কিউবিকলের পাশেই রাখা কিউবিকলের মন। অতএব বিস্ফোরণ বিস্ফোরণ! অফিসে এইসব বিস্ফোরণ আকছার। সকালের কার্ড-পাঞ্চ জানে না, বিকেলে দম্পতি এক্সিট করবে কি-না! প্রেম অনিশ্চিত। ঝুঁকিপ্রবণ। অফিসপ্রেমে তা আরও বেশি। কারণ যেখানেই দেখা হয় সেখানে বসের ভয়। এই বস এক আজব চিজ! সে যে কী করে সর্বভূতে বিরাজমান হয়, তার ঠিক নেই। কাজ নিয়ে থাকলেই ল্যাটা চুকে যায়! কিন্তু অধিকাংশ বসই কাজের বাইরের জীবনেও নজর রাখেন। ব্যক্তিস্বাধীনতার গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো। শুরু হল নতুন কলাম ‘ওপেন সিক্রেট’। আজ প্রথম পর্ব।
১.
অফিস-প্রেম বেশি বয়সের কাগজের নৌকা। হৃদয়ের একূল ওকূল দু’কূল আকুল হলে আলতো টোকায় ভাসিয়ে দেওয়া। খানিক দুলে দুলে চলা। সলিলসমাধি অধিকাংশের অনিবার্য নিয়তি, তবু ওই ক্ষণিকের ভেসে যাওয়াটুকু অনস্বীকার্য। ঘণ্টা দশের ঘিসাপিটা জীবনে অফিস-প্রেম মুখোমুখি বসিবার দু’-দণ্ডের অবসর।
এই পর্যন্ত লিখে অবশ্য বিপদেই পড়লুম। নিজে যেহেতু অফিসের সঙ্গে জড়িয়ে তাই হেন বিষয় নিয়ে কি-বোর্ড পেষায় অর্থ-অনর্থ দুয়েরই সম্ভাবনা। তবে, প্রেম কবে আর এসবের তোয়াক্কা করেছে। অফিসপ্রেমের লেখাও তাই একটু ডেয়ারডেভিল। একমাত্র সে-ই তো বুক ঠুকে বলতে পারে, পরকীয়া তো ডরনা ক্যায়া! দিব্যি চলছিল সহকর্মী-কর্মী বছরপার। হঠাৎ একদিন অফিস অরণ্যের দিনরাত্রি হল আলোর পথযাত্রী। কবে যে ঠিক সম্পর্কের রং বদলে যায় হর-গৌরী নিজেও তার খোঁজ পান না। ফলে পঞ্জিকাও এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। প্রেম আর আত্মহত্যা নিয়ে এই এক ধন্দ। ঘুরঘুরে পোকা উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াতে পারে অনেক দিন থেকেই। তবে ওই ট্রিগার-পয়েন্ট যে ঠিক কোনটি, তার আঁচ পাওয়া মুশকিল।
এদিকে কিউবিকলের পাশেই রাখা কিউবিকলের মন। অতএব বিস্ফোরণ বিস্ফোরণ! অফিসে এইসব বিস্ফোরণ আকছার। সকালের কার্ড-পাঞ্চ জানে না, বিকেলে দম্পতি এক্সিট করবে কি-না! প্রেম অনিশ্চিত। ঝুঁকিপ্রবণ। অফিসপ্রেমে তা আরও বেশি। কারণ যেখানেই দেখা হয় সেখানে বসের ভয়। এই বস এক আজব চিজ! সে যে কী করে সর্বভূতে বিরাজমান হয়, তার ঠিক নেই। কাজ নিয়ে থাকলেই ল্যাটা চুকে যায়! কিন্তু অধিকাংশ বসই কাজের বাইরের জীবনেও নজর রাখেন। ব্যক্তিস্বাধীনতার গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো। মুখে কিছু বলা যায় না। অফিসপ্রেমের প্রধান শত্রু এই বস।
তা বসেরা কি প্রেমে পড়ে না? দিব্যি পড়ে। আর এইখান থেকে এক জটিল অঙ্কের সূত্রপাত। প্রেম-পদাবলি-কীর্তন খুব ভালো কথা। কানু বিনে গীত নাই! কুরুক্ষেত্রও নাই। অর্থাৎ রাজনীতি। অফিস পলিটক্সের গ্রাফ ওঠানামা করে যখন বস ডুবে যায় প্রেমে। সহকর্মীর রকেট উত্থান দেখে বাকিরা হতবাক। ট্যুরে ট্যুরে ভুরভুরে প্রেম-প্রেম সুবাস। ইতিউতি পোড়া গন্ধও কিছু ভাসে। অর্থাৎ, বসের সমগোত্রীয়রা একজনের প্রেমভাগ্যে অন্যজন ঈর্ষান্বিত। অফিসের সাপ-সিঁড়িতে তখন আর একদফা চাপান-উতোর। প্রেম ব্যক্তিগত। তবে অফিসপ্রেমে বাকিটা ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই। অনেকটাই অফিসের ভালো-মন্দের সঙ্গে তা জড়িয়ে যায়। মুশকিল হল, বস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। কাজের বাড়ি বদলে যায়, বস-ও। তখন অবশ্য মাথার খেলা। পড়ে পাওয়া পজিশন কে টিকিয়ে রাখতে পারবে আর কে সাইডলাইনের ধারে চলে যাবে, তা নিতান্তই ব্যক্তিগত।
……………………………………………………….
