকে গেলাম। শোনো, রবীন্দ্রনাথের কথায় যদি বলি, তাহলে তুমি বুঝতে পারবে। উনি বলছেন, ‘সীমার মাঝে অসীম’, মানেটা কী? তারপর আগেই বলেছি– ‘রূপসাগরে ডুব দিয়েছি অরূপরতন আশা করি’। মানেটা কী? এটাই হচ্ছে অ্যাবস্ট্রাকশন। এই যে রূপের মধ্যে অরূপকে খুঁজছি। এই যে খুঁজে বেড়ানো, সেটাই আসল। খুঁজতে খুঁজতে তুমি নানা কিছু যে পাবে সেগুলোই তোমার নিজস্ব জ্ঞান, নিজস্ব অনুভূতি। চেষ্টা করবে তার প্রয়োগ তুমি যদি করতে পারো।
অজন্তা পর্বের পরে কলকাতায় ফিরলেন। ঋষির মতো আশ্রমিক জীবন থেকে, বুদ্ধ সান্নিধ্যের ঘোর কাটিয়ে, পাহাড়-জঙ্গল থেকে একেবারে অতি আধুনিক শহর জীবন। এই কথাগুলো গণেশদা আপনি কলেজে ছাত্রদের সঙ্গে কখনও বলেছেন? যেখানে সবার ধারণা, কলেজে কিছুই শেখার নেই, শিক্ষকরা কিছুই বলেন না। এটা কি সত্যি?
আমি বলি। আমি আসলে তখন জোর দিতাম না কিন্তু এখনও বলি। ধরো, তুমি যদি কিছু সৃষ্টি করো, সৃষ্টির মধ্যে তো কোনও ফাঁক নেই, কোন মিথ্যা নেই। কোন মিথ্যার জায়গাই নেই। তুমি একদিন ধরো বাসে করে যাচ্ছ, কন্ডাক্টর পয়সা নিতে ভুলে গেছে এবং তুমিও পয়সাটা না দিয়ে নেবে গেলে। অথচ তুমি জানো কখনও না কখনও ধরা পড়বে। এটা আমি এমনি বলছি আর কী। আসলে আমি এগুলো ভাবি বলেই বলছি। আমার মনে হয়, তোমার কাজের মধ্যে এই মানসিকতার ছাপ পড়ে।
আমরা ভাগ্যবান, আপনাকে পেলাম। এই শিক্ষকতার কাজটা আপনার কাছে কি একটা অন্যরকম মাপা নিয়মের মনে হল?
আমি যখন অজন্তা থেকে ফিরে এলাম তখন প্রথমে কলকাতায় বাঙুর অ্যাভেনিউতে একটা স্কুল করেছিলাম বাচ্চাদের। ছোট ছোট কয়েকজন, আমাদের বাড়ি থেকে আমার নিজের মেয়ে, পাড়ার ছেলে-মেয়ে এইরকম। পরে অবশ্য বাড়তে থাকল। তখন পয়সা নিতাম না, এমনি করতাম সময় কাটানোর জন্য। আর বাচ্চাদের সঙ্গে থাকতে ভালো লাগত বলে। আমি বৈঠকখানা বাজার থেকে কাগজ কিনে এনে কেটে কেটে দিতাম আর শ্যামবাজার থেকে পাউডার কালার এনে সেইটাই বাটিতে গুলে দিতাম।
এখনও আছে অনেক আঁকার স্কুল। ছোটদের শিক্ষার ব্যাপারে সেগুলো কি কাজের?
আর্ট কলেজে শিখে এসে তো বাচ্চাদের শেখানো যাবে না। তাদের চাইল্ড সাইকোলজিটা তো স্টাডি করতে হবে। যখন একটা বাচ্চা আট বছরের, দশ বছরের হয়ে যায় তখন তাদের মনে একটা প্রশ্ন এসে যায় যে, স্যর, এই গরুটা আমার গরুর মতো হচ্ছে না, বাঘটা বাঘের মতো হচ্ছে না। এটা তার চেয়ে ছোটরা কখনও বলবে না। একটা কথা বলতেন যামিনী রায়, আমার খুব ভালো লাগে। ওঁর ছবি দেখে একজন এসে বলল, আপনি এই যে গাছ এঁকেছেন, ওটা কিন্তু গাছের মতো হয়নি। তখন যামিনী রায় বললেন– আপনি ‘গাছ’ বললেন তো? বাঘ বলেননি। আমি আসলে ওটাই এঁকেছি।
শিশুর মতো সরল, না?
