কলকাতা অনেক দিন পরে জেগে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে আপনার? না পাঠক। কলকাতা জেগেই ছিল। ধিকধিক করে জ্বলছিল তুষের আগুন। আজ একটু উসকানি পেয়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে। এখনও কলকাতাকে কেউ নিন্দে করতে পারে, খারাপ বলতে পারে, তার ইচ্ছে। কিন্তু কলকাতা দেখিয়ে দিয়েছে মানুষ কী চায়। আমি তো ঠিক করে নিয়েছি, যতদিন বাঁচব কলকাতাতেই বাঁচব। বছর খানেক আগে আমি ভেবেছিলাম বাইরের কোনও দেশে চলে যাব। সেখানে শিল্পচর্চা করব। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে জেদ ধরে থেকে যাই।
২২.
অনেকেই বলছেন, মিছিল কেন ভাগ হয়ে যাবে? কেন একত্রে মিছিল হচ্ছে না? আমার কাছে মোটেই ব্যাপারটা ভাগ হয়ে যাওয়া নয়। সকলের মনটা যদি একদিকে থাকে, এক লক্ষ্যে থাকে– তাহলে কীভাবে তারা আলাদা হল? মানুষের সংঘবদ্ধতা জরুরি। সন্দীপ ঘোষ গ্রেফতারিতে প্রমাণ করল, খানিক হলেও সাধারণ জনতার এই বিপ্লবে, ‘বিপ্লব’ই বলব আমি– কাজ হয়েছে কিছু। এখনও বিচারের অনেক বাকি। কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীগোষ্ঠী থেকে পাড়ার নানা সংগঠন যে রোজ মিছিল করছে, প্রতিবাদ করছে, তা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাইরে গিয়ে করছে না। এই বঙ্গেই করছে। অনেক দিন পর একটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দেখা গেল। অনেকে বলছেন, হবে না, হচ্ছে না। কতদূর কী হবে, তাঁরা কোন জ্যোতিষীর কাছ থেকে জেনে এসেছেন?
সমাজ পরিবর্তন করার বিপ্লব আমরা ২০১১ সালে দেখেছি। আমিও নেমেছি তখন পথে। আজকের বিপ্লব আরও। আমাদের সমাজকে বদলে দেওয়ার। মানুষের মনকে বদলে দেওয়ার। বিচার চাওয়ার পাশাপাশি, এই যে ঘৃণ্য পৈশাচিক ঘটনাগুলো তা আর যাতে না হয়, সেই ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া। সমানাধিকারের দিকে ঝোঁক দেওয়া। রাতের দিকে, যে রাত বিস্তৃত, তারার ভরা, মেঘের তলা দিয়ে একলা হেঁটে যেতে একটা মেয়ে যেন কখনও ভয় না পায়– এই স্বপ্নকে সত্যি করে তোলা। এইটা অস্তিত্বের লড়াই।
বিচার তৈরি করে কে? মানুষই। অস্ত্র তুলে নেয় না। সে বিশ্বাস করে এই আইনে। প্রতিকার চায়। আইনের ফাঁকফোকর খোঁজে। আমি সোশ্যাল মিডিয়াতে কোনও একটা কথাও লিখিনি। পোস্ট করিনি। শুধু দেখেছি, আমি স্তম্ভিত। এই ঘটনায় স্তম্ভিত। এত মানুষের জেগে ওঠায় স্তম্ভিত, খুশিও। আগের বারও বলেছি, দুর্গাপুজো বন্ধ করে দেওয়ার যে প্রস্তাব এসেছে, তা অহেতুক। কারও কিচ্ছু যায় আসবে না। শুধু মাঝখান থেকে হাজার হাজার মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাবে। পুজো বন্ধ হবে না। কিন্তু উৎসবের মোড় ঘুরুক। উৎসবেও প্রতিবাদ হোক। উৎসবের পুরনো ঝলকগুলো বদলে যাক। উৎসব এবারে নস্টালজিয়া থেকে বেরক।
মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর যে কণ্ঠ, সেই কণ্ঠের পাশাপাশি মানুষের কণ্ঠ জাগুক। দেবীর বোধন হোক নতুন ভাবে। আমি চাই এটা। আমি পজেটিভ। এখনও।
বিসর্জনকে আমরা রীতি-নীতি বলে মেনে এসেছি। কিন্তু এই বিসর্জন নয়। দুর্গাপ্রতিমার বিসর্জনে আমরা বিশ্বাস করি। তা বিসর্জন না হলে আবাহন হবে না সামনের বছর। এই বিসর্জন আমরা চাইনি। এ বড় ভয়ংকর বিসর্জন।
আমার ছবিতে যেসব নারী থাকে, সেগুলো কারা? ওগুলো আমিই। আমার মধ্যে নারীর সত্তা রয়েছে। আমি তো চৈতন্যর দেশে, বুদ্ধের দেশে জন্মেছি। তাঁদের আদর্শে বিশ্বাস করি। আমার ভেতরটা কঠিন, পাথর। কিন্তু বাইরেটা নরম।
