বাজারে তাল-তাল তাল। দরকারের রকমফের আছে– কেউ কয়েক দিন বাদে ব্যবহার করবে, তবু কিনে রাখতে হবে, তাই কিছু মানুষ শুঁকে দেখে কেনে, কেউ টিপে-টুপে কিনছে। কিন্তু সবই যেন যান্ত্রিক। দোকানে তাল বেশি, মানুষ কম। তালের বড়া বানানোর ঝক্কি নাকি অনেক, তাই অনেকে তেলেভাজার দোকান থেকে বা মিষ্টির দোকান থেকে তালের বড়া বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু জন্মাষ্টমী মানে কি শুধুই তালের বড়া? আজকের শহরে এই দিনের উন্মাদনা সেইভাবে বোঝা যায় না– কিন্তু আমাদের ছোটবেলার গেরস্ত কলকাতায় জন্মাষ্টমীর একটা গন্ধ ছিল– বাড়িতে বাড়িতে তাল মাড়া হচ্ছে। সেটা দিয়ে তালের বড়া, তালের লুচি, তাল ক্ষীর তৈরি হবে। বাড়িতে পুজো হোক বা না হোক, জন্মাষ্টমীর দিন তালের বিভিন্ন পদ রান্না হবেই, যার রেশ থেকে যাবে পরের কয়েক দিন।
বেশ কিছু বছর আগে, একদিন কাটোয়ার কাছে, জাজিগ্রামের সিপাইদীঘির পাশে, সারি সারি কিন্তু নিজেদের মধ্যে একটা ব্যবধান রাখা তাল গাছগুলো দেখে অনেক দিন আগে দেখা আফ্রিকার ধূ ধূ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা এক নিঃসঙ্গ বাওবাব গাছের ছবি মনে পড়েছিল, কেন, তখনও জানতাম না– কিন্তু হালে জানলাম তালের আদি বাড়ি আফ্রিকা। এটা জেনে আমার তালি দেওয়ার কিছু নেই– সেভাবে দেখতে গেলে মানবজাতিরই তো আদি বাড়ি আফ্রিকা, সেখান থেকেই তো হাঁটার শুরু। কীভাবে এই দেশে এসে পড়ল, সেটা ‘গ্রেট কন্টিনেন্টাল ড্রিফ্ট’-এর জন্য, না পাখির ঠোঁটে করে, সেটা জানা যায় না। কিন্তু এসেছিল আর সেই সময় থেকে বহাল তবিয়তে এই দেশে বাস করে চলেছে। আসলে একটা গাছ মাথা উঁচিয়ে খোলা মাঠের মধ্যে নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে, সেই ছবির মধ্যে একটা বীরত্ব আর একাকিত্ব– দুটো সমান ভাবে মিশে যায়। মহাভারতে দুই মহাবীরের রথের ধ্বজায় তাল গাছ ছিল– ভীষ্ম আর বলরাম। দু’জনেই সবার মধ্যে থেকেও একা, নিঃসঙ্গ আর ব্যতিক্রমী ছিলেন, তাই হয়তো তাল গাছের সঙ্গে তাঁদের মিল খুঁজে পেতেন! ভীষ্ম তবু কিছুটা কল্কে পেয়েছেন, তর্পণের সময় তাঁকে প্রতি বছর একবার অন্তত মনে করে সবাই– কিন্তু বলরাম! প্রায় সমস্ত যুদ্ধেই কৃষ্ণ তাঁর পাশে বলরামকে পেয়েছেন, হয়তো অনেক যুদ্ধে হেরেও যেতেন পাশে বলরাম না থাকলে, কিন্তু খ্যাতির ক্ষীর চিরকাল কৃষ্ণ একাই খেয়েছেন, বলরাম পার্শ্বচরিত্র থেকে গিয়েছেন চিরকাল। তাল গাছের ক্ষেত্রেও একই প্রযোজ্য: গরমকালে তালপাখায় হাওয়া খাওয়া, তালশাঁস, ভরা বর্ষায় তালের বড়া, শরৎকালে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় তালের ফোফোর– যতই তাল গাছ সাপ্লাই করুক আর মিষ্টির দোকানগুলো যতই তালশাঁস সন্দেশ বানাক সারা বছর, নারকেল গাছের মতো কৌলীন্য বেচারি কোনও দিনও পেল না। এমনকী, যে পর্তুগিজদের দেওয়া পাউরুটি নিত্যি সকালে না খেলে প্রাতরাশ অসম্পূর্ণ থেকে যায়, সেই পর্তুগিজরা এদেশ ছেড়ে ফেরত চলে যেত যদি তালের রস ওদের রক্ষা না করত। যে ‘টডি’ দিয়ে ওরা ওদের দেশের ইস্ট-এর শূন্যস্থান পূরণ করেছিল, সেটা তো আমাদের বিশুদ্ধ তালের রস!