অফিসপ্রেম যে তবু কেবলই ধ্বংসের কথা বলে, তা নয়। স্বপ্ন দেখা যে তরুণ-তরুণীরা আসে, তারা প্রত্যেকে জানে হাতের উপর হাত রাখা সহজ নয়। জীবন মূলত যুদ্ধ। তাতে কে হবে সঙ্গী! অফিস সেখানে অনুঘটক। আগেকার দিনে সেই যে দেখাশোনার পর হবু বর-বউকে নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় দেওয়া হত, যা গড়িয়েছে আজকের বিয়ের আগে ডেট-এ, অফিস যেন সেই সুযোগই দেয় অন্যভাবে। অফিসমালিকদের গোঁসা হতে পারে, তবে, প্রেমের গোঁসাইরা সে সবের পরোয়া করেন না।
……………………………………………………….
তবে এই সব জটিল জিলিপি টানার কোনও মানে নেই, যদি এই মধুর-মধুর বংশীধ্বনির ছিদ্রপথে এক্সপ্লয়টেশন ঢুকে না পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই সে বস্তুটির গোড়াপত্তন হয় এই জায়গা থেকেই। প্রেম বলুন বা যে কোনও সম্পর্কে ক্ষমতার একটা বিন্যাস থাকে। অফিস তো পাওয়ারের নাগরদোলা। প্রেম দিয়ে কি সেই ক্ষমতাগন্ধ মুছে ফেলা যায়! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তা হয় না; হাতে থাকে পেনসিল থুড়ি বিপর্যয়। একদা যাকে চোখে হারানো, সে-ই চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে, এমন কাহিনি দুর্লভ নয়। অফিসপাড়ায় কান পাতলেই শোনা যায়।
অফিসপ্রেম যে তবু কেবলই ধ্বংসের কথা বলে, তা নয়। স্বপ্ন দেখা যে তরুণ-তরুণীরা আসে, তারা প্রত্যেকে জানে হাতের উপর হাত রাখা সহজ নয়। জীবন মূলত যুদ্ধ। তাতে কে হবে সঙ্গী! অফিস সেখানে অনুঘটক। আগেকার দিনে সেই যে দেখাশোনার পর হবু বর-বউকে নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় দেওয়া হত, যা গড়িয়েছে আজকের বিয়ের আগে ডেট-এ, অফিস যেন সেই সুযোগই দেয় অন্যভাবে। অফিসমালিকদের গোঁসা হতে পারে, তবে, প্রেমের গোঁসাইরা সে সবের পরোয়া করেন না। গায়ে মেখে নেন বৈষ্ণবী-হাওয়া। খবর অবশ্য চলেই যায় কর্তৃপক্ষের কানে। অন্যের নামে কানভাঙানো লোকের অভাব সম্ভবত কোনও অফিসে কোনওকালেই নেই। ফলে কে কার ছবি তুলতে ব্যর্থ, কার রেস্তরাঁর টেবিল বুক করার পয়সা জলে গেছে আর অন্ধকার সিনেমাঘরের শীতে উষ্ণতা ভাগাভাগি করে নেওয়া কোন কোন সহকর্মীকে একত্রে একান্তে আবিষ্কার করা গিয়েছে– এসব খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ আবার প্রেম পাকা করতে অন্য সহকর্মীর সঙ্গে বিস্তর ভালোমানুষি সম্পর্ক ফেঁদে বসেন। তারপর হিল্লিদিল্লি ছল্লিবল্লি ঘর বন্ধ যাই হোক না কেন, সহকর্মীর মুখ-বন্ধ। কর্তৃপক্ষও