লোকটি বিশেষ কেউকেটা নন। এমনকী, বিশেষও নন। দেখা গেল, পাশে একই রকম আরও দু’জন বসে। একটা পিঁড়ির উপর উবু হয়ে। হাঁটুর উপর গোটানো লুঙ্গি। সামনে তারের পৃথিবীর ভিতর অজস্র চাবি। যেন ধ্যানমগ্ন সাধুসন্ত। চৈতন্যের বিশেষ অবস্থায় ঝুলন্ত হয়েই সমাধিস্থ। আর তাঁদের সামনে উপবিষ্ট পরমব্রহ্ম চাবিওলা।
২.
মেসে না-এলে সদর দরজা আমাদের ভিতর ঢুকে পড়ত না।
বাড়িতে যাদের পড়ার ঘর, দরজার সঙ্গে তাদেরই আলাপ। বয়সের সন্ধিতে বন্ধ দরজার অভিসন্ধি চিরকাল খানিক মুচকি হাসি। তবে, বেশিরভাগ ছাপোষা ঘরে পড়ার জায়গা নির্দিষ্ট হলেও, ঘেরাটোপের বালাই নেই। দরজা-তরজা তা-ই নেই বললেই চলে। আর সদরের সংবাদ তো চিরকাল বাড়ির বয়স্কদের দখলে, চাবির গোছাটিও।
মেসের এক দরজা, অনেক চাবি। মেসমালিক একটা চাবি দেন। বাসিন্দাদের তা কপি করে নিতে হয়। এযাবৎ নোট কপি করা আমরা অনেকেই জানতাম না যে চাবিরও জেরক্স হয়। আর হয় যদি তা করেই বা কে! অতএব মন চল যাদবপুর স্টেশন রোড। যাঁরা গেছেন, তাঁরা জানেন। এখানে পাওয়া যায় না এমন জিনিস ভূ-ভারতে নেই। কুল, বকফুল, কানের দুল, সস্তার ব্লাউজ-বারমুডা-নাইটি, ঠাকুরের শাড়ি-গামছা, দশকর্মা, কাশির ওষুধ, বাতের মলম, প্লাস্টিকের হ্যাঙার, মশারির ক্লিপ, দামি ব্র্যান্ডের ছাপ মারা সস্তা ব্যাগ, হামানদিস্তা, পানের বাটা, বাটার জুতো, বেল্ট, ছাতার বাঁট, থালা-বাসন, সোনার গয়না, কোষ্ঠ সাফের দাওয়াই থেকে ভাগ্য ফেরানো শিকড়বাকড় আর লালসুতো– যার যা দরকার। স্টেশন রোড নিজেই একখানা নিত্য প্রয়োজনীয় ভাণ্ডার। গলির মাপে কেটে নেওয়া আকাশটায় মধ্যে মধ্যে লতপত ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের পতাকা। যেন ছাঁচের মাপে কাটা সন্দেশের উপর চিকচিকে রাংতা।
এইটবি বাসস্ট্যান্ড থেকে যাদবপুর স্টেশন পর্যন্ত এই রাস্তাটার দিকে তাকালে দেখা যেত, সর্বক্ষণ দুটো লম্বা মিছিল ভীষণ ব্যস্তসম্মত হয়ে একে অন্যের দিকে তেরছা চাহনি হেনে হনহনিয়ে চলেছে। যেন রাজ্যে এই একদিক থেকে বাম যাচ্ছে, অন্যদিক থেকে আসছে পরিবর্তন। রাস্তা কারও একার না! একদল চলেছে টাইমের ট্রেন ধরতে। অন্যদল যাচ্ছে ট্রেন থেকে নেমে কলকাতা দখল করতে। একখানা পোক্ত সাঁকোর মতো শহর আর শহরতলিকে জুড়ে রেখেছে স্টেশন রোড। তার এক প্রান্তে মা কালী, অন্যদিকে রাধা-কৃষ্ণ। শাক্ত-বৈষ্ণবের মহামিলনে উল্লসিত রিকশার দলের প্যাঁ-পোঁ কীর্তন। গ্রাম আর শহরের মধ্যে ট্রেন না হয় বিপ্লব, কিন্তু স্টেশন থেকে মেন রোড অবধি তো আর ট্রেন চলে না। অতএব এই মহাযোগসূত্রে রিকশারও বড় ভূমিকা, যেন মানুষ আর সমাজতন্ত্রের ভিতর তারা বুদ্ধিজীবী করসেট। ট্রেন ধরার তাড়া হোক আর গাঁটে ব্যথা হোক, রিকশা ভিন্ন গতি নেই। অবশ্য পায়ে-হাঁটা মানুষের ভিড় লেগে বলে ব্যথার মলমও এখানে ফিরি হয় বেশি। একটা চোঙা লাগানো রিকশা একা একা হেঁকে যায়- অবনী ঘোষের বাতের মলম। সে নাকি হাড়ের ভিতর থেকে ব্যথা টে-এ-নে-এ বের করে আনে! কে জানে সব ব্যথার হদিশ মলমের মালুম হয় কি-না!
