ইংরেজি আর রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতার সীমায় আটকে পড়া বাংলা কবিতাকে মুক্ত করতে ১৯৬৫-র এপ্রিলে শ্রুতি কবিতা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে প্রথম প্রকাশ পায় ‘শ্রুতি’ পত্রিকা। প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের তাত্ত্বিক নেতা পুষ্কর দাশগুপ্ত। অভিনব আঙ্গিকে লেখা তাঁর ‘সূর্যস্তোত্র’ কবিতাটি মনোজ্ঞ পাঠক একবার পড়ে বাতিল করতে পারবেন না।
সেই ছয়ের দশকের গোড়ার দিকে রাসবিহারীর মোড়ে ‘অমৃতায়ন’-এর সামনের রোয়াকে ফি-রোববারের জমজমাট আড্ডায় পবিত্র মুখোপাধ্যায়, রমানাথ রায়, অমল চন্দ, কল্যাণ সেন, সুব্রত সেনগুপ্ত, আশিস ঘোষ, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, পরেশ মণ্ডল, শেখর বসুদের মতো একঝাঁক তরুণ সাহিত্যিকের ভিড়ে মিশে থেকেও বুদ্ধির দীপ্তিতে মাঝেমধ্যেই উজ্জ্বল হয়ে উঠতেন যিনি, তিনি আজ ভিনদেশি তারা; কবি পুষ্কর দাশগুপ্ত! গ্রিসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই বাঙালি কবি। বিগত কয়েক দশক ধরেই তিনি ছিলেন সেখানকার বাসিন্দা।
বিশ শতকের ছয়ের দশকে যে ক’টি মেধাবী মস্তিষ্ক বদলে দিতে চেয়েছিলেন বাংলা গল্প-কবিতার হাল-হকিকত, পুষ্কর ছিলেন তাঁদের অন্যতম পুরোধা! আড্ডার আখড়া থেকে সাহিত্য আন্দোলনের খসড়া– সর্বত্রই ছিল তাঁর আত্মমগ্ন উজ্জ্বল উপস্থিতি। অমৃতায়ন-সুতৃপ্তি কিংবা কফি হাউসের এমনই সব আড্ডায় পবিত্র মুখোপাধ্যায়, রমানাথ রায়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বয়ে যেত পুষ্কর দাশগুপ্তর কথার স্রোত! যে স্রোতে ভেসে আসতেন মালার্মে, অ্যাপলনিয়ার, মায়াকোভস্কি, পল ভলেরি থেকে অমিয় চক্রবর্তী! বরাবরই বিদেশি কবিতার রীতি-প্রকৃতির প্রতি অসম্ভব আগ্রহ ছিল পুষ্করের। পাশ্চাত্য সাহিত্য আন্দোলনগুলি সম্পর্কে ছিল গভীর অনুধ্যান! কবিতার তত্ত্ব নিয়ে অনর্গল বলে যেতে পারতেন তিনি। পুষ্করের এই প্রবণতা প্রশ্রয় পেয়েছিল। তাঁর আগ্রহে আশকারা দিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন পরেশ মণ্ডল, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, অনন্ত দাশ, মৃণাল বসুচৌধুরী। ছয়ের দশকের মাঝামাঝি গড়ে উঠেছিল বাংলা কবিতার আন্দোলন ‘শ্রুতি’। পুষ্করের নেতৃত্বেই বাংলা কবিতার অবয়বে এসেছিল দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন!