ভাবে, যতক্ষণ না কাজে ক্ষতি, যার যেখানে মতি সেখানে যাক। পৃথিবীতে কে কাহার! অতএব অফিসপ্রেম বহাল তবিয়তেই থাকে। এবং ব্যাচে ব্যাচে রিনিউ হয়। প্রেমে-পড়া মানুষের কাছে অফিস এক মন-চেনার বন্দর। আসলে মানুষের অনেক রকম সত্তা। বাড়ির আর অফিসের মানুষ যে এক নয়, সে যে ঘর করে সে-ই বোঝে। তবু ঘর করার আগে খানিক দেখে নেওয়ার এমন সুবর্ণসুযোগ আর কোথায়! যে মানুষটা দশ ঘণ্টা চোখের সামনে ঘুরছে তাকে খানিকটা তো চেনা যায়-ই। অফিসপ্রেম থেকে অনেক সুখী প্রজাপতিই তাই উড়ে গেছে দাম্পত্যে। দীর্ঘ বসত শেষে হয়তো আবার ঘর ভেঙেছে কিংবা ভাঙার উপক্রম হয়েছে। তবে তাতে অফিসের দোষ নেই। দাম্পত্যে ইনকমবেন্সি এলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।
অফিসপ্রেম অফিসের মুখরোচক গসিপ। অফিস পেরিয়ে তা অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত যে সেক্টর ছোট, সেখানে তো বটেই। এমনিতেই প্রেম আর আগুন চাপা থাকে না। কেউ কেউ শোনা যায়, আইপিএল-এর মতো ছোট চার ওভারের স্পেলে প্রেমে পড়ে। অর্থাৎ নতুন কাউকে দেখলে কিছুদিন উলুঝুলু দিনকাল তার। তারপর খেয়াল করে, স্টেশনে নামতে-না-নামতেই মেট্রোর গেট বন্ধ। অতএব মন্দ কপালে আবার প্রতীক্ষা। তবে, অফিসপ্রেম কিন্তু পাক্কা প্রগতিশীল। বয়সের ছোট-বড় কিংবা কাস্ট-ফাস্ট ইত্যাদি তার কাছে পথের ডাস্ট। বলা যায়, প্রেম তো নিজেই এরকম। অফিসপ্রেম আলাদা কেন? অফিসের মধ্যে যে গুণগুলোর প্র্যাকটিস চলে, অফিস পেরোলে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চলে না। ফলে, অফিসপ্রেমের অনেকটা আলো খেলে। মনে হয়, এমনধারা উদার যদি আস্ত সমাজটাই হত। এমন প্রেমে বুঁদ!
……………………………………………………..
আরও পড়ুন অরিঞ্জয় বোস-এর লেখা: প্রেমে ফেল করলে পাশ করায় পাশবালিশ
……………………………………………………..
তবে, এই নকল বুঁদিগড় বেশিদিন রক্ষা পায় না। কেন কে জানে, সব অফিসপ্রেমই একদিন ধসে যায়। অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে, বিষণ্ণ প্রেমিকগণ কিছুদিন খুব কাজে মন দেন। তারপর সোলো ট্রাভেলে বেরিয়ে পড়েন। হয়তো বুঝে যান, অনেক তো হল, জীবনে এসেছও সোলো, যেতেও হবে সোলো, অতএব…। তবু হাজার হোক প্রেম তো! সেই সব ভাঙা মনের খবর আর অফিস রাখে না। সহকর্মীরা দু’-চারদিন অন্তরালে ফিসফাস– কেটে গেছে।
তাহলে, রক্তক্ষরণ?
হয় নিশ্চয়ই। ওপেন অফিসপ্রেমে সেটুকুই যা সিক্রেট।
………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………….