বোঝো। তোমাকে আমি আর একটা কথা বলছি, মানে এই যার জন্য এত কথা। ছোটদের একজনকে ফুটবল খেলা আঁকতে দেওয়া হয়েছে। তা একটা ছেলে দুটো ফুটবল এঁকেছে। মাস্টারমশাই তাকে জিজ্ঞেস করল যে, দুটো ফুটবল কেন? ছাত্রটি বলল, কিক মারার পর ফুটবলের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছানো বোঝাতে দু’দিকে ফুটবল। এখানেই হচ্ছে রিয়ালিটি আর রিয়ালাইজেশন। বাস্তব আর অবাস্তব। গাড়ির জন্য যেমন একটা আয়তক্ষেত্র আঁকে আর তার একই দিকে গুনে গুনে চারটে চাকা কিংবা একটি মাছ তার এক পিঠেই দুটো চোখ। এই যে সত্য, এখানে কোনও আড়াল নেই। এইটা আলোচনা করতে গিয়ে একধাপ এগিয়ে আমি অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ উত্তর দিতে পারেনি। প্রশ্নটা ছিল, যখন মানুষ আঁকে তখন তার ফ্রন্ট ভিউ আঁকে, প্রোফাইল নয়। সাইড থেকে নয়। আর যখন গরু, তখন প্রোফাইল। কেন?
কেন?
মানুষ আঁকে যখন তখন ফ্রন্টাল আঁকে, তার কারণ মানুষকে সামনাসামনি দেখে সেই একটা কারণ আর মানুষ ভার্টিকাল। মানে মানুষের মাথা থেকে পা, ওপর থেকে নিচে। গরু কিন্তু হরাইজন্টাল। গরুর মুন্ডু থেকে লেজ পর্যন্ত হরাইজন্টাল। তাই প্রোফাইল আঁকে। একটা পাখি কিন্তু হরাইজন্টাল।
রঙের কথায় আসি। রং আর রেখার মধ্যে কি বিরোধ আছে?
না। দুই-এ মিলে বরং একটা ছন্দ তৈরি হয়। আমি না অনেক ভাবতাম জানো? আসলে বই পড়ে কোনও জ্ঞান হয় না। রংয়ের ব্যাপারে দেখবে, যে ছবিতে খুব উজ্জ্বল রং আছে, নানা রকম রং আছে, সে ছবি সাধারণ মানুষ খুব পছন্দ করে। আবার যে ছবিতে খুব কম রং অল্প রং আছে, সেগুলো দেখবে সাত্ত্বিক লোকেরা পছন্দ করে। যে ছবিতে গল্প আছে, ডিজাইন বেশি আছে, অলংকরণ বেশি আছে সেটা মেয়েরা বেশি পছন্দ করে।
শুরুতে আপনার জলরঙের ছবিতে রংটা অনেক বেশি ছিল, রেখা কম। এখন রেখা বেড়ে গেছে রং কমে গেছে আপনার কি মনে হয়?
যখন রিয়ালিস্টিক ছবি আঁকতাম তখন একরকমভাবে রং ব্যবহার করেছি। আমি অত কিছু ভাবতাম না তখন। আসলে তখন জলরঙে কত কম সময়ে একটা ছবি এঁকে ফেলা যায়, সেইটাই জলরঙের কাজ ভাবতাম। তুমি তো জলরঙে কাজ করো, তুমি জানো। অল্পসময়ে একটি ছবি তৈরি করে ফেলা এবং চমৎকার লাগে লোকেদের, এই ব্যাপারটাই মাথায় ছিল। এখন আমি যদি রেখার সাহায্যে কোনও একটা আকার তৈরি করি, মানে আমি যদি একটা আপেলের আকার করি, তাহলে কিন্তু ওই আকারটা থেকেই রং এসে যায় মানুষের মনে। আমরা জেনেছি যে দীর্ঘদিনের পরিচিত জিনিসের আকারের সঙ্গেই রং আসে।
আর রেখা? রেখা নিয়ে একটু বলুন।
রেখা হচ্ছে কী জানো, এই ধরো তুমি আমার বাড়ি থেকে তোমার বাড়িতে যাচ্ছ, এই যে পথ দিয়ে যাচ্ছ এটা কিন্তু একটা রেখা। আবার ধরো, আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামলে তখন রেখা সিঁড়ির মতো হবে সরলরেখায় রাস্তায় চললে, উঁচু-নিচু জমি পেরলে, নদী পেরলে ঢেউ খেলানো রেখায়। ঘুরে আবার যখন বাড়ি ফিরলে এই পুরোটা একটা রেখা দিয়েই কিন্তু চিহ্নিত হল তোমার গতিপথ। শিল্প-শাস্ত্র যদি পড়ো দেখবে এগুলো সব আগে বলা হয়েই গেছে। এখন ছবিতে রেখার প্লেসমেন্ট ঠিকমতো না হলে, এগুলো সব জড়ো করা জঞ্জাল মনে হবে, রিদমিক হবে না। রিদ্ম হারিয়ে গেলে ঠিক মতো ছন্দ হারিয়ে গেলে এগুলোকে কিন্তু জঞ্জাল মনে হবে।
আপনার এই যে লাইনগুলো এবং ফর্মগুলোর মাঝে মাঝে খালি জায়গা থাকে, সেখানে কেমন হাওয়া বাতাস খেলে, মানে দমবন্ধ হওয়া ব্যাপার হয় না। এই স্বচ্ছন্দ ভাবটা আনেন কীভাবে?
