বিশ্বায়ন-উত্তর বলিউডে গণস্বপ্নের বয়ান নির্মাণ হয়েছিল তাঁর স্টেশন ছেড়ে যাওয়া ট্রেন থেকে বের করে দেওয়া হাতে। যে নায়ক মরণোন্মুখ হয়ে, অসুখের খাদের কিনারে এসেও মুখে রাখতেন আকাশ-সমান চওড়া হাসি– সেই নায়কই হয়ে উঠেছেন গোটা দেশের পড়শি, অথচ তাঁর জ্যোতির্বলয় থেকেছে অটুট।
‘দেবতা এদেশে মানুষ হয়েছে জানি/ মানুষকে দেখি গণদেবতার বেশে’– ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের অ্যালবামে রুমা গুহঠাকুরতার কণ্ঠে এভাবেই দেশের স্বরূপ চিনেছিলাম আমরা। তারপর গঙ্গা-যমুনা-ভাগীরথী দিয়ে বহু জল বয়েছে, বয়স বেড়েছে স্বাধীনতার, খোলাবাজার অর্থনীতি আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এই দেশের শরীরে নতুন মাটি লেপেছে। ক্রমে গণদেবতার এই আখ্যান পাল্টে গেছে। আর ওই মুক্ত অর্থনীতি যখন দখিন দুয়ার খুলে পা রেখেছিল, ঠিক সেই সময়ই দেশের সিনেমা-মহাকাব্যে নায়কের জন্মের সোপানে লেখা হয়েছিল একটা নাম। অ্যান্টিহিরো থেকে কিঞ্চিৎ ক্যাবলা হয়ে ওঠা সেই নায়ক অ্যাংরি ইয়ং ম্যান ছিলেন না মোটেই, বরং দু’বাহু মেলে দাঁড়ালে একটা গোটা দেশ চিনে নিত মোহব্বতের ইশারা। সেই অলীক হয়ে ওঠা শতাব্দীর শেষের পর তিন দশক পেরিয়ে এসে যখন বড়পর্দায় উত্তর-পূর্বের এক পার্বত্য আদিবাসী গ্রামের পূজনীয় কাল্ট দেবতার ওপর পাহাড়ের চূড়া থেকে বিপুল কায়া হয়ে এসে দাঁড়াচ্ছেন মুখজুড়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা সেই ছায়ানায়ক, আর সেই অদর্শনেই হলজুড়ে হাততালির বিস্ফোরণ, সিটির দামামা কানে স্পন্দন জাগাচ্ছে, তখন বাংলা গানের ওই পঙ্ক্তিই বেজে উঠছে মগজে।
শুধু তফাত এটুকুই, এই নায়ক জখম, বিক্ষত। এখন ফেসবুক-টুইটারের চণ্ডীমণ্ডপে যখনতখন তাঁকে বিঁধে ফেলা যায় ধর্মীয় বিদ্বেষের বিষমাখানো তিরে। তাঁর শস্যশ্যামলা প্রান্তরে দাঁড়ানো হাত ছড়ানো ভালবাসার ডাকের উত্তরে ছিটিয়ে দেওয়া যায় ঘৃণার গরল। এক বলিউড অভিনেতার আত্মহত্যাকে ঘুঁটি করে পাকিয়ে ওঠা বলিউড বয়কটের সেনাদল ছেলের গ্রেফতারিকে হাতিয়ার করে মাথা হেঁট করাতে চায় কোটি কোটি ভারতবাসীর ‘দিলওয়ালে’-র। সেই খোঁচা খাওয়া চিরকালীন ভালবাসার বাঘকে তাই জঙ্গলের রাজত্ব পুনরুদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয় বর্শা হাতে, নেপথ্যে তখন বিদ্যুৎ চমকায়। এই প্রায়-পৌরাণিক আবির্ভাব মনে করিয়ে দেয় জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার সেইসব নায়কদের, যাঁরা দেশের সমষ্টিগত অচেতনে অচিরেই হয়ে উঠেছিলেন মসিহা, ত্রাতা। মনে হচ্ছে, হেরো, বিধ্বস্ত ব্যাটম্যান, ডার্ক নাইট, এসেছেন পোড়া গথামকে উদ্ধার করতে।
