যুদ্ধের পক্ষ যদি একদিনের জন্য বদলে যায়, তবে তা ঐতিহাসিক। আশ্চর্যের। এবং রেভোলিউশনারি। এক পক্ষে, ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান সমর্থক। বিপরীতে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র স্বয়ং থরথর কাঁপে। রাষ্ট্র তাই ডার্বি ম্যাচ বাতিল করে দিয়েছে। ঠিক তখনই, ফুটবল জিতে যায়। সে বলে, অলওয়েজ আই অ্যাম পলিটিক্যাল! কারণ, এ পৃথিবীতে ‘অরাজনৈতিক’ আসলে বিষ্ঠা!
প্রচ্ছদ ঋণ: নারায়ণ দেবনাথ
এ-লেখা শুরু হোক একটি বইয়ের কথায়। ‘সকার ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো’। সে-বইয়ে এদুয়ার্দো গালেয়োনো লিখছেন: ‘আই প্লে দেয়ারফোর আই অ্যাম: আ স্টাইল অফ প্লে ইজ আ ওয়ে অফ বিয়িং দ্যাট রিভিলস দ্য ইউনিক প্রোফাইল অফ ইচ কমিউনিটি অ্যান্ড অ্যাফার্মস ইটস রাইট টু বি ডিফারেন্ট।’
ফোকাস করছি ‘ইউনিক প্রোফাইল অফ ইচ কমিউনিটি’– শব্দবন্ধটিতে। এই একুশ শতকে গালেয়োনোর মোক্ষম পর্যবেক্ষণে উত্তর-আধুনিক ছায়া পড়েছে। যেহেতু সমগ্র পৃথিবীর ফুটবল আদ্যপান্ত পুঁজি-নির্ভর, তাই ‘স্টাইল অফ প্লে’ কতখানি ইউনিক তা আদতেই হাই-প্রোফাইল কোচের মগজস্থ। কিন্তু, কিন্তু হে পাঠক, ‘ইউনিকনেস’ এখনও মরেনি। সে বেঁচে আছে। সমর্থকের সত্তায়। মেজাজে। স্বরে। হইহই করে।
ধরি, ‘কমিনিউনিটি’-র নাম বাঙালি। তৎক্ষণাৎ একটা অনাদিকালের রাইভ্যালরি। যুবভারতীতে দুই পক্ষ। বারুদসম। অনুরাগ কাশ্যপের সঙ্গে ‘বেলাশেষ’-এর কখনও সখ্য হতে পারে কি? বজরং দলের সঙ্গে প্রেম-যুগলের? ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের? খেপেছেন মশাই! কেউ যদি বলে, ‘তোর পিঠে কাঁটাতারের দাগ কই?’, আড়ে-বহরে ফুঁসতে ফুঁসতে উত্তর আসবেই, ‘আমরা তোদের মতো ক্লাব বেচে দিই না!’ ব্যস! যুদ্ধ শুরু। মুখে। হাতে। পায়ে। এবং মাঠেও। যেন প্রত্যেকটা আগুন আগুন শরীর।
যুদ্ধের পক্ষ যদি একদিনের জন্য বদলে যায়, তবে তা ঐতিহাসিক। আশ্চর্যের। এবং রেভোলিউশনারি। এক পক্ষে, ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান সমর্থক। বিপরীতে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র স্বয়ং থরথর কাঁপে। রাষ্ট্র তাই ডার্বি ম্যাচ বাতিল করে দিয়েছে। ঠিক তখনই, ফুটবল জিতে যায়। সে বলে, অলওয়েজ আই অ্যাম পলিটিক্যাল! কারণ, এ পৃথিবীতে ‘অরাজনৈতিক’ আসলে বিষ্ঠা!
……………………………………………………………..
সিএএ-এনআরসি আন্দোলনে যখন কলকাতা উথালপাতাল! পার্ক সার্কাসে অবস্থান করছেন কাতারে কাতারে মানুষ! যুবভারতীতে তখন একটি ডার্বি ম্যাচ। ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে টিফো: ‘রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়’। কী ভীষণ রাজনৈতিক এ উচ্চারণ। যেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের অসম লড়াইয়ের অবিচ্ছিন্ন অংশ ফুটবল। ফুটবল কিন্তু সেই উচ্চারণকে প্রশ্রয় দিয়েছে। দেবেই।
……………………………………………………………..