তখনও সাবওয়ে হয়নি। এইটবি-ও কি আর এমন ঝাঁ-চকচকে এয়ারপোর্ট মার্কা! ফলের দোকানে আপেলের গায়ে ‘ওকে টেস্টেট’ স্টিকার মারার চল নেই। যাদবপুর-গড়িয়া অটোয় পাঁচ টাকা, গোলপার্ক আট। অটোর রং-ও আলাদা। নীল-সাদা বর্ণপরিচয় তখনও হয়নি মহানগরের।
সেই সময়ে এই স্টেশন রোডে একদিন মহাবিস্ময়ে জাগিল আমাদের প্রাণ। সৌজন্যে দেদার ধাক্কা আর মানুষের বিরক্তির চোখা শব্দ। সেই জলজ্যান্ত প্রাণসমারোহের ভিতর আমরা– গেঁয়ো হাওড়া আর মফস্সলি মালদা– প্রথমে খানিক খাবি খেলাম। দেখলাম, জগৎ চলমান, আমরা স্থাণুবৎ। নিজেদের বললাম, এরকম ভেবলে গেলে চলবে কী করে বিশ্বায়নের কমরেড! অতএব একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই হল। সেখানে আবার সম্বোধনের গেরো। এ পর্যন্ত পাড়ায় বয়সে বড়দের কাকা, জ্যেঠু বলে ডাকা অভ্যেস। একেবারে অপরিচিতকে ‘দাদা’ করে নেওয়ার ভাইফোঁটা তখনও অনায়াত্ত। ফলে, ঈষৎ তুতলে-তাতলেই জিজ্ঞাসা, উত্তরও পাওয়া গেল, এবং অবশেষে আমরা খুঁজে পেয়ে গেলাম চাবির জেরক্সওলা।
নাহ্, লোকটি বিশেষ কেউকেটা নন। এমনকী, বিশেষও নন। দেখা গেল, পাশে একই রকম আরও দু’জন বসে। একটা পিঁড়ির উপর উবু হয়ে। হাঁটুর উপর গোটানো লুঙ্গি। সামনে তারের পৃথিবীর ভিতর অজস্র চাবি। যেন ধ্যানমগ্ন সাধুসন্ত। চৈতন্যের বিশেষ অবস্থায় ঝুলন্ত হয়েই সমাধিস্থ। আর তাঁদের সামনে উপবিষ্ট পরমব্রহ্ম চাবিওলা। তিনিই জগৎ চালান, আপাতত বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমি আর আমার বন্ধু দিবাকর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই নিরুত্তাপ বৈরাগী গলায় বলে উঠলেন, ক’টা? আমরা আঙুল তুলে দেখালাম, দুই। মোটে দুই! যে-মেসের জন্য চাবি করাতে যাওয়া, তার এক কামরায় থাকি আমরা দু’জন। নিজেদের কামরার জন্য আমরা একটা তালা কিনেছি, তাতে দুটো চাবি মিলেছে। এখন, সদরের জন্য দু’জনের কাছে দুটো চাবি থাকা দরকার। মালিক আমাদের সেই চাবির ‘মাস্টার’কে হাতে দিয়েছেন। এই যে মাস্টার কী বলা হয়, বাকি চাবিরা তবে সব ইয়োরস ফেথফুলি! চাবির সংসারেও তাহলে প্রভু-ভৃত্য আছে, আছে শ্রেণিবিভাজন!