দক্ষিণ ভারতীয় ছবি গতিপথ বদলে প্যান ইন্ডিয়ান হচ্ছিল সেই মণিরত্নম জমানা থেকেই। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে বলিউডের পর্বতকেই আসতে হয়েছে এককালীন মহম্মদ দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার কাছে। শাহরুখ খানের মতো নামকেও দক্ষিণমুখী হতে হয়েছে, কাঁচাপাকা চুল-দাড়িতে চুরুট ঠোঁটে স্পেয়ার পার্টস হাতে তাঁর আবির্ভাব হয় আসল নায়কের বাবা হিসেবে, ইন্টারভালের ঠিক আগে। ছবি শেষের আগে সেই বাবাকেই দিতে হয় সেই অমোঘ ডায়লগটা, ‘বেটে কো হাত লাগানে সে পহলে, বাপ সে বাত কর।’ এভাবে নিজের হয়ে জবাবদিহি শাহরুখের করার কথা ছিল? দরকার ছিল, এভাবে সরব হওয়ার? ছিল। কারণ সময় তাঁর চিরাচরিত ইমেজের প্রাসাদে ভাঙন ধরিয়েছে, মান্নতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়া আলোকবর্তিকাকে ম্লান করেছে। তাঁকে এবার ফিরতে হত এমনভাবেই, যেখানে বোঝানো যায়, কেবলই তিনি সব বিলোনো প্রেমিক নন, প্রয়োজনে তিনিও পারেন লড়তে।
বিশ্বায়ন-উত্তর বলিউডে গণস্বপ্নের বয়ান নির্মাণ হয়েছিল তাঁর স্টেশন ছেড়ে যাওয়া ট্রেন থেকে বের করে দেওয়া হাতে। মাফিয়াকে গান শুনিয়ে খুশি করে অপ্রত্যাশিতভাবে নম্বর বাড়িয়ে তারপর সকলের সামনে চোখের জলে নিজের মিথ্যে কবুল করতেন যে নায়ক, যে নায়ক মরণোন্মুখ হয়ে, অসুখের খাদের কিনারে এসেও মুখে রাখতেন আকাশ-সমান চওড়া হাসি– সেই নায়কই হয়ে উঠেছেন গোটা দেশের পড়শি, অথচ তাঁর জ্যোতির্বলয় থেকেছে অটুট। তিনিই সাহস দেখিয়েছেন অটিস্টিক নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সোচ্চারে ঘোষণা করতে, ‘মাই নেম ইজ খান, অ্যান্ড আই অ্যাম নট আ টেররিস্ট।’ এই ‘খান’ পদবিটুকু ছবির শিরোনামে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে যখন, তখন চরিত্র নয়, কথা বলেছেন তিনি।
‘ওম শান্তি ওম’-এর সময় থেকেই শুরু হয়েছিল তাঁর নিজের তারকা সত্তাকে উদ্যাপনের আশ্চর্য আলোঝলমল অধ্যায়। কিন্তু গ্লোবাল গ্রামে সব আলোই ক্ষণস্থায়ী। ‘ফ্যান’-এ এসে এই শাহরুখই যখন নিজের স্টারডম নিয়ে ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে বিপজ্জনক খেলাটা খেললেন, তখন তিনি পার পেলেন না। ‘ডর’-এর সাইকোপ্যাথ শাহরুখ, ‘ডুপ্লিকেট’-এর ভাল শাহরুখ, মন্দ শাহরুখ কিন্তু ছিলেন, তাও তাঁকে দেখেই দর্শকের কানে বেজে উঠেছে ‘তুম পাস আয়ে, ইঁউ মুসকুরায়ে’-র নস্টালজিক সুরলহরী। সেই সুরে তো শুধু শাহরুখ নেই, আছে ফেলে আসা নব্বই, আছে এসটিডি বুথগুলোতে