নাটকের স্পেস ভাবো। মঞ্চে একটা জিনিস রাখা রইল একটা কোনায়, অন্য কোনও প্রপ রাখা রইল দূরে। আর একটা কোনও লাইন কোথাও বা একটু আলো। এখানে একটার সঙ্গে আর একটার কিন্তু সম্পর্ক আছে। দুটো জিনিসের মাঝখানে যে গ্যাপ, ফাঁকা জায়গাটা, তার সঙ্গে অন্য জিনিসগুলোর একটা সম্পর্ক রয়েছে। আবার অভিনেতা কোথাও দাঁড়াচ্ছে, সে সরে গিয়ে আবার অন্যভাবে আর একটা জিনিসের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই সবগুলোর তো একটা মানে তৈরি হয়, একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। আমরা তৈরি করি। আবার লক্ষ করো, নিক্তির ওজন করে কিন্তু কোনও কিছুই সাজানো যায় না নেচারে। নিজে থেকেই নিজের জায়গা মতো মানিয়ে আছে। প্রকৃতিতে কখনওই কোথাও কোনও ব্যালান্সের অভাব নেই।
জীবনের পথ চলাতেও প্রকৃতি থেকে তো জানছি অনেকটাই। ‘দুর্বোধ্য’ শব্দটা কেন বারবার আসছে?
হ্যাঁ, এই যে আহ্লাদে আটখানা। তুমি বলো এই আটখানা মানে কী? একটা লোক সত্যি সত্যি আট টুকরো হয়ে গেল? কিংবা এই যে চাঁদ টিপ দিয়ে যা কিংবা দুধ দিয়ে যা আমার খোকার গালে চুমু খেয়ে যা, এটা কী? সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভালোলাগা আছে, চলতে-ফিরতে তাদেরও অ্যাবস্ট্রাক্ট অনুভূতি আছে। তাই না হলে তো জীবনটা সাফোকেটিং হয়ে যাবে, দমবন্ধ হয়ে মারা যাব।
এত সহজ কথা এত সরল কথা আপনার তারপরেও লোকের কাছে শিল্প দুর্বোধ্য মনে হয় । এটা কি তৈরি করা, ভয় পাওয়ানো?
দুর্বোধ্য করেছে কিছু লোক এটাকে। বাইরের থেকে এসেছে। সেসব ভিস্যুয়াল আমাদের এখানকার মানুষের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে, নিজেও বোঝে না অন্যদের বোঝানো যায় না এইরকম পরিস্থিতি। কী বলব, একটা মডার্ন, সুপার মডার্ন ভাব। অথচ যে ফুল বলেছিলাম, তার একটা বিন্যাস আছে পল্লবের, পাপড়ির বিন্যাস। তার একটা রং আছে। দাঁড়িয়ে আছে জলের উপরে, হাওয়ায় দুলছে। আবার সেটাকে নিয়ে এসে যখন তুমি ফুলদানিতে রাখছ তখন আর এক সৌন্দর্য। এই যারা শিল্প আলোচক তাদের ওপরেও তো ভরসা করা যায় না। ওরা তোমায় ভালো ভালো লিখে দেবে ওদের কিছু কিছু অ্যাট্রাক্টিভ শব্দ জানা আছে। তোমার জন্য একটা লিখে দেবে তাই দেখে তুমি খুব খুশি হয়ে গেলে ওই পর্যন্তই। ওরা লেখক। আমি বই পড়ে কিছু বুঝি না আসলে, কিছু কিছু টার্ম বা ওই ধরনের কিছু কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো বই থেকে একটু সাহায্য নিই বটে, কিন্তু বই পড়ে কিছু শেখা যায় না।
অনেক কিছু তো করা হল, আপনার এই পরিণত বয়সে এখন কী ইচ্ছে করে?