ইংরেজি আর রাবীন্দ্রিক রোমান্টিকতার সীমায় আটকে পড়া বাংলা কবিতাকে মুক্ত করতে ১৯৬৫-র এপ্রিলে শ্রুতি কবিতা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে প্রথম প্রকাশ পায় ‘শ্রুতি’ পত্রিকা। প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের তাত্ত্বিক নেতা পুষ্কর দাশগুপ্ত। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য এবং বিশ্বাসকে প্রথম সংখ্যা থেকেই প্রবন্ধের আকারে গেঁথে তুলতেন পুষ্কর। ‘জৈব আর্তনাদ কিংবা সমাজ চিন্তার স্থান যেখানেই হোক, কবিতায় নয়। কবিতা কবির উপলব্ধি বা আত্মিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ।’– কবিতা সম্পর্কে পুষ্করের এমনই আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণে পথ চলা শুরু করেছিল ‘শ্রুতি’। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, ১৯৬৫-র এপ্রিল থেকে ১৯৭১-র আগস্ট পর্যন্ত প্রকাশিত ‘শ্রুতি’-র মোট চোদ্দোটি সংখ্যার একটিরও সম্পাদক নন পুষ্কর! অথচ পুষ্করই ছিলেন এ আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। ‘শ্রুতি’-র প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ তাঁরই নির্মাণ।
বহমান বাংলা কবিতাকে আক্রমণ করার জন্য কেবল তত্ত্ব খাড়া করা নয়, ‘শ্রুতি’র প্রথম সংখ্যা থেকে সৃষ্টিতেও পুষ্কর ছিলেন সমান উজ্জ্বল। অভিনব আঙ্গিকে লেখা তাঁর ‘সূর্যস্তোত্র’ কবিতাটি মনোজ্ঞ পাঠক একবার পড়ে বাতিল করতে পারবেন না। উপলব্ধ বিষয়ের সঙ্গে উপস্থাপনের এহেন কৌশলই আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন পুষ্কর-সহ অন্যান্য শ্রুতি আন্দোলনকারী।
প্রতিষ্ঠা কিংবা প্রতিষ্ঠান কারওরই তোয়াক্কা করতেন না পুষ্কর। সৃষ্টির ক্ষেত্রে উপভোগ করতে চাইতেন শিল্পীর চরম স্বাধীনতা। পুষ্কর বিশ্বাস করতেন, ‘মুদ্রণ-বিন্যাসে দৃষ্টিগ্রাহ্যতা সৃষ্টি বাংলা কবিতায় চর্চার দ্বারা জীর্ণ হয়নি বলেই তা প্রকরণ হিসাবে অকর্ষিত ভূমির মতোই সম্ভাবনাপূর্ণ।’ সে সম্ভাবনার পথেই এগিয়ে গিয়েছেন পুষ্কর। ‘এখানে আমি’, ‘শব্দ শব্দ’, ‘কলিকাতা সমাচার’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে আচরিত সাহিত্যিক আদর্শ এবং বিশ্বাসকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন।
ফরাসি ভাষায় অসম্ভব দখল ছিল পুষ্কর দাশগুপ্ত-র। ফরাসি সাহিত্যের প্রতি নিবিড় অনুরাগ থেকেই তিনি আমৃত্যু জড়িয়েছিলেন সে বিদেশিনীর সঙ্গে! নিভৃতে এবং প্রায় নীরবেই ফরাসি সাহিত্যের যেসব অবিস্মরণীয় অনুবাদ তিনি করে রেখে গেছেন, তা তো তাঁর আজীবন সাহিত্য প্রেমেরই দোসর। ভলতেয়ারের অনুবাদ তো বটেই, বিশ শতকের আটজন ফরাসি কবির কবিতা অনুবাদ কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রেও তিনি কতটা পরিশ্রমী, কতটা নিষ্ঠাবান, কতখানি অনুসন্ধানী, তা অনুভবী পাঠক মাত্রই বুঝতে পারেন।
‘অবিরল ধ্বনি শুনি
ব্যাকুল বৃষ্টি…
নিঃসঙ্গ পাতাল এই,
অন্তরালে নিহিত অদৃশ্য তরঙ্গ
নীলাভ স্রোত–
এই মায়াবী আকাঙ্ক্ষার অনিকেত তরণীতে–
আমি একা… একা…’
পুষ্কর দাশগুপ্তর এই লাইনগুলি ভীষণ মনে পড়ছে আজ। শ্রুতি আন্দোলন গড়ে ওঠার কয়েক বছর আগেই পুষ্কর লিখে ফেলেছিলেন এ কবিতা। ছাপা হয়েছিল ‘এই দশক’ বুলেটিনে। সাহিত্য জীবনের সূচনাতেই কীভাবে যেন লিখে ফেলেছিলেন শেষ জীবনে নিভৃত কথন!
পুষ্কর দাশগুপ্তর অলংকরণটি অর্ঘ্য চৌধুরীর সৃজন
বাংলা ভাষা সেই পাঁচের দশকে যদি বারীন ঘোষের ‘ছিন্নমূল’, সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’, ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’-এর (যেহেতু ‘নাগরিক’-এর মুক্তি পরে) জন্ম দিয়ে থাকে, তাহলে ১৯৬৯ সালে মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ ভারতীয় নববসন্তের অস্তিত্ব জানান দিল।