বব ডিলানের এই গান ভবিষ্যৎবাণীর মতো নিদান দেয়– যুদ্ধ আসন্ন
Published by: Robbar Digital
Posted on: August 23, 2024 9:18 pm
Updated: October 4, 2024 9:42 pm
১৯৬২ সাল, মানে আমেরিকায় সিভিল রাইট্স মুভমেন্ট শুরু হয়ে গেছে। সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রশ্নের মুখে, জনতার ক্ষোভ সরাসরি রাষ্ট্রের দিকে তাক করা। শুরু হতে চলেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। যুদ্ধ-সম্ভাবনায় বিনিত্র রজনী কাটাচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত। আমেরিকার অন্তর্দ্বন্দ্ব এবার মোড় নেবে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে। রাস্তায় নামবে লাখো লাখো মানুষ। সেই সময় বব ডিলানের এই গানটি ভবিষ্যৎবাণীর মতো নিদান দেয়। যুদ্ধ আসন্ন। শুরু হল নতুন কলাম– গানস অ্যান্ড রোজেস। আজ প্রথম পর্ব।
প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়
১.
মাস্টার্স অফ ওয়ার, বব ডিলান, ১৯৬২
১৯৬২। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তখন ফ্যাঙ্ক সিনাত্রা, ন্যাট কিং কোল, এলভিস প্রেসলি, বিটলস আস্তে আস্তে উঠে আসছে। এরকম একটা সাংগীতিক দুনিয়ায় বিনোদনের প্রচণ্ড দাপট, কিন্তু দেশবাসী অশান্ত। সিভিল রাইটস মুভমেন্ট মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। এমন সময় শোনা গেল কুড়ি-একুশ বছরের একটি ছেলের গান। তাঁকে কবি বলব না সংগীতকার– আজও জানি না, তাঁর গানে কাব্য ও সংগীত সমানভাবে জোরালো। তাঁর নাম বব ডিলান। তিনি সৃষ্টি করলেন একটি যুগান্তকারী যুদ্ধবিরোধী গান– মাস্টার্স অফ ওয়ার।
আমেরিকার বিখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী এবং ডালসিমার-বাদক জিন রিচি বব ডিলানকে শুনিয়েছিলেন একটি গান। ‘নটুহাম টাউন’। এই সুর লোকসংগীতের। এই সুর পাহাড়ি এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। এই গান পাহাড়ের মানুষের নিজের। এই গান ব্যালাড। এই গান লিরিক্যাল। কিন্তু বব ডিলান ওই সুরটির ওপর ভিত্তি করে লিখে ফেললেন যুদ্ধবিরোধী গান– ‘মাস্টার্স অফ ওয়ার’। দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, এখনও, এই গান যুদ্ধবিরোধী মানুষের ইস্তেহার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬২ সালে সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রশ্নের মুখে, জনতার ক্ষোভ সরাসরি রাষ্ট্রের দিকে তাক করা। শুরু হতে চলেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। যুদ্ধ-সম্ভাবনায় বিনিত্র রজনী কাটাচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত। আমেরিকার অন্তর্দ্বন্দ্ব এবার মোড় নেবে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে। রাস্তায় নামবে লাখো লাখো মানুষ। সেই সময় বব ডিলানের এই গানটি ভবিষ্যৎবাণীর মতো নিদান দেয়। যুদ্ধ আসন্ন।
যুদ্ধের মদতদাতা যারা, যুদ্ধের পৃষ্ঠপোষক যারা, তাদেরও ছেড়ে কথা বলবেন না ডিলান। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মুখোশ খুলে দেবেন তিনি।