কলকাতা অনেক দিন পরে জেগে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে আপনার? না পাঠক। কলকাতা জেগেই ছিল। ধিকধিক করে জ্বলছিল তুষের আগুন। আজ একটু উসকানি পেয়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে। এখনও কলকাতাকে কেউ নিন্দে করতে পারে, খারাপ বলতে পারে, তার ইচ্ছে। কিন্তু কলকাতা দেখিয়ে দিয়েছে মানুষ কী চায়। আমি তো ঠিক করে নিয়েছি, যতদিন বাঁচব কলকাতাতেই বাঁচব। বছর খানেক আগে আমি ভেবেছিলাম বাইরের কোনও দেশে চলে যাব। সেখানে শিল্পচর্চা করব। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে জেদ ধরে থেকে যাই। কারণ ভয়ংকর এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষ একে-অপরের পাশে দাঁড়াচ্ছে। কে, কী, কেন বাছবিচার না করে। এই কারণেই ছেড়ে চলে যেতে পারব না। কারণ এখনও কলকাতা রাস্তায় নামে। কথা বলতে জানে। ভয়ংকর ঘটনা– কলকাতাতেই ঘটেছে, কিন্তু এই কলকাতার মানুষই তো চাইছে তার বিচার। চুপ করে নেই। কলকাতার এখনও অনেক সম্ভাবনা। কলকাতায় এখনও অনেক ম্যাজিক। এটা এক ক্রান্তিকাল। নিষ্প্রভ কোনওকালেই ছিল না। মনে পড়ছে শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন: ‘হেঁটে দেখতে শিখুন/ ঝরছে কী খুন/ দিনের রাতের মাথায়/ আরেকটা কলকাতায় সাহেব/ আরেকটা কলকাতায়’। সেই আরেকটা কলকাতা এখন বেরিয়ে পড়েছে। নিজেই হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে পড়েছে সেই কলকাতা।
ইতিহাস ঘুরেফিরে এভাবেই আঘাত করে আমাকে। সলিল চৌধুরীর বিদ্রোহের গান আমাদের কাছে এখনও প্রাসঙ্গিক। অরিজিৎ সিং তো নিজের গান ভাইরাল করে ফেললেন: ‘আর কবে?’ আগুনের জন্য আমাদের ইন্ধন দরকার ছিল। তা আমরা পেয়েছি।
আজ একটা ৪ বছরের বাচ্চা মেয়ে, সে হয়তো কিছুই বোঝে না। কিন্তু সে বলছে ‘তিলোত্তমার বিচার চাই’। অনেকে বলছেন, ‘ও তো কিছুই জানে না। কী শেখাচ্ছেন ওকে!’ আমি বলছি, এটাও জরুরি। এটা শিখতে হবে। ‘যাসনে ও হামলায় যাসনে’ বললে হবে না আর। ছোটবেলায় আমাদের বাবা-মা’রা বলেছেন, ওখানে ভিড়, ওখানে মারামারি, ওখানে যাস না। আসলে ওখানেই যেতে হয়। পলিটিস্কে জড়াতে হয় না, সে জন্মায় পলিটিক্সের মধ্যেই।
আজ বুক চিরে কাঁদতে ইচ্ছে করে যখন দেখি একটা বাচ্চা বিচার চাইছে, গানের সুরে সুরে কেউ রাগ উগড়ে দিচ্ছে তার নাচে– আসলে এগুলোই অধিকার। তা ছিনিয়ে নিতে হবে। রাষ্ট্র আমাদের মুখ যে বন্ধ করতে পারবে না।
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ১৯: আমার দুর্গার মধ্যে এ বছর বিষণ্ণতার সুর থাকবে
পর্ব ১৮: এখনও ভয় হয়, আমার তৈরি দুর্গাপ্রতিমা মানুষ ভালোবাসবেন তো?
পর্ব ১৭: পুজোসংখ্যার প্রচ্ছদে দুর্গা থাকতেই হবে, এটাও একধরনের ফ্যাসিজম
পর্ব ১৬: সাধারণ মানুষের কাছেই শিল্পের পরশপাথর রয়েছে
পর্ব ১৫: রাষ্ট্র যদি রামের কথা বলে, শিল্পীর দায় সীতার কথাও বলা
পর্ব ১৪: মানচিত্র মোছার ইরেজার শিল্পীর কাছে আছে
পর্ব ১৩: তৃতীয় নয়নকে গুরুত্ব দিই, তৃতীয় লিঙ্গকেও
পর্ব ১২: লাখ লাখ টাকা কামানোর জন্য দুর্গাপুজো করিনি, করব না
পর্ব ১১: বাদল সরকারের থিয়েটার পথে নেমেছিল, আমার শিল্পও তাই
পর্ব ১০: যে কারণে এখন দুর্গাপুজো শিল্প করছি না
পর্ব ৯: এদেশে শিল্প সেক্যুলার হবে না
পর্ব ৮: শুধু শিল্প নিয়ে যারা বাঁচতে চায়, তারা যেন বাঁচতে পারে
পর্ব ৭: ক্যালেন্ডারের দেবদেবীর হুবহু নকল আমি করতে চাইনি কখনও
পর্ব ৬: সাধারণ মানুষকে অগ্রাহ্য করে শিল্প হয় না
পর্ব ৫: দেওয়ালে যামিনী রায়ের ছবি টাঙালে শিল্পের উন্নতি হয় না
পর্ব ৪: দেবীঘটও শিল্প, আমরা তা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না
পর্ব ৩: জীবনের প্রথম ইনকাম শ্মশানের দেওয়ালে মৃত মানুষের নাম লিখে
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত
খেলিফের প্রতি নেটিজেনের বিরুদ্ধতার কারণ তাই, আর যাই হোক, তা ‘মেয়েদের সমানাধিকারের’ দাবিতে নয়। সমস্যা অবশ্যই খেলিফের লম্বা, পেটানো পেশিবহুল চেহারা– যা বহু মানুষের মতে ‘নারীসুলভ’ নয়। অর্থাৎ, অলিম্পিক খেলার যোগ্যতা অর্জন করা ক্রীড়াবিদ পাশ করতে পারেননি আমাদের বিউটি প্যাজেন্টে। দুইক্ষেত্রেই লজ্জা আমাদের। তবুও খেলিফ জিতলেন, সোনা ছাড়া আর কীই বা পেতে পারতেন তিনি?