আমাদের মাঝে তিনি বিরাটই একজন। আমার কিছু আক্ষেপই আছে। যত্ন সহকারে কমলদা কবিতা লেখেননি। কবিতা লিখেছেন ছেঁড়া ছেঁড়াভাবে। গদ্য লিখেছেন দানবীয় তৎপরতায়, ভাষায় তাণ্ডবও ঘটিয়েছেন। আমি তাঁর গদ্য ইতিউতি ঠুকরে দেখলেও, তেমন কিছু বলতে পারব না। সে বিষয়ে আমার মনও নেই। মনোনিবেশ ছাড়া আগ্রহ জন্মে না। কিন্তু কমলদার কবিতা সম্পর্কে আমার আগ্রহজাত হাহাকার রয়েছে। ওই যে তাঁর কবিতাগুচ্ছ পড়েছিলাম, ৮০-র দশকে কোনও এক সময়, ‘বেসিনের ভেতরে বক এসে বসে আছে’– এসব কবিতার বিস্তার ঘটাননি কমলদা। বরং তিনি বার বার কবিতা থেকে বিযুক্ত হয়েছেন।
প্রচ্ছদের স্থিরচিত্র: শংকর লাহিড়ী
কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে সেই ১৯৭২ সালে কমলদার সঙ্গে যখন আমার প্রথম সাক্ষাৎ হল, সে যেন সুঠাম এক ঢিবির কাছে আমি ফিনফিনে এক ড্রাগন ফ্লাই, টুকটুকে লাল রোগা ফড়িংটি। আমি সবে হায়ার সেকেন্ডারি উতরোনো কিশোরটি, কমলদা টাটার তরুণ প্রকৌশলী। তা ওই পয়লা দিনটি থেকেই কমলদা আমাকে ওই ঢিবির ওপর বসতে দিয়েছিলেন। ‘কৌরব’ ওই গোড়ার যুগ থেকেই বরাবর শক্তি-সুনীল-সন্দীপন, শক্তি-সুনীল-সন্দীপন করত, আর আমাদের পত্রিকাগুলিতে আমাদেরই কবিতা ছাপা হত, বড়দের নয়– শুধু ভাস্কর চক্রবর্তী আর মণীন্দ্র গুপ্তকে আমাদের মনে হত সমবয়সি। খুব খোঁচাতাম কমলদাকে। আমাদের দু’জনের ছিল বরাবরের অম্লমধুর সম্পর্ক। কমলদা, কমল চক্রবর্তী ছিল তারুণ্যে ভরপুর হইহল্লার মানুষ, আদর্শিক একাগ্রতা তাঁর ছিল বলে মনে হয় না। এরপর তিনি বৃক্ষনাথ, তিনি ভালোপাহাড়ের পত্তনকারী– এসবে আমার মন নেই, আমার কাছে, অনেকের কাছেও কবিত্বই সুপ্রিম, অল্পবয়সে তিনি ওই কহকের অভিযাত্রী ছিলেন, ছিটকে গিয়েছেন, অথবা খসে পড়েছেন, ভালোপাহাড়ে।
আশ্চর্যের কথা হল, বছর দুই আগে কমল চক্রবর্তীকে নিয়ে একটি পত্রিকা প্রকাশের কথা ছিল, ওই পত্রিকার জন্য আমি একটি লেখা লিখি, যেটির শিরোনাম দিই: কমলদার জন্য হাহাকার। পত্রিকাটি বের হয়নি। কমল চক্রবর্তীর প্রয়াণে মন হাহাকার করছে। ছল ছল করছে চোখ দু’টি। ওই লেখাটিই আপনাদের পড়তে দিচ্ছি।