কৃষ্ণের কথায় খেয়াল হল, সদ্যোজাত সন্তানের প্রাণ রক্ষা করতে ভরা বর্ষায় বাসুদেব ছেলেকে মাথায় করে হাজির হলেন নন্দ আর যশোদার কাছে। আনন্দের সঙ্গে সেই ছেলেকে আশ্রয় দিয়ে নন্দ উৎসবে মেতে উঠল– কিন্তু উৎসবে খাওয়াবে কি ওই ভরা বর্ষায়? কয়েক মাস আগে হলেও গাছে আম, জাম, কাঁঠালের মতো হরেক ফল ছিল! সেখানেও নন্দের ইজ্জত বাঁচিয়েছিল তাল। তালের বড়া, তালের লুচি, তাল-ক্ষীর এইসব বানানো হল আর উৎসব পালন হল। ‘তালের বড়া খেয়ে নন্দ নাচিতে লাগিল’– কতটা আনন্দে আর কতটা তালের প্রতি কৃতজ্ঞতায়, সেটা ঢাকাই থেকে গেল– তালের কপাল তাল-বেতাল!
শুধু কি এদেশে? তাল এখনও আফ্রিকা মহাদেশ কাঁপিয়ে চলেছে। সেখানে তাল শুধু নিরামিষাশীদের মধ্যে আটকে নেই, মাংস বা মাছ দিয়ে তৈরি সুস্বাদু বাঙ্গা স্যুপ তাল ছাড়া বানানো যায় না। সেখানকার আর এক বিখ্যাত খাবার– নুঙ্গু হচ্ছে তাল দিয়ে তৈরি পুডিং। তাল আফ্রিকা থেকে শুধু এশিয়ায় নয়, লাতিন আমেরিকাতেও পৌঁছে গিয়েছিল। ব্রাজিলের বিখ্যাত ‘আসাই-না-তিগেলা’ তাল জমিয়ে তৈরি করা হয়।
জন্মাষ্টমী এসে গিয়েছে। বাজারে তাল-তাল তাল। দরকারের রকমফের আছে– কেউ কয়েক দিন বাদে ব্যবহার করবে, তবু কিনে রাখতে হবে, তাই কিছু মানুষ শুঁকে দেখে কেনে, কেউ টিপে-টুপে কিনছে। কিন্তু সবই যেন যান্ত্রিক। দোকানে তাল বেশি, মানুষ কম। তালের বড়া বানানোর ঝক্কি নাকি অনেক, তাই অনেকে তেলেভাজার দোকান থেকে বা মিষ্টির দোকান থেকে তালের বড়া বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু জন্মাষ্টমী মানে কি শুধুই তালের বড়া? আজকের শহরে এই দিনের উন্মাদনা সেইভাবে বোঝা যায় না– কিন্তু আমাদের ছোটবেলার গেরস্ত কলকাতায় জন্মাষ্টমীর একটা গন্ধ ছিল– বাড়িতে বাড়িতে তাল মাড়া হচ্ছে। সেটা দিয়ে তালের বড়া, তালের লুচি, তাল ক্ষীর তৈরি হবে। বাড়িতে পুজো হোক বা না হোক, জন্মাষ্টমীর দিন তালের বিভিন্ন পদ রান্না হবেই, যার রেশ থেকে যাবে পরের কয়েক দিন। সেই তালের পদগুলো শুধু নিজের বাড়ির জন্য হত না, প্রতিবেশী আর আত্মীয়দের বাড়িতেও পৌঁছে যেত। পরবর্তীকালে বাংলাদেশে থাকার সময় দেখেছি সেখানে হিন্দুদের দুটো উৎসবে জাতীয় ছুটি– দুর্গা পুজোর দশমী আর জন্মাষ্টমী। সেখানে তালের বড়ার সঙ্গে ধর্ম আটকে নেই– এই দিনে ধর্ম নির্বিশেষে তালের বড়া ভাজা হতে দেখেছি।
এই রে! তালের বড়া নিয়ে লিখতে লিখতে খিদে পেয়ে গেলো– কালকে দেশের বাড়িতে জন্মাষ্টমীর পুজোর বাজার করতে বেরিয়ে দুটো স্বাস্থ্যবান তাল নিয়ে বাড়ি ফিরল গিন্নি। আর ঘুম হবে না রাতে! কবি কি সাধে বলেছেন, ‘বড়ার রাজা তালের বড়া /বাকি সব হিন্দি চুলের বড়া।’
চুলের হিন্দিটা কী যেন বেশ!