অক্টোবর। ২০২৩। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ স্টেজের ম্যাচ। সেল্টিক এফসি বনাম অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ। সেল্টিক এফসি স্কটল্যান্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লাব। ক্লাব-সমর্থকদের ফুটবল-বিশ্ব চিনেছে– ‘দ্য গ্রিন ব্রিগেড’ নামে। রাষ্ট্রের কতশত নিষেধাজ্ঞা ছিল। তবু, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেই ম্যাচে, সেল্টিকের গ্যালারিতে উড়েছিল ফিলিস্তিনের পতাকা। স্বাধীন আর অসংখ্য আর একটি টিফোয় লেখা: ৩০,০০০+ ডেড – ১২,০০০+ চিল্ডরেন। এন্ড দ্য জেনোসাইড– এন্ড জায়োনিজম।
কী আশ্চর্য! তাঁরা গাইছিল, ‘ওয়াক অন, ওয়াক অন/ উইথ হোপ ইন ইয়োর হার্ট/ অ্যান্ড ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন। এ-গান লিভারপুলের। এ-গান কমরেডশিপের। অ্যানফিল্ডের রক্তে, কী এক বোধের মতো মিশে আছে। সেই লিভারপুল, যে ক্লাবের ফ্যানবেস– ‘ডিপ ওয়ার্কিং-ক্লাস রুটেড’। সগৌরবে গ্যালারিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যানারের আদলে টিফো তৈরি করে। সোভিয়েত ব্যানারে ছিলেন, কার্ল মার্কস। ফ্রেডরিশ এঙ্গেলস। ভ্লাদিমির লেনিন। লিভারপুলের ব্যানারে বব পেইসলি, বিল শ্যাঙ্কলি, জুর্গেন ক্লপ– ক্লাবের আইকনিক ম্যানেজার। দুই ব্যানারেই লাল রং এবং একটি তারা– জ্বলে আছে!
যেনতেন প্রকারে রাষ্ট্র অথবা পুঁজি, যে-মুহূর্তেই ফুটবলের অধিকার চাইতে এসেছে, সে ধরা দেয়নি। বারবার ছিটকে ছিটকে বেরিয়েছে। আপনাদের মনে আছে, সিএএ-এনআরসি আন্দোলনে যখন কলকাতা উথালপাতাল! পার্ক সার্কাসে অবস্থান করছেন কাতারে কাতারে মানুষ! যুবভারতীতে তখন একটি ডার্বি ম্যাচ। ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে টিফো: ‘রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়’। কী ভীষণ রাজনৈতিক এ উচ্চারণ। যেন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের অসম লড়াইয়ের অবিচ্ছিন্ন অংশ ফুটবল। ফুটবল কিন্তু সেই উচ্চারণকে প্রশ্রয় দিয়েছে। দেবেই। কারণ, অস্তিত্বের সংশয়কালে ফুটবলই হয়ে উঠেছে নাগরিকের পরিচয়। জন্মদাগ। যে দাগ রাষ্ট্র কেড়ে নিতে পারবে না কোনও দিন।
কেড়ে নিতে পারবে না কণ্ঠস্বর। টিফো। ব্যানার। লাল-হলুদ। সবুজ-মেরুন। রংগুলো। রাষ্ট্র যে খুন এবং ধর্ষণকে আশ্রয় দিচ্ছে, চিরতরে মুছে দিতে চাইছে যে যাবতীয় এভিডেন্স, কিনে নিতে চাইছে যে মৃত চিকিৎসক–পড়ুয়াটির পরিবার, বাতিল করে দিয়েছে ডুরান্ড কাপের গ্রুপ-পর্বের ডার্বি ম্যাচ– তার প্রতিরোধ হয়ে জন্ম নিচ্ছে ফুটবল। নতুন কি? মোটেই না। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহামেডান। পথে। চিৎকারে। আন্দোলনে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। একসঙ্গে। কাঁধে কাঁধ। একেই কি দৃশ্যের জন্ম বলে? জানি না।
তবে জানি, ভারতের মতো দেশ– ফিফা-র্যাঙ্কিং-এ স্থান ১২৪– বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারেনি কখনও– ফুটবল-গৌরবের ভাঁড়ার আসলে শূন্য– সেই দেশ শুধু আবেগ-সর্বস্ব হয়ে ফুটবলে বাঁচে। ওই আবেগটাই ফুলকি। ওই আবেগের তাড়নাই বলে, রাষ্ট্র মিছিলের অনুমতি দেয়নি! কিন্তু, প্রতিবাদ আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে পড়ে, তাই না?
……………………………………………………….
আরও পড়ুন রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়-এর লেখা: বেয়নেটের ঠোঁট সযত্নে বেঁকিয়ে দেয় শান্তির শ্বেত পায়রারা
……………………………………………………….
মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সমর্থকও পথে। কলকাতা শহরের তিন প্রধান। অদ্ভুত মিশে গেল ফুটবল বোধে। আবেগে। আবহাওয়া দপ্তর বলেছে, বৃষ্টির সম্ভবনা প্রবল। এই সুযোগে বব ডিলান গেয়ে উঠুক, ‘অ্যান্ড ইটস আ হার্ড, ইটস আ হার্ড, ইটস আ হার্ড/অ্যান্ড ইটস আ হার্ড রেইন গনা ফল…’