ঢাকায় শ্যামলীতে কবি শামসুর রাহমানের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে কথা বলছি, সেটা ১৯৮৬ সাল, এমন সময় পোস্টম্যান এসে রাহমানভাইকে দিলেন একটি চিঠি। খামের ওপর ভারতের ডাকটিকিট দেখে, বুঝলাম আমাদের দেশ থেকে এসেছে সে চিঠি। চিঠি খুলে পড়তে পড়তে হো হো করে রাহমানভাই হাসতে লাগলেন। আমার কৌতূহল দেখে চিঠি পড়া শেষ করে হাসতে হাসতেই রাহমানভাই আমার দিকে চিঠিটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, দেখ দেখ কমল আমাকে ব্রাহ্মণ বলে প্রণাম ঠুকে কবিতা চেয়েছে। শামসুর রহমানকে লেখা কমলদা, কমল চক্রবর্তীর ওই চিঠির কিয়দংশ আমি এখন কমলদার বানান-সহ স্মরণ করছি:
মাননীয় কবি শামসুর রহমান/ হে বাহমন/ আপনি একজন শ্রেষট বাহমন। কৌরব পত্রিকার জন্য আপনার কাছে একগুছছো কবিতা প্রার্থনা কোরছি। কবিতা চাই-ই। জানি হে বাহমন, আপনি নিরাস করবেন না।…
আমার মনে পড়ে গিয়েছিল, ধূর্জটি চন্দও খুব হাসাহাসি করেছিলেন কমল চক্রবর্তীকে নিয়ে। সে হল ১৯৭২ সাল। কমলদার পাঠানো একগুচ্ছ কবিতা আমার হাতে ধরিয়ে ধূর্জটিদা হেসে বলেছিলেন, দ্যাখ কবিতাগুলোর শেষে নিজে লিখেছে, বানামগুলো ঠিক করে দিস ধূর্জটী, আমি বানাম একদম জানি না।
আমি সে কবিতাগুলিতে দেখেছিলাম কমলদা ‘প্রজাপতি’ বানান লিখেছেন দীর্ঘ-ঈ দিয়ে ‘প্রজাপতী’, ‘নীরব’ লিখেছেন ‘নিরব’…।
বরাবর, খেলিছে… বিরাট শিশু আনমনে, কমলদা এমনটিই করে যাচ্ছেন। আমাদের মাঝে তিনি বিরাটই একজন। আমার কিছু আক্ষেপই আছে। যত্ন সহকারে কমলদা কবিতা লেখেননি। কবিতা লিখেছেন ছেঁড়া ছেঁড়াভাবে। গদ্য লিখেছেন দানবীয় তৎপরতায়, ভাষায় তাণ্ডবও ঘটিয়েছেন। আমি তাঁর গদ্য ইতিউতি ঠুকরে দেখলেও, তেমন কিছু বলতে পারব না। সে বিষয়ে আমার মনও নেই। মনোনিবেশ ছাড়া আগ্রহ জন্মে না। কিন্তু কমলদার কবিতা সম্পর্কে আমার আগ্রহজাত হাহাকার রয়েছে। ওই যে তাঁর কবিতাগুচ্ছ পড়েছিলাম, ৮০-র দশকে কোনও এক সময়, ‘বেসিনের ভেতরে বক এসে বসে আছে’– এসব কবিতার বিস্তার ঘটাননি কমলদা। বরং তিনি বার বার কবিতা থেকে বিযুক্ত হয়েছেন।
সর্বদাই আমি আমার অপরূপ সময়সঙ্গীদের বর্ণিল বিচ্ছুরণ, বিদ্যুৎচ্ছটায় মুগ্ধতা প্রকাশ করেছি, এই বয়সে এখনও করি। আমার সখারা বাংলা কবিতায় রৌদ্রপ্লাবিত প্রান্তর, কুয়াশাচ্ছন্ন অরণ্য, গিরিমালা, ধূ ধূ মরুভূম, টল টল সরোবর, চকিত রামধনুটিও সৃষ্টি করেছেন। বিপুল গদ্যরচনায় হাবুডুবু কমলদা কবিতা থেকে আত্মবিযুক্ত হলেও ওই ছায়া-পড়া বনরাজিতে কি বা গুহাকন্দরে স্থানে স্থানে কমল চক্রবর্তীর কয়েক গুচ্ছ কবিতা রয়েছে।
……………………………………………………………………….