যাই হোক, সেই মাস্টার চাবিটিকে ভদ্রলোকের হাতে অঞ্জলির ফুলের মতো সমর্পণ করলাম। ভাবছি, এই গুচ্ছ চাবি থেকে এবার দু’খানা চাবি আমাদের দিয়ে দেবেন। কিন্তু হুবহু যে এক হবে, সেটা বুঝবেন কী করে? নির্ঘাৎ কোনও কেরামতি আছে! কী করে জানব যে দেখতে চাবির মতো হলেও তারের ট্রাপিজে ওরা নেহাত ঝুলন্ত সব জোকার! এখনও চাবির মর্যাদাই পায়নি। চাবির মুখটা মিলিয়ে ভদ্রলোক যখন সেখান থেকে পোলট্রির মুরগির মতো দুটোকে টেনে বের করলেন, দেখলাম বেচারাদের মুখ বন্ধ। চাবির ঘাট-ই নেই।
সব চাবি এক ঘাটে জল খায় না। এটাই তো চাবিশিল্পের মোদ্দা কথা। মগজে হাওয়া খেলতে খেয়াল করলাম, কোনওটিরই ঘাট নেই। ঘাট বানানোই ভদ্রলোকের হাতের খেল। সামনে রাখা যন্তরটা যেন ঘানি। অরিজিনাল চাবির সঙ্গে তিনি এক পিস হয়ে-উঠতে-চায় চাবিকে জুতে দিলেন। তার পর আর এক খণ্ড লোহা নিয়ে মাপে মাপে ঘষতে শুরু করলেন। হাতের খেল চলছে, তিনি এ-দিক ও-দিক তাকাচ্ছেন। আর আমরা নিবিষ্ট হয়ে দেখছি আর ভাবছি– আহা, সেলিম-জাভেদ যদি এসে দেখতেন কেমন লোহা লোহেকো কাটতা হ্যায়! মিনিট কয়েকের মধ্যেই তৈরি নতুন চাবি। ভদ্রলোক যন্ত্রের ফাঁস আলগা করে দুটোকে বের করে আনলেন। তারপর নতুনটির ঘেঁটি ধরে আর একটু ঘষাঘষি করে শার্প করতে করতে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন লোহার ধুলো। আমাদের হাতে ঝকঝকে চাবি। একটাই শুধু শঙ্কা, তালা খুলবে তো! তা মেসে ফিরে দেখি, তালা আর নতুন চাবিতে যেন গল্প হচ্ছে– এত কাল যে বসে ছিলাম, পথ চেয়ে আর কাল গুণে… একবার, দু’বার ডান দিকে চাপ, একটু যেন বাধো বাধ– দেখা পেলাম ফাল্গুনে… ব্যস কেল্লা ফতে। তালা-চাবির হেন বাসররাত্রিতে আমাদের মনে সানাই।
মেস আমাদের সাদরে উপহার দিল সদর।
সে-দরজা খোলা আর বন্ধ করা একটা নতুন জিম্মাদারি। ব্যাপারটা মন্দ না! ঘরের ছেলে বাইরে এসেছে। আদরের ঘরের দুলালদের অন্দর থেকে দায়িত্ব এবার সদরেও। তার উপর বিষয়টা গুরুতর। ভুল হলে সবারই বিপদ। চোর-ছ্যাঁচোড়ের তো আর অভাব নেই। কিন্তু ক’টা তেলচিটে গামছা আর হাফ প্যান্ট চুরি করতে চোরই যে বা কেন আসবে, সে কূটচিন্তা সেদিন মাথায় আসেনি। অতএব সমারোহে সে-দায়িত্ব নেওয়া গেল দশের স্বার্থে। আপন হতে সেই বোধহয় একটু বাহির হয়ে আসা।
বাহির হয়ে আসার অবশ্য একপিস বিপদ আছে। বাড়ির দৌলতে এ যাবৎ যা খেয়াল করা হয়নি। কলেজ পড়ুয়াদের মেসে মাসি সাধারণত চলে আসে সকাল-সকাল। এদিকে বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ পেয়াদারা তখনও ঘুমে কাতর। আর্ত মাসির নাদ শোনা যায় বাইরে থেকে। কখনও বাইরের কাঠের দরজায় ল্যাচের ধাক্কা। খটখট শব্দে ঘুম ভাঙে। আর সেই ভাঙা ঘুমে সকলেরই মালুম হয় যে, দারুণ পুরুষোচিত অস্বস্তিতে তীব্র জেগে আছে নতুন একখানা সকাল। সুতরাং কে প্রথম বাহির হবে সে এক বিটকেল সমস্যা। ক্লায়েন্টদের কাছে সময় চেয়ে নেওয়ার কর্পোরেট বুকনি তখনও জানাই ছিল না। অতএব সেই সমবেত অস্বস্তির ভিতর থেকে পরিত্রাণ আর অসহায়তার মিলিত বয়ান হিসাবে আধো অন্ধকার ঘর থেকে ঘনিয়ে উঠত সময়-প্রার্থনার একটিই সোচ্চার আর্তি–
আআসছি…
…………………………………………………..
প্রথম পর্ব: মেস এমন দেশ যেখানে বাঁধাকপির পৃথক আত্মপরিচয় চিবিয়ে নষ্ট করা যায় না
…………………………………………………..