আমার ভীষণ কাজ করতে ইচ্ছে করে, নতুন করে কাজ করতে ইচ্ছে করে নতুন রকম কাজ। মনে হয়, আবার নতুন করে কিছু শুরু করি। কোন ভাবনা কিছু নেই তবে নতুন কাজ করার ইচ্ছে থাকলে সেটা করতে করতে একটা নতুন কিছু আসবে সবসময়। একটা আবিষ্কারের মন থাকলে নতুন কিছু হবেই। এই যে যাত্রা শুরু করেছি গন্তব্যে পৌঁছতে পারলাম না এটাই এখনকার মানসিক অবস্থা।
এই যে নির্বাণ, পরিনির্বাণ, মহানির্বাণ কথাগুলো শুনি তার কোনওরকম অনুভূতি কি হয়েছে আপনার?
নির্বাণ হচ্ছে একটা মানসিক স্টেট, মানসিক অবস্থা যেখানে তোমার সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে তুমি উঠে যাচ্ছ। না রাগ, না লোভ, না ক্রোধ, না কষ্ট। সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে এমন একটা অবস্থায় আসছ যেখানে তোমার অনুভূতিও লোপ পেয়ে যাবে। মানুষের পক্ষে ওইরকম একটা স্তরে যাওয়া কিন্তু ভীষণ কঠিন। আমি তো পারবই না। তবে আমি তোমায় একটা কথা বলি, একবার আমার হয়েছিল। এই কথাটা না, আমি কিন্তু কাউকে বলতে চাই না। সেটা হল– একদিন একটা ছবি আঁকার পরে হঠাৎ আমি কিছুক্ষণের জন্য নিজের জ্ঞানে নেই। গায়ের লোমগুলো সব খাড়া হয়ে উঠল এবং আমি খানিকটা জ্ঞানশূন্যের মতো মানসিক অবস্থায় এলাম। এটা হয়েছিল মাত্র একবার। একবারই হয়েছিল।
আচ্ছা গণেশদা, এমন কি হয়েছে কখনও ছবি এঁকে আপনার মনে হচ্ছে, এ তো আমি আঁকিনি বা আমি কী করে আঁকলাম?
এটা হয়। এটা কীরকম জানো? তুমি ধরো পেনসিলে একটা লম্বা লাইন টানছ, তোমাকে যদি বলা হয় যে লাইনটা এমন ভাবে টানবে যাতে লাইনের কোথাও সরু মোটা না হয়, হালকা ঘন না হয়। এক রকম হবে। সত্যিই একটি বড় লম্বা লাইন যদি ড্রইং করো এবং ভাবো কীভাবে করেছি, তুমি মাঝখানটা বুঝতে পারবে না। ওই সময় তোমার মানসিক কনসেন্ট্রেশন, একটা একাগ্রতা এত গভীর হবে যে সেটা তোমার মনে থাকবে না। এটাও আমার কথা নয় এটা আমাদের অজন্তা তে কাজ করার সময় প্র্যাকটিস করানো হত।
বুদ্ধের সামনে বসে শিষ্যদের গল্প শোনা আর জিজ্ঞাসার কোন অন্ত ছিল না। আপনিও বলেছেন শিল্পে মিথ্যার কোনও স্থান নেই। এখন আপনার কাছে আমার শেষ প্রশ্ন গণেশদা – সত্য কাকে বলে?
বুদ্ধের কথা বলি। ওঁকে শিষ্যরা জিজ্ঞাসা করছে – আপনি আমাদেরকে বলুন, আনন্দ কী, শান্তি কী, সত্য কাকে বলে? বুদ্ধ শিষ্যদের গল্পের ছলে বলছেন– সন্ধ্যারাতে যে প্রদীপ জ্বালানো হল সে প্রদীপ মধ্যরাতেও জ্বলছে। সেই প্রদীপ ঊষাকালেও জ্বলছে। এখন বলো, ঊষাকালে যে প্রদীপ জ্বলছে সেটা কি মধ্যরাতের সেই প্রদীপ? কিংবা মধ্যরাতে যে প্রদীপ জ্বলছিল সেটা কি সন্ধ্যারাতে জ্বালানো প্রদীপটা? সন্ধ্যারাতে যে সলতে জ্বালানো হয়েছিল সেটা পুড়তে পুড়তে মধ্যরাতে যখন এসেছে তখন কিন্তু সেই সলতের অন্য অংশ। আবার সেই মধ্যরাতের প্রদীপের সলতের যে অংশ ঊষাকালে জ্বলছে সেটা মধ্যরাতের সলতে নয়। কিন্তু কী আছে? একটা ধারাবাহিকতা আছে, একটা বহমানতা। বুদ্ধ বলছেন, এই জগৎ সতত পরিবর্তনশীল। সর্বদা পরিবর্তন হতে হতে নতুন হয়ে চলেছে। এই যে পরিবর্তন হচ্ছে, তা হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট নিয়মে। পরিবর্তনের সেই নিয়মটা যদি ধরতে পারো তাহলেই তুমি জানতে পারবে সত্যকে।