ফেলে আসা অনেক নিরুত্তর ফোন কলের চাপা কান্না, অনেক না লেখা চিঠির ঝড়। সেই নব্বইয়ের গোড়ায়, যখন এই বঙ্গে কলামন্দিরের বেসমেন্ট কলাকুঞ্জে ‘তোমাকে চাই’ নামে একটি ক্যাসেট বদলে দিয়েছে বাংলা গানের গতিপথ, হলদেটে মলাটবন্দি ‘হারবার্ট’ নামে একটা উপন্যাস অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে ফেলেছে বাংলা সাহিত্যের রাজনীতির অন্দরে, ধীরে ধীরে ভারতীয় ক্রিকেটভুবনে জ্বলে উঠেছে শচীন তেণ্ডুলকর নামটা, তার আশপাশের সময়েই তো সেই ‘ডর’-এর লালচোখো খুনে নেশাড়ুকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এসেছে ম্যান্ডোলিন কাঁধে নেওয়া আকুল চোখের প্রেমিক, যে দূর থেকে অস্ফুটে প্রেমিকাকে ফিরে তাকাতে বলে। এমনই ছিল সেই প্রেমিক শাহরুখের জোর, আপাদমস্তক প্রবঞ্চক, লম্পট, হিমশীতল ঘাতক ডনকেও হয়ে উঠতে হয় নায়ক, নায়িকা (প্রিয়াঙ্কা চোপড়া) তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েও প্রেমের হাতছানি এড়াতে পারে না। ‘ফ্যান’-এ দেখা গিয়েছিল সেই দেশকাঁপানো দেবদাস, দিওয়ানা আশিক আসলে কাষ্ঠহাসির সিন্থেটিক নায়ক, হয়তো আলতো ভণ্ডও। আর তার ভক্ত হয়ে উঠছে সেই তার কেরিয়ারের শুরুর চরিত্রগুলোর মতো বিকৃত, ভালবাসার সার্থকতার জন্য প্রয়োজনে অপরাধের আশ্রয় নিতেও যে দ্বিধা করবে না। এই জটিল সমীকরণ তাঁর ভক্তকুল মেনে নেবে কেন?
মেনে নেয়নি। তাও শাহরুখ ক্রমে নিজের বর্ম আলগা করেছেন। বয়সকে আসতে দিয়েছেন, আলিয়া ভাটের প্রেমপ্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন রিলে। কোথাও কোথাও বার্তা দিয়েছেন, এবার বুঝি প্রাক্তন হওয়ার সময় এল। বলেছেন অসহিষ্ণুতার কথা প্রকাশ্যে। ড্রাই স্টেট গুজরাতে মদ বেচা ডনের চরিত্রে এসেছেন যখন, তখন গুজরাতের শাসকরা কেন্দ্রে ক্ষমতায়। শাহরুখ বেপরোয়া হয়েছেন। তাই ‘পাঠান’-এর সূত্রে তাঁর কিংবদন্তিসম কামব্যাকের পর সোচ্চারে বলেছেন ‘সেকুলারিজম’-এর কথা। আর তা বলেছেন চালু বলিউডি ধাঁচে, ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’-র উল্লেখ করে। ‘ওম শান্তি ওম’-এ তাঁর পূর্বজন্ম ছিল সত্তরের বলিউড, যেখানে শাহরুখের চরিত্র স্বপ্ন দেখা, স্ট্রাগল করা জুনিয়র আর্টিস্টমাত্র। ‘পাঠান’-এ তিনি বলছেন, তাঁর জন্মের সঙ্গে সিনেমা হলের সম্পর্কের কিসসা। শাহরুখ গণস্মৃতিকে নির্মাণ করতে চাইছেন সিনেমা দিয়ে। কারণ সিনেমাই রাজনীতির বিভেদচক্রর বিরুদ্ধে বজায় রাখতে পারে শাশ্বত মিলনের আখর। হয়তো চাইছেন পরিচালকরা, চিত্রনাট্যকাররা, কিন্তু শাহরুখ সচেতনভাবেই তার মাধ্যম হয়ে উঠছেন না কি?