তবে ব্যালাডের যে ধরনে এই গানটি তৈরি, তাতে একটু খটকা লাগে বইকি। সাধারণত আমরা দেখি, প্রতিরোধী গানে সূক্ষ্মভাবে হলেও স্লোগানধর্মিতা এসে যায়। দেওয়ালে লেখার অক্ষর হয়ে ওঠে গানের কথা। কিন্তু এই গান সেই প্রবণতাকে অস্বীকার করে। বরং লোকগানের ব্যালাডে ডিলান গানটা বাঁধেন। মূল গান ‘নটুহাম টাউন’-এ শুনি এক পর্যটকের কথা, যিনি নটুহাম নগরের দিকে যাচ্ছেন। ফলে মূল গানটি বর্ণনাধর্মী এবং গীতধর্মী। কিন্তু ডিলান নিজের গানটি শুরুই করেন একটা আঘাত দিয়ে– Come you masters of war/ You that build the big guns/ You that build the death planes/ You that build all the bombs. তারপর ধীরে ধীরে গানটির কথা, গানটির বার্তা জোরালো হয়। গানটা পাহাড়ি অঞ্চলের গানের মতো পঞ্চস্বরের হলেও এই গান যুদ্ধবিরোধী। সে জন্যই গানটা দূর থেকে ভেসে আসলে মাঝে মাঝেই শ্রোতা দিকভ্রষ্ট হয়, মনে হয় চেনা সুরের মেঠো কোনও গান বোধহয়। কিন্তু শব্দের দিকে তাকালে ডিলানের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়। কোনও প্রতীক নেই, কোনও অলংকার নেই। সোজা, চোখের দিকে তাকিয়ে গানটি শুরু হয়ে যায়।
Come you masters of war You that build the big guns You that build the death planes
শুরুতেই ডিলান ‘ডেথ প্লেন’ বলে দেন। এরোপ্লেনকে এর আগে কি কেউ ডেথ প্লেন বলেছেন? এত সরাসরি যুদ্ধবিরোধী গান, তবুও তিনি কাব্যিক মাত্রা এড়ালেন না, এড়াতে চাইলেনও না। এরোপ্লেনকে ডেথ প্লেন বলে সম্বোধন করলেন। আমরা জেনে গেলাম পারমাণবিক আক্রমণের দিকে তাঁর নজর। পরের লাইনেই দেখব, কী ধরনের বোমার কথা বলা হচ্ছে।
You that build all the bombs You that hide behind walls You that hide behind desks I just want you to know I can see through your masks.
এখানে ডিলান খানিক সতর্কবার্তা দেন। বলেন, তুমি ভেবো না যে যুদ্ধ অপরাধ করে তুমি পার পেয়ে যাবে। আমরা জানি তুমি কে। আমরা জানি তুমি কোথায় লুকিয়ে আছ, কোন মুখোশের আড়ালে।
You that never done nothin’ But build to destroy You play with my world Like it’s your little toy
এবার স্বর কি একটু পাল্টে যাচ্ছে? একটা কাতর স্বর ভেসে আসে যেন! সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন ডিলান। অসহায়তা ঢেকে রাখার আর প্রয়োজনবোধ করলেন না তিনি। You put a gun in my hand And you hide from my eyes And you turn and run farther When the fast bullets fly
তুমি কোনও দিনও যুদ্ধক্ষেত্রে যাওনি। তুমি পেন্টাগনে বসে থাকো। তুমি সেখান থেকে দেখতে পাও যুদ্ধবিমানগুলো উড়ে উড়ে যাচ্ছে। তুমি আমার হাতে বন্দুক তুলে দিয়েছ। আমি কিন্তু আর ফিরতে পারছি না সেখান থেকে। আমি যুদ্ধের সৈনিক, আমি তোমার ভৃত্য। আর তুমি মাস্টার, মাস্টার অফ ওয়ার। পাঠক, খেয়াল করুন, যুদ্ধবিরোধিতা কীভাবে শ্রেণির লড়াইয়ে পরিণত হল।
Like Judas of old You lie and deceive A world war can be won You want me to believe
বারবার তুমি জেতার কথা বলো আমাকে। যেন জেতাটাই জীবনের মানে। আর মৃত্যু? হত্যা? অন্যকে মারাই তোমার কাছে জেতা শেষমেশ। স্পষ্ট।
But I see through your eyes And I see through your brain Like I see through the water That runs down my drain
এখানে গান আর কবিতা একাকার হয়ে উঠছে। অথচ ফুল-পাখি-চাঁদ-তারা-সবুজ মাঠ নেই। নর্দমার কথা বলা হচ্ছে। নর্দমার অস্বচ্ছ জল এখানে কবিতা, হাতিয়ার। পুতিগন্ধময় নর্দমার জল আর তোমার মধ্যে কোনও তফাত নেই।
You fasten all the triggers For the others to fire Then you sit back and watch When the death count gets higher
মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। গুলিও তবুও থামছে না। তুমি যুদ্ধবাজ, তুমি যুদ্ধের পরিচালক।
You hide in your mansion While the young people’s blood Flows out of their bodies And is buried in the mud