কমল চক্রবর্তীর আরও একটি স্মৃতিলেখ: উদাসীন গাম্ভীর্যের আড়ালে কমলদা আপাদমস্তক এক জীবনরসিক
……………………………………………………………………….
আমার মনে পড়ছে ‘জল’ কাব্যগ্রন্থটি। ছাইরঙা হ্যান্ডমেন্ড পেপারের মলাট। পুরুলিয়ার সাহেব বাঁধে ১৯৭৪ সালের এক মধ্যরাতে তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। টাটাবাবা লোহা লিলে… দুখার মায়ের বুকের থিকে/ মহুল গাছের ছায়া লিলে কেন?
সম্ভবত ১৯৭২ সালে এক সন্ধ্যায় কলেজ স্ট্রিটে কফিহাউসে আমরা যখন দু’টি টেবিল জুড়ে প্রবেশ দরজার কোণের দিকটিতে বসি, তুমি এলে কমলদা, গাঢ় নীল ব্লেজার পরা, তাতে পেতলের বোতাম, মুখে দাড়ি, নাবিকের মতো দেখতে, ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মতো দাড়ি,পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল আলাপ করালেন সবার সঙ্গে। ওই বছরেই কমল চক্রবর্তীর কবিতা:
তুমি স্বপ্ন নও রক্তচন্দন
রুয়াম জঙ্গল থেকে প্রবাদের ডানাকাটা পরী গতরাতে এসেছে শহরে…
যদুগোড়া জঙ্গলে সে সময়ই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন নকশালপন্থী ব্রিটিশ তরুণী মেরি টাইলার। কবিতাটি তাঁকে কেন্দ্র করে।
বিষণ্ণ মনে কমল চক্রবর্তীর আর একটি কবিতারও দু’-একটি পংক্তি স্মরণ করি, ‘জামশেদপুরে বর্ষা’ নামের কবিতাটি ১৯৭৩ সালের:
কতকাল পরে ফের সবাই বসেছি মুখোমুখি
প্লেটে প্লেটে গরম খিচুড়ি চালানি মাছের পেট
……..
আমরা সবাই আজ বৃষ্টি মাথায় করে মদ খাব
পুরোনো সাইকেল নিয়ে বহুদূর চাইবাসা
বেড়াতে বেরোবো।
এবার উল্লেখ করছি ১৯৭৬ সালে লেখা কমলদার ‘দুটি বিপরীত দৃশ্য’ নামের কবিতাটির কয়েকটি পঙক্তি, যাতে ‘বক্তৃতা’ শব্দটি কমলদার বানান ভুলে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মণীন্দ্র গুপ্ত ও রঞ্জিত সিংহ সম্পাদিত ‘এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা ১৯৭৬’-এ এই কবিতাটি নির্বাচিত হয়েছিল, তাঁরা কমল চক্রবর্তীর ‘বক্তিতা’ শব্দটি সংশোধন করেননি,অর্থাৎ তাঁরা এই তাৎপর্য অনুধাবন করেছিলেন:
দেশ বিষয়ক আমার শেষ বক্তিতার মধ্যে
হাড়ি বাজিয়ে গান গেয়েছিল এক অন্ধ ভিখারি
…………………… …
বেশী রগড় করলে বক্তিতার গাম্ভীর্যই মার খেয়ে যায়
…………………………….. …………
বক্তিতার মধ্যিখানে এক ঝাঁক শালিক
ঢুকেছে ফুরফুরে
চিরকিশোরটি, কমল চক্রবর্তী ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে কবিতা লিখেছেন। সংগঠক মানুষ তিনি। যে মনোনিবেশে তিনি কৌরব পত্রিকা এখনও সম্পাদনা করছেন, শরীর নিংড়ে সুবিশাল গদ্যরচনায় প্রাণ ঢেলেছেন, ঝাঁপিয়ে পড়ে ভালো পাহাড় গড়েছেন, কবিতা সে মনপ্রাণ পায়নি।
হাহাকার করব না?