আশিস নন্দী তাঁর পপুলার সিনেমা সংক্রান্ত সন্দর্ভে বলেছিলেন, ভারতীয় আধুনিকতার কাছাখোলা, শালীনতার ভণিতাহীন চেহারা, আবার জটিলতায় মোড়া আভিজাত্যর আসল প্রতিফলন ঘটে জনপ্রিয় সিনেমাতেই। আধুনিকতাকে চেনায় এই জাতের চলচ্চিত্রই। ‘জওয়ান’-এর শাহরুখ তাই সেই আধুনিকতার রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করতে চাইছেন। কিন্তু যা মজার, তা হল, জনমানসে যে মতপ্রবাহ বেশি প্রভাব রাখতে পারে, তাকে শাহরুখ উৎখাত করছেন। শাহরুখের কমরেড হয়ে উঠছে আত্মঘাতী কৃষকের মেয়ে। শাহরুখ তাঁর হয়ে সওয়াল করছেন এই বলে, যে, মার্সিডিজ গাড়ির কারখানা একজন কৃষকের থেকে বেশি ছাড় পায় কৃষিঋণে। যাঁরা পি সাইনাথের লেখাপত্র ও কথাবার্তা বিষয়ে অবগত, তাঁরা জানবেন, মূলস্রোতের সাংবাদিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে সাইনাথ এইসব কথা জানিয়ে গেছেন অক্লান্ত। সেই কথা খোদ শাহরুখের মুখে ভারতবাসী শুনছে বড়পর্দায়। দেখা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরের একটি হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর সেই কালান্তক ঘটনার ছায়া, যে ঘটনার দায় নিয়ে জেলে যেতে হয়েছিল কাফিল খানকে, যে কাফিল খান আদতে ওই শিশুদের বাঁচাতে চেয়েছিলেন, পঙ্গু সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকে আঙুল তুলেছিলেন। নির্বিবাদে দেশদ্রোহের গড়ে তোলা বুদবুদকে নস্যাৎ করছেন শাহরুখ। বলছি শাহরুখ করছেন, আদতে করছে আজাদ– হ্যাঁ, এই ছবিতে শাহরুখ খানের চরিত্রের এইটিই নাম। ভিলেনকে (বিজয় সেতুপতি) সরাসরি ‘দেশ বেচনেওয়ালো’ বলছে আজাদ। যা যা বললে এই মুহূর্তে দেশের চলতি রাজনৈতিক পরম্পরার বিরুদ্ধাচরণ হয়, সেই সব নির্দ্বিধায় বলেন শাহরুখ। এবং শেষত চতুর্থ দেওয়াল প্রায় ভেঙে তিনি দাঁড়ান দর্শকের সামনে। বলেন, যে আঙুল দিয়ে ভোট দিচ্ছেন, সেই আঙুলই তুলুন সরকারের দিকে। ২০২৪-এর ভোটের আগে দক্ষিণী পরিচালক অ্যাটলি এই বার্তাই আসলে দিতে চাইছিলেন হয়তো, কিন্তু অবিশ্বাস্য এটাই, সেই বার্তাবাহক হয়ে উঠলেন এই উপমহাদেশের সম্ভবত শেষ সুপারস্টার। আর আসমুদ্রহিমাচল তা দেখল, বড়পর্দায়। হাততালি দিল। আর এই ঝড়ের অনেকটা ধরে রাখল সেই সিঙ্গল স্ক্রিন, যা আড়াই দশক ধরে প্রেমিক শাহরুখকে বাঁচিয়ে রাখে ম্যাটিনি শো-এ। অশান্ত উপত্যকায় সেই সিঙ্গল স্ক্রিনেরই দরজা খুলে দিয়েছেন শাহরুখ, ‘পাঠান’-এর সাফল্যের তোড়ে। ঋণ শোধ তাঁর এটুকুই।
শাহরুখ খানের ভক্ত না হয়েও তাই এই উন্মাদনার গণিত দুর্বোধ্য লাগে না। দুর্বোধ্য লাগে না, কেন শাহরুখ নিজেকে কিছুটা বদলাতে বদলাতে গেলেও, ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মতো স্থির থাকেন ভারত অথবা ইন্ডিয়া নামক ভূখণ্ডটির ভালবাসার প্রতিভূ হয়ে। কিন্তু যে দেশে গণমাধ্যম গণমনকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করে, সেই দেশে এই ‘জওয়ান’ ছবির দৃশ্যের মতো রাস্তায় কাঁটা বিছিয়ে কি তিনি বিচ্যুত করতে পারবেন আকাঁড়া, প্রশ্নহীন রাজনৈতিক বিশ্বাসের গতিপথ?