আবার ডিলান পারমাণবিক যুদ্ধের কথা বলবেন, কিন্তু উচ্চারণ করবেন অন্য শব্দ। এখন বুঝতে পারব এই গান পারমাণবিক যুদ্ধের বর্ণনামুখর। ডিলান বলবেন তুমি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য ভয়টা ঢুকিয়ে দিয়েছ– সন্তান প্রসব করার ভয়। আমার ভয় হচ্ছে আমার সন্তান হয়তো বিকলাঙ্গ হবে। মূক হবে, বধির হবে। আমার না-জন্মানো সন্তান, যার নামকরণ হয়নি এখনও, তাকেও তুমি সন্ত্রস্ত করে রেখেছ।
You’ve thrown the worst fear That can ever be hurled Fear to bring children Into the world For threatening my baby Unborn and unnamed
রক্ত সবারই লাল। আমার ধমনী দিয়ে যে লাল রক্ত বইছে, যা তোমার শরীরেও বইছে, সেই রক্ত তোমার জন্য নয়।
You ain’t worth the blood That runs in your veins
আবারও শ্রেণি চেতনা ফিরে আসবে। ডিলান বলবেন, আমাকে বোকা করে রেখেছ তুমি, আমাদের সবাইকে। আমাদের মুখ বন্ধ করে রেখেছ। বলেছ আমরা সাধারণ, বিচারবুদ্ধিহীন, তুচ্ছ। ডিলানের এই কথা কিন্তু সময়হীন। পৃথিবীর যে কোনও সময়ে যে কোনও প্রান্তের জন্য এ কথা সত্যি।
How much do I know To talk out of turn You might say that I’m young You might say I’m unlearned
But there’s one thing I know Though I’m younger than you That even Jesus would never Forgive what you do
এটা অনেকটা ‘ভগবানও তোমাকে ক্ষমা করবে না’-র প্রবাদের মতো উচ্চারিত হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, এই নিয়ে দু’বার বাইবেলের রেফারেন্স এসেছে। এই পর্যন্ত পড়ে একটু থামতে হয়। এবার ডিলান সাংঘাতিক কথা বলবেন! আগে যুদ্ধ লাগত জমির অধিকার নিয়ে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের কারণও বদলে গিয়েছে। এখন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ যুদ্ধ পরিচালনা করে। কয়েকটা মানুষ যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি করে নিজেদের প্রয়োজনে। আর লাখো লাখো লোক মরে যায়। স্রেফ মরে যায়। যুদ্ধ আসলে মুনাফা। কয়েকটি লোকের ব্যবসা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যুদ্ধের মাধ্যমেই বেঁচে থাকে।
When your death takes its toll All the money you made Will never buy back your soul
এখানে এসেই এই গানটা আর শুধু যুদ্ধবিরোধী গানে সীমায়িত থাকে না। এ গান এখন বৃহৎ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিবাদ করবে। আর তাই এই গান সমসাময়িক, এই গান ততদিন লোকের মুখে মুখে ঘুরবে, যতদিন না এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে। যতদিন না ব্যবসার দুনিয়া নির্মূল হবে, ততদিন এই গান আমাদের। সব হারাদের।
And I hope that you die And your death will come soon I’ll follow your casket By the pale afternoon
এইখানে বব ডিলান একটা ছবি এঁকে ফেললেন। কত সহজ, অথচ সাবলীলভাবে একটা ধূসর দুপুরবেলায় দাঁড়িয়ে আমরা। দেখতে পাচ্ছি তোমার কফিন এগিয়ে যাচ্ছে। এই মৃত্যু আমরা কামনা করি। এই মৃত্যু আমরা সকলে কামনা করি। ডিলানের এই মৃত্যুকামনায় সকল সাধারণ মানুষ এসে হাজির হয়। আমাদের সবার প্রার্থনা এই দুপুরে এসে জড়ো হয়।
And I’ll watch while you’re lowered Down to your deathbed And I’ll stand over your grave ‘Til I’m sure that you’re dead
তোমার মৃত্যু মানে যুদ্ধেরও মৃত্যু। তোমার মৃত্যু মানে আমাদের বেঁচে যাওয়া। তাই তোমার কফিনের ওপর দাঁড়াব আমি। তোমার মৃত্যু নিশ্চিত করব নিজে। আমার পায়ের তলায় তুমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবে, আর এখান থেকে, ঠিক এখান থেকেই আমাদের, হেরে যাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার উপাখ্যান শুরু হবে।